মাওলানা মামুনুল হক
কওমী মাদরাসা সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়টি বর্তমানে বহুল আলোচিত ৷ অন এবং অফ উভয় লাইনেই বিতর্ক তুঙ্গে উঠছে এবিষয়ক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে ৷ আমার মরহুম ওয়ালেদ হযরত শায়খুল হাদীস রাহিমাহুল্লাহর নাম ও তাঁর স্বীকৃতির আন্দোলনের কথাও উঠে আসছে অনেকের আলোচনায় ৷ নিঃসন্দেহে কওমীর স্বীকৃতির সঙ্গে শায়খুল হাদীস (রহঃ) এর নাম জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে ৷ সুতরাং তাঁর নাম এ প্রসঙ্গে আলোচিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ৷ তবে অবশ্যই তা হওয়া চাই বাস্তবতার আলোকে ৷
হযরত শায়খুল হাদীস রাহিমাহুল্লাহর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে কওমী সনদের স্বীকৃতির দাবিতে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক নানামুখী তৎপরতার পাশাপাশি বৃহত দুটি আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে ৷ ২০০৫সালে ছাত্র কনভেনশন শিরোনামে ছাত্রআন্দোলন এবং ২০০৬এ মহা-সমাবেশ ও মুক্তাঙ্গণে পাঁচ দিনের অবস্থান কর্মসূচী ৷ আল্লাহর রহমতে দুটি আন্দোলনেরই একজন সংগঠক হিসাবে বিশেষ ভূমিকা পালনের সুযোগ আমার হয়েছে ৷ আর সেই সুবাদে সম্যক অবগত রয়েছি এর প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ৷
পল্টন ময়দানের ছাত্র কনভেনশনে হযরত শায়খুল হাদীস রহাহিমাহুল্লাহ খুবই আবেগঘন বক্তব্য রেখেছিলেন ৷ সে বক্তব্যের মূল কথা ছিল-
"জোট সরকার যদি মনে করে তাদের ক্ষমতায় আসার পিছনে আমার বিন্দুমাত্র ভূমিকা আছে তাহলে তারা যেন আমাকে আমার ছাত্রজনতার সম্মুখে লজ্জিত না করে এই শিক্ষার স্বীকৃতির ব্যবস্থা করে" ৷
আমরা জানতাম, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া ব্যক্তিগতভাবেও হযরত শায়খুলহাদীসকে বিশেষ সন্মান ও সমীহ করতেন ৷ সরকার ও প্রশাসনে তাঁর বিশেষ এক মর্যাদা ছিল ৷ পল্টনের ঐ বক্তব্যে সরকারের মধ্যে আলোড়ন তৈরি হয় এবং কওমী স্বীকৃতির দাবি আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে মর্মে আভাস আসতে থাকে ৷ এমন প্রেক্ষিতে প্রথম বারের মত আলোচনার বিষয় হয়ে দাড়ায় "স্বীকৃতি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে"? ৷ এ পর্যায়ে বলে রাখা ভালো, তখনো বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু বুযুর্গ ওলামায়ে কেরাম কওমী স্বীকৃতির ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং অহরহ স্বীকৃতির বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করতেন ৷
কওমী শিক্ষার স্বীকৃতির সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় তা বাস্তবায়নের রূপরেখা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয় ৷ এপর্যায়ে বেফাকুল মাদারিসের উদ্যোগ ও ভূমিকা ছিল একক ও অনন্য উচ্চতায় ৷ এমন সময় শুরু হয় দুর্যোগের ঘনঘটা ৷ বাতাসে ভাসতে শুরু করে একটি নাম ৷ ইসলামী ব্যংক বাংলাদেশের শরীয়া কাউন্সিলের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল "ম" অদ্যাক্ষরের জামাত ঘরানার এক ব্যক্তি তিনি ৷ তার সহায়তা ও তার পেছনের মদদদাতাদের আনুকুল্যে বেফাকুল মাদারিসের প্রতিদ্বন্দি হিসাবে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি হয় আরো কিছু পক্ষ ৷ উত্তরবঙ্গের মিযান জামাতের পরীক্ষার আয়োজক "তানযীমুল মাদারিস" নামক আঞ্চলিক বোর্ডটি রাতারাতি দাওরা পর্যন্ত উন্নীত হয়ে যায় ৷ স্মর্তব্য যে, আমি ১৯৯৬ থেকে ২০০০সাল পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় এক মাদরাসায় শিক্ষকতার সুবাদে তানযীমুল মাদারিস বোর্ডের হাকীকতেহাল সম্পর্কে সম্যক অবগত ৷ এহেন স্ফীত বোর্ড তানযীমের নেতৃত্বে অন্যান্য বিক্ষিপ্ত বোর্ডগুলোকে একত্রিত করে দাড় করানো হয় বেফাকের বিকল্প ও প্রতিদ্বন্দি হিসাবে ৷ অথচ তখনো উত্তরবঙ্গের তানযীম আর গওহরডাঙ্গার বোর্ড বেফাকের আওতাধীন বোর্ড হিসাবে কর্মরত এবং দাওরায়ে হাদীসের পরীক্ষা বেফাকের অধীনেই চলমান ছিল ৷ আর পটিয়ার ইত্তেহাদ বোর্ড তো বেফাকের জন্মের পরপরই এর অধীন ছিল ও দাওরার পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে সুদীর্ঘকাল ৷
