ঈদুল আজহা মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। এদিন সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ আশায় পশু কোরবানি করে থাকেন মুসলমানরা। বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ হিসেবে পরিচিত এই উৎসবের মূল আহ্বান ত্যাগের। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সারাদেশের মানুষ কর্মস্থল কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছুটি পেয়ে সময় কাটাচ্ছেন পরিবার-পরিজনের সঙ্গে। ঈদের নির্ধারিত তিন দিনের ছুটির সঙ্গে সরকারের নির্বাহী আদেশে আরও একদিন ছুটি ঘোষণা হওয়ায় এবার টানা ছয় দিনের ছুটি পেয়েছেন সরকারি চাকুরিজীবীরা। তবে ছুটি নেই দেশের কওমি মাদ্রসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থেকে ঈদের আনন্দ কোরবানি দিয়ে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসার জন্য চামড়া সংগ্রহ করছে কিংবা অনুদান।
মঙ্গলবার সারাদেশে ঈদুল আজহা উদযাপিত হচ্ছে। ঈদুল আজহার নামাজ শেষে পশু কোরবানি দিয়েছেন মুসলমানরা। ঈদে যখন সবাই বাড়ি ফেরে, তখন ব্যস্ততা বাড়ে কওমি শিক্ষার্থীদের। ঈদের প্রায় মাসখানেক আগে থেকেই শিক্ষার্থীরা পশুর চামড়া মাদ্রাসায় দান করতে উৎসাহী করে সাধারণ মানুষদের। বিভিন্ন সময় বাড়ি বাড়ি গিয়েও মাদ্রাসার পক্ষ থেকে চামড়া দান করার অনুরোধ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় এই শিক্ষার্থীরা পোস্টার, লিফলেট বিলি করে। ঈদের দিন পশু জবাই করে চামড়া সংগ্রহে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘোরে। শিক্ষার্থীদের কাজের মনিটিরিং করতে মাদ্রাসা শিক্ষকরা থাকলেও সব পরিশ্রম করতে হয় শিক্ষার্থীদেরই। কোথাও কোথাও দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা চামড়া ভ্যানে তুলে সেই ভ্যান নিজেরা চালিয়ে নিয়ে যায় মাদ্রাসায়। সারাদিন রক্ত মাখা শরীরে থাকতে হয় পরিবার থেকে দূরে। এতসব পরিশ্রম মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা করে অসচ্ছ্বল সহপাঠীর জন্য। ৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থী সবাই অংশ নেয় এই উদ্যোগে। এছাড়া কখনও কখনও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের হুমকির মুখেও থাকে ছাত্ররা।
ইসলাম ধর্মমতে, কোরবানির পশুর চামড়া যিনি কোরবানি দিচ্ছেন, তিনি নিজে ব্যবহার করতে পারবেন না। তবে পশুর চামড়া বিক্রি করলে বিক্রিত অর্থ দান করতে হবে দুস্থদের মধ্যে।
কওমি মাদ্রাসা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে মক্তব, ফোরকানিয়া এবং কোরানিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসার সংখ্যা ১৪ হাজার ৯৩১টি। এই মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখ। যাকাত, কোরবানির পশুর চামড়া, চামড়ার অর্থ কওমি মাদ্রাসার আয়ের অন্যতম উৎস। শুধুমাত্র এই ঈদুল আজহার সময় কোরবানির পশুর চামড়া থেকে কমপক্ষে চার মাসের ব্যয় মেটানো সম্ভব হয় বলে জানিয়েছেন মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা। সাধারণত দেশের কওমি মাদ্রসায় চামড়া সংগ্রহ করা হয় দুস্থ শিক্ষার্থীদের লালন-পালনের খরচাবাবদ।
রাজধানীর মিরপুরের খানকা-ই-মশুরিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার পড়ছে ৫ বছর বয়সী ইব্রাহিম। মাদ্রাসার অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেও যোগ দিয়েছে চামড়া সংগ্রহে। কখনও চামড়া টেনে ভ্যানে তুলছে, কখন চামড়া পাহারা দিচ্ছে। রক্তমাখা পাঞ্জাবি পরে ছুটছে অন্যদের সঙ্গে। এই মাদ্রসাটির একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, মাদ্রাসার জন্য তারা এই পরিশ্রম করেন। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছেন পরিবার ছাড়া ঈদে। ঈদের দিন বিকেলেই ছুটবেন বাড়ির পথে।
১৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইউসুফ রাজধানীর লালবাগের একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতো সেও চামড়া সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত দিন পার করেছে। মোহাম্মদ ইউসুফ বলে, ‘বাড়িতে যেতে মন চাইলেও উপায় নেই। শিক্ষকদের নির্দেশ সবাইকে থাকতে হবে। ছোটভাই বাবার সাথে হাটে গিয়ে গরু কিনেছে। আমি যেতে পারিনি। খারাপ লাগে একটু। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটে, এটাও ভালো লাগে।’
.এ প্রসঙ্গে জামিয়া কোরানিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের মাদ্রাসায় চামড়া সংগ্রহ করা হয়। তবে এই চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রিত অর্থ শুধু মাত্র দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয় হয়। অন্য কোনও খাতে তা ব্যয় করা হয় না। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রিত অর্থ শুধুমাত্র দুস্থদের জন্য। শিক্ষার্থীরা এ কাজে সহায়তা করে। তাদের এই শ্রম অন্য আর ১০টি শিক্ষার্থীর শিক্ষার রাস্তা প্রসারিত হয়।
এ প্রসঙ্গে শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, ‘কোরবানির পশুর চামড়া নিজে ব্যবহার না করলেও বিক্রিত অর্থ দান করতে হবে দুস্থদের, যারা যাকাতের অর্থ ভোগ করতে পারবেন। কোনও মাদ্রাসা যদি দুস্থদের বিনাখরচে লালন-পালন করে, সেই মাদ্রাসায় তা দান করা যাবে। সাধারণত আমাদের দেশের কওমি মাদ্রাসায় চামড়া সংগ্রহ করা হয় দুস্থ শিক্ষার্থীদের লালন-পালনের জন্য। এক্ষেত্রে মাদ্রাসায় চামড়া দান উত্তম। কারণ একদিকে যেমন দুস্থদের দান করা হচ্ছে, অন্যদিকে দুস্থ কিছু শিশু শিক্ষার সুযোগও পাচ্ছে।’
তবে শিক্ষার্থীদের চামড়া সংগ্রহের কাছে ব্যবহার করা অনুচিত বলে মনে করেন ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। তিনি বলেন, ‘ঈদের আনন্দ বেশি উপভোগ করে শিশু কিশোররা। তাদের ঈদের ছুটি না দিয়ে চামড়া সংগ্রহের কাজে লাগানো উচিত নয়। আমার অধীনে থাকা মাদ্রাসাগুলোতে সব শিক্ষার্থীরা ঈদের ছুটি পায়। মাদ্রাসা কীভাবে চালানো হবে, এ চিন্তা মাদ্রাসারা পরিচালনা কমিটির।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন