ওবায়দুর রহমান
এবারো কুরবানি ঈদে কাঁচা চামড়ার বাজারের চিত্র একই ধরনের দেখা গেছে। ঈদ এবং এরপরের তিন দিন চামড়ার বড় আড়ত পোস্তায় দেখা গেছে বিপুল ব্যস্ততা। তবে নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে চামড়া কেনার অভিযোগ করেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। একই অভিযোগ ঢাকার বাইরে থেকে আসা পাইকারদের। ফলে এবার চামড়ার মৌসুমি ব্যবসায়ী ও পাইকাররা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানিয়েছেনা। তারা বলছেন, আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছে।
তবে ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, চামড়ার দরপতনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এর হকদার গরিব ও এতিমরা। এ দেশে আবহমানকাল থেকে কুরবানির চামড়া বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করার রেওয়াজ রয়েছে। এসব চামড়া সংগ্রহ করে মাদ্রাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে দেশের বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করে থাকে। চামড়া বিক্রির অর্থ দিয়ে এসব মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রায় ছয় মাসের খরচ নির্বাহ করা যায়। তবে প্রতিবছর চামড়ার দাম কমার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। ফলে তাদের এসব অনুদাননির্ভর প্রতিষ্ঠান চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
কুমিল্লার মুরাদনগরের জামেয়া ইসলামিয়া মোজাফফারুল উলুম মাদ্রাসার খাদেম হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদউল্লাহ বলেন, চামড়ার দাম কমলে ফড়িয়া, আড়তদার, ট্যানারি মালিক তথা কুরবানিদাতা নয়; গরিব-দুস্থ মানুষই সবচেয়ে বেশি কষ্টে ভোগে। কুরবানির পশুর চামড়ার বিক্রয় করা টাকা ছহীহ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা ও গরিব-দুস্থদের দান করাটাই নিয়ম। কুরবানির চামড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থে এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক খরচের একটি বড় অংশ নির্বাহ করা হয়। কিন্তু চামড়ার দাম প্রতিবছর কমতে থাকায় প্রতিষ্ঠান চালাতে হিমশিম খেতে হয়। এ ব্যাপারে আমরা সরকারের যথাযথ হস্তক্ষেপ কামনা করি। ঢাকা এবং এর আশপাশের বেশ কয়েকটি এতিমখানা ও মাদ্রাসার খাদেমদের সঙ্গে কথা বলে একই চিত্র পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার আশায় পরিকল্পিতভাবে চামড়ার দাম কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনুদাননির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো।
এদিকে কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন ও চাহিদা কমার অজুহাত তুলে কুরবানির পশুর চামড়ার দাম কমিয়ে নির্ধারণ করছেন ট্যানারি মালিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দর অপরিবর্তিত রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি পাউন্ড চামড়ার মূল্য ৭০ সেন্ট। বাংলাদেশের চামড়ার মান বিশ্বে এক নম্বর। অর্থাৎ এ দেশের পশুর চামড়ার দামও আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি। ভারতের গরুর চামড়ার মান অনেক নিম্নমানের। ভারতে বর্তমানে প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা চামড়ার মূল্য প্রায় ৯০ টাকা, যা বাংলাদেশের নির্ধারিত দরের প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরিত না হয়ে উচ্চ আদালতের আদেশে প্রতিদিন যে সরকারকে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা দিতে হচ্ছে, চামড়ার দাম কমিয়ে নির্ধারণ করে ওই অর্থও উসুল করে নিচ্ছেন তারা।
এদিকে ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি কমার কথা বললেও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। সংস্থাটির হিসেবে গত তিন বছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি প্রায় তিনগুণ হয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি হয়েছে ৪২৯ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৩৫ দশমমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ হাজার ১২৪ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৯৭ দশমিক ২৮ মিলিয়ন ডলারে। এ হিসাবে ৩ বছরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ২২৫ শতাংশ।
অন্যদিকে সিন্ডিকেটের কথা অস্বীকার করে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, পাড়া-মহল্লার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কোনো কিছু না বুঝেই ঘোষিত মূল্যে চামড়া কেনে। কিন্তু এরপর কয়েক হাত ঘুরতে গিয়ে দাম অনেক বেড়ে যায়। অথচ কুরবানিদাতারা উপযুক্ত দাম পায় না। ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব মানুষগুলো। অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীরা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বিদায় হয়, খরচ বেড়ে যায় কারখানার। আমরা মনে করি, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি মহল্লাভিত্তিক ক্রয়কেন্দ্র বসানো দরকার, অন্যথায় গরিব মানুষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি চামড়া পাচার হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ ট্যানারি এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কাঁচা চামড়ার ৫০ শতাংশ কুরবানির সময় সংগ্রহ করা হয়। আগামী সপ্তাহ থেকে লবণ দেয়া চামড়া সংগ্রহ করা হবে। আমাদের পক্ষ থেকে যে মূল্য বেঁধে দেয়া হয়েছে, সেই মূল্যে চামড়া কেনা হবে। লবণের বাড়তি দামের করণে পোস্তা ও আড়তদারদের প্রতি বর্গফুটে আরো ১০-১২ টাকা বেশি খরচ পড়বে। সেই মূল্য সমন্বয় করে তাদের চামড়া কিনতে হবে। ট্যানারি মালিকরা প্রতি বর্গফুট চামড়া নির্ধারিত ৫০ টাকার বেশি দিয়ে কিনবেন না। বিশ্ববাজারে মন্দার কারণে এমনিতেই আমরা লোকসানে আছি। তাই বাড়তি দামে চামড়া কেনা সম্ভব নয়।
ওবায়দুর রহমান : প্রতিবছর ঈদুল আজহায় কুরবানির পশুর চামড়া নিয়ে শুরু হয় মুনাফার লড়াই। কুরবানির পশুর চামড়ার বিক্রির টাকা সম্পূর্ণ গরিবের হক। কারণ এই টাকা সাধারণত এতিমখানা, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। আর অপেক্ষাকৃত কম দামে এই চামড়া সংগ্রহের জন্যই প্রতি বছর কুরবানির সময় নানা ফন্দিফিকির করেন ব্যবসায়ীরা। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব ও এতিমরা। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়াজাত পণ্যের দাম কমে যাওয়া, লবণের উচ্চমূল্য, শ্রমিকের মজুরি, ব্যবসার পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণ দেখিয়ে প্রতিবছর দাম কমাতে তৎপর থাকেন চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ব্যবসায়ীরা। এমনকি তাদের নির্ধারিত দামের চেয়ে আরো কমে চামড়া কেনার বিষয়েও তৎপরতা দেখা যায় আড়ত মালিক ও ফড়িয়াদের মধ্যে।
আরআর