আমিনুল ইসলাম হুসাইনী
দয়াময় আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এতই দয়ালু যে, তিনি চান না তাঁর কোনো একটি বান্দাও জাহান্নমের নিকষ অনলে দগ্ধ হোক। তিনি তাঁর বান্দাদের এতই ভালবাসেন যে, তিনি বান্দার অনন্ত সুখময় জীবনের জন্য সৃষ্টি করেছেন পরম সুখনিবাস তথা জান্নাত।
কিন্তু মানুষ যে গুনাহের পুতুল। কখনো কখনো নিজেরই অাজান্তে কিংবা বিতারিত শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে জড়িয়ে যায় অসংখ্য গুনাহের কাজে। আর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলগুলোই সুখময় জান্নাতের সম্মুখে দাঁড়ায় বাধার প্রাচীর হয়ে। তবে আল্লাহ যে ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু। তাঁর দয়া অসীম। তিনি ক্ষমা করতেই ভালবাসেন। তাইতো গুনাহগার বান্দাদের হতাশ না হতে ক্ষমার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, (হে রাসূল বলে দিন) হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর সীমালংঘন করেছ, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করেন। তিনিতো অতি ক্ষমাশীল, বড় মেহেরবান। সুরা যুমার: ৫৩
তাই যারা ভুল পথে পা বাড়িয়েছিল আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের ভুল শোধরানোর জন্য এমন কিছু বিশেষ সময়কে নির্ধারিত করে রেখেছেন, যে সময়গুলোতে বান্দা বেশি বেশি ইবাদত করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে বান্দার সকল গুনাহই ক্ষমা করে দেন।
আর এ ধরনের ইবাদতেরই একটি সময় বা মৌসুম হলো যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন ও তার পরবর্তী তাশরিকের দিনসমূহ।
এ দিনগুলোকে রাসূল সা. আখ্যায়িত করেছেন শ্রেষ্ঠ দিন বলে। যেমন- বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, ‘এমন কোনো দিন নেই, যার আমল যিলহজ থেকে আল্লহর কাছে অধিক প্রিয়। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা. আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? জবাবে রাসূল সা. বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান মাল নিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধে বের হলো এবং এর কোনো কিছু নিয়েই ফিরে না এল।’ (যে শাহাদত বরণ করেছেন তাঁর কথা ভিন্ন)। বুখারি শরিফ: ৯৬৯, অাবু দাউদ: ২৮৮০
অপর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘পৃথিবীর দিনগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিনগুলো হলো দশকের দিনসমূহ। অর্থাৎ যিলহজের (প্রথম) দশদিন। জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহর পথে জিহাদেও কি এর চেয়ে উত্তম দিন নেই? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদেও এর চেয়ে উত্তম দিন নেই। তবে হ্যাঁ, কেবল সে-ই যে (জিহাদে) তার চেহারাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।’ মুসনাদ বাযযার: ১১২৮; মুসনাদ আবী ই‘আলা: ২০৯০
প্রথমত আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রত্যেকটা দিনই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেন না তিনিইতো এই দিন-রাত্রির স্রষ্টা। তিনি দিন-রজনী প্রত্যেককেই অনন্য স্বকীয়তার গুণে করেছেন গুণান্বিত।
তবে এ দিনগুলোতে যেহেতু সবগুলো মৌলিক ইবাদতের সমাবেশ ঘটে তাই এদিনগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য দিনেন চেয়ে অধিক হওয়াই যুক্তিসংগত। যেমনটা হাফেজ ইবনে হাজর রহ. তার ফাতহুল বারী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- 'যিলহজের দশকের বৈশিষ্ট্যের কারণ যা প্রতীয়মান হয় তা হলো, এতে সকল মৌলিক ইবাদতের সন্নিবেশ ঘটে। যথা- সালাত, সিয়াম, সাদাকা, হজ ইত্যাদি। অন্যকোনো দিন এতগুলো ইবাদতের সমাবেশ ঘটে না।' ফাতহুল বারী, ২/৪৬০
এবার আসুন! এই মাহাত্ম্যপূর্ণ দিনগুলো ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করে মহান আল্লাহর কৃপা অর্জনে সচেষ্ট হয়। করি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। কেন না আমরা জাগতিক পরীক্ষার দিনগুলোতে যদি সবচেয়ে ভালো ফলাফল অর্জন করার লক্ষ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে পারি, তবে কেন আখেরাতের পরীক্ষার জন্য এমন মাহাত্ম্যপূর্ণ দিনগুলোতে সর্বাধিক প্রচেষ্টা ব্যয় করতে পারবো না? এ দিনগুলোতে আমল করা তো বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক অনেক বেশি।
হযরত আবু হুরায়রা রা.থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, যিলহজের দশ দিনের ইবাদত আল্লাহর নিকট অন্য দিনের ইবাদত তুলনায় বেশি প্রিয়, প্রত্যেক দিনের রোযা এক বছরের রোযার ন্যায় আর প্রত্যেক রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের মতো। তিরমিজী শরীফ, হাদীস নং-৭৫৮, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-৩৭৫৭