বেফাকুল মাদারিসের জন্মই হয়েছিল অন্যান্য বোর্ডগুলোর সহায়তায় একমাত্র জাতীয় বোর্ড হিসাবে ৷ দীর্ঘকাল স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকার পর হাটহাজারী ও লালবাগ মাদরাসার মত বড় বড় মাদরাসাগুলোও যখন বেফাকে যোগ দিল তখন তো বেফাকের সার্বজনীনতা অারো বেড়ে গেল ৷ বহু আঞ্চলিক বোর্ড বেফাকের সাথে সমন্বিত হয়ে বাংলাদেশ ব্যপি মাদারিসে কওমিয়ার একক প্লাটফর্ম গড়ে ওঠার অপার সম্ভাবনা দোরগোরায় ছিল ৷ স্বীকৃতির প্রসঙ্গ বিষয়টিকে আরো তরান্বিত করছিল ৷ রাজনৈতিকভাবে শতধা বিভক্ত বাংলাদেশের ইসলামী অঙ্গণ অন্তত মাদারিস কেন্দ্রিক একটি মযবুত ঐক্যের ভিত তৈরির দ্বারপ্রান্তে ছিল ৷ এমন সময় সর্বনাশা ষড়য়ন্ত্রের অণলে কপাল পুড়ল ইসলামী জনতার ৷ স্বীকৃতির লোভ দেখিয়ে ঐক্যবদ্ধ বেফাক থেকে ভাগিয়ে নেয়া হল আত্নপ্রবঞ্চিত কিছু সরলপ্রাণ বুযুর্গকে ৷
হযরত শায়খুল হাদীস রাহিমাহুল্লাহকে বে-চায়ন, বে-কারার করে তুলল অপার সম্ভাবনার এহেন মৃত্যুশংকা আর কওমীর শত্রুদের এই ছিনিমিনি খেলবার তামাশা ৷ তিনি অনুভব করলেন, স্বীকৃতি বাস্তবায়নের আগেই যদি শুরু হয় এমন নোংরা প্রতিযোগিতা তাহলে পরবর্তিতে পরিণাম কী হতে পারে! বিশেষ করে যদি দুর্বল অবকাঠামোর উপর সরকারী স্বীকৃতি বাস্তবায়িত হয় তাহলে সরকার নাকে দড়ি বেধে ঘোরাবে কওমী মহলকে ৷ তাই তিনি অনৈক্যের ঘোর বিরোধিতা আর ঐক্যবদ্ধভাবে স্বীকৃতি আদায়ের পথে সংগ্রামে নিবেদিত রইলেন ৷ এমন প্রেক্ষিত থেকেই পালিত হয়েছিল শায়খুল হাদীস রাহিমাহুল্লাহর ঐতিহাসিক অবস্থান কর্মসূচী ৷ পরিকল্পনা ছিল শায়খুল হাদীসের এই কর্মসূচীতে হাটহাজারীর হযরতও সংহতি প্রকাশ করবেন ৷ তাঁকেও এখানে নিয়ে আসা হবে ৷ কিন্তু রাজনীতির দৌড়ে শায়খুল হাদীসের প্রতিদ্বন্দিরা বাগড়া বাধিয়ে বাঞ্চাল করে দিল সেই পরিকল্পনা ৷
সে যাই হোক, শায়খুল হাদীস রাহিমাহুল্লাহর এ কর্মসূচীর উদ্দেশ্য ছিল, বিচ্ছিন্নভাবে নয় বরং ঐক্যবদ্ধভাবে স্বীকৃতি আদায় করা ৷
আজও আমাদের বক্তব্য পরিস্কার ৷ আমরা স্বীকৃতি চাই ঐক্যবদ্ধভাবে ৷ তার সহজ উপায় তো এটাই যে, বেফাকের বাইরের শীর্ষ ব্যক্তিত্বদেরকে বেফাকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক ৷ যেমনটা মরহুম খতীব উবায়দুল হক রাহিমাহুল্লাহর উদ্যোগে হয়েছিল ৷ গওহরডাঙ্গার মুফতী রূহুল আমীন হাফিজাহুল্লাহকে মহাসচিব আর অন্য বোর্ডগুলোর প্রতিনিধি নিয়োগ করে সমন্বয় করেছিলেন তিনি ৷ নিজেরা ঘরে বসে আগে প্লাটফর্ম মজবুত করুন ৷ তারপর সরকারের সাথে দেনদরবার শুরু করুন ৷ যদি সম্মিলিতভাবে বেফাক ছাড়া অন্য কোনো নামে অন্য কোনোভাবে কাজ করা যায় তাতেও আমাদের আপত্তি নেই ৷ কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিবিশেষের ব্যপারে অভিযোগ অনাস্থা থাকতেই পারে, কিন্তু তাই বলে বিচ্ছিন্নতাকে অন্তত এই জায়গাটায় মেনে নেয়া যায় না ৷ যদি দুর্ভাগা বাংলাদেশী মুসলমানদের কপালে শতভাগ ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম নাই থাকে তাহলে মন্দের ভালো হিসাবে অন্তত আশিভাগ ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম নিজস্ব বুনিয়াদের উপর কায়েম বাংলাদেশে কওমী মাদরাসার একমাত্র জাতীয় বোর্ড বেফাকুল মাদারিসই হোক আস্থার শেষ ঠিকানা ৷ এটাই ছিল হযরত শায়খুল হাদীস রাহিমাহুল্লাহর চেতনা ৷
এখানে অবান্তরভাবে আওয়ামীলীগ বিএনপির প্রশ্ন উত্থাপনকে পানি ঘোলা করার আরেকটি অপপ্রয়াস বলে মনে হয় ৷ যে কোনো সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রাখা যেতেই পারে ৷ লেয়াঁজো করলেও ভালো কথা ৷ কিন্তু সরকারের এজেণ্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হতে চাইলে বা হয়ে গেলে সেটা মেনে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই ৷ অনুকম্পা ভোগ করে কখনো অধিকার আদায় করা যায় না ৷
লেখাটি মাওলানা মামুনুল হকের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া