যুবায়ের আহমাদ
ইসলাম পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ধর্ম। ইসলামে অপরিচ্ছন্নতা ও অপবিত্রতার স্থান নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কোরবানিদাতাদের অবহেলার কারণে কোরবানির বর্জ্যে পরিবেশ দূষিত হয়ে যায়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কোরবানির পশুর রক্ত, মজ্জা, হাড়গোড় আর বিষ্ঠায় কোনো কোনো এলাকা বিশালাকারের ভাগারে পরিণত হয়। উৎকট দুর্গন্ধে ঈদের আনন্দটাই ম্লান হয়ে যায়। কোরবানির পশুর বর্জ্য সময়মতো অপসারণ না করাই এর মূল কারণ।
রাসুলুল্লাহ সা.-এর সময়ে সাহাবায়ে কেরাম মোটা কাপড় পরতেন। জুমার দিন অতিরিক্ত লোকসমাগমের ফলে ঘামের দুর্গন্ধে অন্যদের কষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ছিল বলে রাসুলুল্লাহ সা. সাহাবায়ে কেরাম র. কে জুমার দিনে গোসল করে পরিষ্কার কাপড় পরে সুগন্ধি ব্যবহার করে মসজিদে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যেই ইসলাম মানুষকে দুর্গন্ধের কষ্ট থেকে বাঁচাতে এতটাই পরিচ্ছন্নতার নির্দেশ দিয়েছে, সেই ইসলামের মহান ইবাদত কোরবানি কি অপরিচ্ছন্নতার কারণ হতে পারে? কখনো না। হতে পারে না মানুষের কষ্টের কারণ।
কুরবানি দাতাদের অবহেলা ও অসচেতনতাই কুরবানির পর পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। কুরবানিদাতারা মনে করেন, কুরবানির পশুর দেহ থেকে চামড়া ছাড়ানো, গোশত সংগ্রহ এবং বন্টনেই তাদের দায়িত্ব শেষ। গোশত ভাগাভাগি কুরবানি দাতার কাজ আর বর্জ্য অপসারণ শুধু সিটি কর্পোরেশনের কাজ এই ধারণা কিছুতেই ঠিক নয়। বর্জ্য অপসারণের দায়িত্ব তো প্রথমে কুরবানি দাতার। যথাসময়ে বর্জ্য অপসারণে অবহেলা করায় তা প্রতিবেশী, আশপাশের মানুষের কষ্টের কারণ হলে এর দায় কোরবানিদাতাকেই নিতে হবে। যত্রযত্র কোরবানির বর্জ্য ফেলে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়ার অধিকার ইসলাম কাউকেই দেয়নি। প্রতিবেশী, আশপাশের মানুষকে কোনোভাবে কষ্ট দেয়া জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়ার অন্যতম কারণ। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যার কষ্ট থেকে আশপাশের মানুষেরা নিরাপদ নয় সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।-বুখারি ৫/২২৪০, মুসলিম ১/৬৮
পক্ষান্তরে যথাসময়ে বর্জ্য অপসারণের মাধ্যমে জনসাধারণকে এ কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকলে জান্নাতের মতো মহান পুরস্কার। হজরত আবু সায়ীদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল খাদ্য খেয়ে জীবনযাপন করবে, সুন্নত অনুসারে আমল করবে এবং কোনো মানুষ তার দ্বারা কষ্ট পাবে না সে জান্নাতী হবে।’ -তিরমিজি ৪/৬৬৯
ব্যক্তিগত সচেতনতা আর রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থাপনার সমন্বিত প্রয়াস থাকলে অল্প সময়েরে মধ্যেই বর্জ্য অপসারণ সম্ভব। প্রতিবছর সারা বিশ্ব থেকে প্রায় অর্ধকোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রায় দেড় মাস জেদ্দা, মক্কা, মদিনা, মুজদালিফা ও মীনা এলাকায় অবস্থান করেন। সৌদি মুসলমানদের পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হাজীসাহেবরাও একাধিক কোরবানি করেন। কোটি প্রায় কোরবানির পরও হজের সময় পবিত্রভূমি অপরিচ্ছন্ন হয় না। বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) বলছে, মক্কার আদলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুললেই সহজে বর্জ্য অপসারণ সম্ভব। তাই তারা পবিত্র মক্কা শরিফের আদলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন। -দৈনিক প্রথম আলো: ৩০ আগস্ট ২০১৫
নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাই সচেতন না হলে শুধু রাষ্ট্রের পক্ষে এ বিশাল বর্জ্য অপসারণ খুবই কঠিন। প্রথমে এ কর্তব্য কোরবানি দাতার। কোরবানির বর্জ্যরে পরিস্কারের ব্যাপারে অবহেলা ইমানের দূর্বলতারই প্রমাণ বহন করবে। কারণ, ময়লা-আবর্জনা, কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলাও ইমানের অন্যতম শাখা। রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, ইমানের ৭০টিরও বেশি শাখা আছে, তন্মদ্যে নূন্যতম শাখা হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা।’ -মুসলিম: ৩৫
কুরবানির বর্জ্য কিংবা যে কোনো কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে পরিবেশকে বাসোপযোগী রাখতে সবারই এগিয়ে আসা উচিত। রাস্তাঘাট থেকে কষ্টদায়ক দ্রব্য সরিয়ে নেয়া ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেউ আবর্জনা ফেলে গেলে সে নিজে গুনাহগার হবে। তবে অন্যদেরও উচিত তা সরাতে এগিয়ে আসা। বিনিময়ে মিলবে আল্লাহর দরবার থেকে ক্ষমা ও পুরস্কার। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, মহানবী সা. বলেন, ‘একব্যক্তি রাস্তায় চলতে চলতে একটি কাটাওয়ালা ডাল দেখতে পায়, সে ডালটি সরিয়ে দেয়। আল্লাহ তার এ কাজ কবুল করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন।’ বুখারি ১/২৩৩; মুসলিম ৩/১৫২১
পরিবেশের মালিক আমি নই। আমাকে কেবল দেয়া হয়েছে এর ভোগের অধিকার। তবে সেই ভোগের অধিকার আমার একার নয়। অবাধও নয় সে অধিকার। পরিবেশ থেকে উপকৃত হবার অধিকার যেমন রয়েছে আমার তেমনি রয়েছে অন্যদেরও। আমার ব্যবহারের ফলে পরিবেশকে দূষিত করার অধিকার ইসলাম আমাকে দেয়নি। পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ; তাই বর্জ্য অপসারণ করে পরিচ্ছন্নতা অব্যাহত রাখা ইমানী দায়িত্ব। আমার কোরবানি বর্জ্য আমিই অপসারণ করবো। এমনি হোক আমাদের মানসিকতা।
লেখক: খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ, বোর্ড বাজার (আ. গণি রোড), গাজীপুর
আরআর