তাই অাসুন মাহাত্ম্যপূর্ণ এই দিনগুলোতে কী কী নেক অামল করা প্রয়োজন তা পবিত্র কোরঅান হাদিসের আলোকে জেনে নেই।
যিলহজ মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার পর থেকে দশ তারিখ পর্যন্ত যত দিন সম্ভব নফল রোযা রাখা আর রাতের বেলা বেশি বেশি ইবাদত করা একজন সত্যিকার মুমিনের বৈশিষ্ট্য। তাই এইদিনগুলোতে নফল নামায,কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল, তাওবা-ইস্তিগফার ও রোনাজারী ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে রাত কাটানো কিম্বা যতটুকু সম্ভব ইবাদত করা উচিৎ।
পুরো নয়দিন রোযা না রাখতে পারলেও অারাফার দিনে রোযা রাখা খুবই জরুরি। হযরত আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন,
‘আরাফার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, এ রোযা তার পূর্বের ও পরের বছরের গোনাহ মুছে ফেলবে।’ সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৭৪০
আরাফার দিনের আরেকটি অামল হলো, নিম্নোক্ত কালিমাটি বেশি বেশি পড়া। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মূলকু ওয়া লাহুলহামদু বিয়াদিহিল খাইরু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্কাদির।’ রাসূল সা. আরাফার দিন এ কালিমাটি খুব বেশি পড়তেন। মুসনাদে আহমাদ,৬৯২২
যিলহজ মাসের নবম তারিখের ফজর থেকে তের তারিখের আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক বুদ্ধিমান মুসলমান নারী-পুরুষের জন্য একবার তাকবিরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। উল্লেখ্য, পুরুষের জন্য আওয়াজ করে,আর মহিলাদের জন্য নীরবে।
তাকবিরে তাশরিকটি হচ্ছে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ হযরত ইবনে আব্বাস রা. আরাফার দিন তথা ৯ যিলহজের ফজর থেকে আইয়ামে তাশরিকের শেষদিন পর্যন্ত তথা ১৩ যিলহজ (আসর নামায) পর্যন্ত এই তাকবিরে তাশরিকটি পড়তেন। সুনানে বায়হাকি: ৬০৭১
যিলহজের প্রথম দশকের অন্যতম অারেকটি দিবস হলো কুরবানির দিন। হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ দিন হলো, কুরবানির দিন, তারপর স্থিরতার দিন (কুরবানির পরের দিন)।’ (সুনানে নাসায়ী: ১০৫১২) এ দিনের সবচেয়ে বড় আমল হল ঈদের নামায শেষে কুরবানি করা। যারা কুরবানি দেবেন তাদের জন্য আরেকটি আমল হলো, যিলহজ মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে হাত পায়ের নখ, মাথার চুল ও অবাঞ্ছিত চুল ইত্যাদি কাটা বা ছাটা থেকে বিরত থাকা। কেন না এ কাজটি সুন্নাত।
হযরত উম্মে সালমা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, ‘যখন (যিলহজের প্রথম) ১০ দিনের সূচনা হয়, আর তোমাদের কেউ কুরবানি করার ইচ্ছে করে,সে যেন চুল-নখ ইত্যাদি না কাটে।’ সুনানে নাসায়ি কুবরা, হাদীস নং-৪৪৫৪, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৩১৪৯, সুনানে বায়হাকী
তবে খেয়াল রাখতে হবে হাত পায়ের নখ, মাথার চুল ও অবাঞ্ছিত চুলের বয়স যেন চল্লিশ দিনের বেশি না হয়ে যায়। আর এ জন্য উত্তম হলো যিলহজের চাঁদ উদিত হওয়ার কিছুদিন আগেই তা পরিস্কার করে ফেলা।
আল্লাহ তা‘আলার অশেষ মেহেরবানী যে, তিনি আমাদের মতো পাপীতাপী বান্দাদের জন্য স্বীয় অনুগ্রহে এমন নেক আমল করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
তাই আসুন! আমরা মহান আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ হয় এবং গতজীবনের সকল ভুলত্রুটি আর অন্যায়ের জন্য তাওবা করে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আর আগত দিনগুলোতে সব রকমের পাপ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক প্রত্যশা করি। মহান আল্লাহ সুবহাবনাহু তায়ালা নিশ্চয় তাঁর অসীম নামের ওসিলায় আমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। কেন না হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছে, "আল্লাহ তাআলা বলেন, হে বনী আদম! তুমি যত গুনাহই কর, যতক্ষণ আমাকে ডাকতে থাকবে এবং আমার কাছে (ক্ষমার) আশা রাখবে আমি তোমার পূর্বের সব (গুনাহ) ক্ষমা করে দেব, কোনো পরোয়া করব না।
হে বনী আদম! তোমার গুনাহ যদি (এত বেশি হয় যে তা) আকাশের মেঘমালা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, অতপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি ক্ষমা করে দেব, কোনো পরোয়া করব না। হে বনী আদম! যদি তুমি শিরিক থেকে বেঁচে থাক, আর পৃথিবী-ভরা গুনাহও নিয়ে আস তাহলে আমি ঐ পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে উপস্থিত হবো।" জামে তিরমিজি, ৩৫৪০
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে তাঁর ইবাদত করিয়ে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে সুখময় জান্নাতের মালিক হিসেবে কবুল করুন আমিন।
লেখক: ইমাম ও খতিব, আদ্রা জামে মসজি। কসবা, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া।