সময় ২০১৪। এক দুপুরে হাজির হলাম কামড়াঙ্গিচর। জামিয়া নূরিয়া থেকে বন্ধু আকরাম হুসাইনের সহযোগীতায় খুজেঁ নিলাম পাহাড়পুরি হুজুর বাসভবন। হুজুর তখন অনেকটা সুস্থ। হুজুরের বড় ছেলে আশরাফ ভাই আমার নাম বলতেই চিনতে পারলেন।তখন একটি সাক্ষাৎকার নিলাম। হুজুরের নিজের ছাত্রজীবনের অনেক অজানা কথা বললেন। বিশেষ করে তার উস্তাদ শাইখুল হাদীস রহ. এর স্মৃতিচারণ করলেন। রাহমানী পয়গাম ২০১৪ এর র্মাচ সংখ্যায় সাক্ষাৎারটি ছাপা হয়েছিল।
পত্রিকা ছাপা হওয়ার পর আমি তখন কপি হুজুরের কাছে পাঠাতে পারিনি। এমন সময় একদিন সকালে হুজুরের সাহেবজাদা আশরাফ ভাই এর ফোন করলেন বললেন, আমি পত্রিকা দোকান থেকে কিনছি। আব্বাকে দেখাইছি। আব্বা বলছেন পড়ে শুনাইতে। আমি পুরা সাক্ষাৎকার আব্বাকে পড়ে শুনাইছি।আব্বা অনেক খুশি হইছেন। লেখাটা চোখের সাথে লাগাইছেন। মনভরে দোয়া দিছেন। বলছেন, আমার এমন অগুছালো কথাগুলো এহসান এত সুন্দর করে লেখছে..।
লেখাটা পড়ে আশরাফ ভাই নিজেও অনেক আনন্দিত হয়েছিলেন। হুজুরের এই অভিব্যক্তি শুনে সেদিন কি যে আনন্দ পেয়েছিলাম ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়।
পাহাড়পুরি হুজুর আজ আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন। হাজারো লক্ষ ছাত্র-ভক্তদের শোক সাগরের ভাসিয়ে চলে গেছেন মাওলার সান্নিধ্যে।
আজ শেষ বারের মত হুজুরকে দেখলাম। জানাযার খাটিয়া কাধে বহন করে ধন্য হলাম।বুকের সাথে জড়িয়ে রেখে দিলাম কবরে, শেষ ঠিকানায়...
[তৎকালিন সময়ে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি ভুমিকাসহ তুলে ধরা হলো।]
সময়ের প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসদের অন্যতম মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরি দা. বা.। হযরত হাফেজ্জি হুজুর রহ. এর জামাতা। হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর অত্যন্ত স্নেহের ছাত্র। শাইখুল হাদীস রহ. যখন নূরিয়ায় বুখারি আউয়ালের দরস দিতেন, তখন মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরি সেখানে বুখারি সানির শিক্ষক। নিজের পড়ানো শেষ করে এসে শাইখুল হাদীসের দরসে বসতেন, ছাত্রদের মতো ইবারতও পড়তেন। এভাবেই শাইখুল হাদীসের কাছে পাঁচ ছয় বার বুখারি পড়ার বিরল কৃতিত্ব অর্জনকরেন। হযরতের পিতাও ছিলেন একজন কামেল মানুষ, বড় কাটারার সাবেক মুদাররিস, হাফেজ্জি হুজুর রহ. এর খলিফা মাওলানা আখতারুজ্জামান রহ.। পাহাড়পুর মাদরাসায় মুহতামিম হিসেবে প্রায় ৭০ বছর দায়িত্ব পালন করেন। মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরি নিজ শিক্ষা জীবনে লালবাগ থেকে দাওরা শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাকিস্তান গমন করেন। সেখানে ফুনুনাতের ওপর একবছর পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক হিসেবে নূরিয়ায় যোগ দেন। সেখান থেকে জামিয়া মুহাম্মাদিয়া, জামিয়া রাহমানিয়া হয়ে বর্তমানে লালমাটিয়া জামিয়া ইসলামিয়ায় বুখারির দরস দিচ্ছেন। অসংখ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের সাথে নানা ভাবে যুক্ত থাকলেও বার্ধক্যের কারণে এখন তিনি অনেকটাই নীরব। আপনজনদের কাছে ইবাদত বন্দেগি করেই এখন তার সময় কাটে। সাক্ষাৎ প্রার্থীদের সাথে যৎসামান্য কথা বলেন। শাইখুল হাদীসের নাম বলতেই অনর্গল বলা শুরু করলেন স্মৃতি কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- মুহাম্মদ এহসানুল হক
আপনার শিক্ষা জীবনের সূচনা কোথায়?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: আমার শিক্ষা জীবনের সূচনা আমাদের গ্রামেই হয়েছে। পাহাড়পুর এমদাদুল উলুম মাদরাসায় আমি প্রথম দিকের জামাতগুলো পড়েছি।
ঢাকায় কবে কিভাবে আসলেন?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: ঢাকায় এসেছি ১৯৬৭/৬৮ সালের দিকে। লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়ায় তখন দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক আলেমে দ্বীন ছিলেন। হযরত হাফেজ্জি হুজুর রহ. শাইখুল হাদীস রহ. সহ আরও অনেকে। আমি আমার আব্বাজানকে বললাম, আমি মিশকাত দাওরা লালবাগে পড়তে চাই। আব্বা তখন আমাকে অনেকগুলো শর্ত দিলেন, বললেন, লালবাগে অনেক মুরুব্বিরা আছেন, হযরত হাফেজ্জি হুজুরকে মুরুব্বি বানিয়ে চলতে হবে। সমস্ত উস্তাদদের সাথে সুসস্পর্ক রেখে চলতে হবে। এ জাতীয় অনেকগুলো শর্ত দিলেন। আমি বললাম ইনশাআল্লাহ আমি পারবো। অনুমতি পেলাম। তার পর আমি ঢাকায় এসে মেশকাত জামাতে ভর্তি হলাম। মেশকাত আউয়াল হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর কাছে পড়লাম।
সেই সময়ের কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ে?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: হুজুরের দরসে আমি নিয়মিত এবারত পড়তাম। মাওলানা রফিকুল ইসলাম বাইতুল মুকাররমের যিনি ইমাম ছিলেন, তিনিও পড়তেন। আমরা দুজন এক সঙ্গেই বসতাম। ক্লাসে প্রথম দ্বিতীয় আমরা দুজনই হতাম। কখনো তিনি আউয়াল হতেন আবার কখনো আমি আউয়াল হতাম, এভাবেই চলতো। শাইখুল হাদীস রহ. চাইতেন দরসে আমিই যেন এবারত পড়ি। হুজুরের চাওয়া হিসেবে আমিই বেশি এবারত পড়তাম। এভাবে মেশকাত জামাতটা কেটেছে।
রাহমানী পয়গাম: শাইখুল হাদীস রহ. এর ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ হলো কী করে?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: মিশকাত জামাত শেষ করার পর হুজুর আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, রমজানে কোথায় থাকবে? আমি বললাম, রমজানে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এর কাছে থাকার ইচ্ছা করেছি। হুজুর বললেন, না যেও না। আগামী বছর দাওরা পড়বে। বুখারি শরিফ পড়বে। আমার কাছেই তো পড়বে। আমি কয়েক বছর যাবত বুখারি পড়াচ্ছি না। রমজানের পর থেকে ইনশাআল্লাহ আবার বুখারি পড়াবো। তুমি রমজানে আমার কাছে থাকো। সদর সাহেব হুজুরের কাছে অন্য সময় থেকো। হুজুরের কথায় আমি রাজি হয়ে গেলাম। ওই বছর রমজানে আর কোথাও গেলাম না, হুজুরের খেদমতে লালবাগ মাদরাসায় থেকে গেলাম।
রমজানের সময়টা কিভাবে কাটলো?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: হুজুর প্রতিদিন সকালে মাদরাসায় এসে দফতরে বাংলা বুখারির কাজ করতেন। হুজুর আমাকে বললেন তুমি রমজানে কী করবে? আমি বললাম, হুজুর আমাকে যা করতে বলবেন তাই করবো। হুজুর বললেন, আমার বাংলা বুখারির তো প্র“ফ দেখতে হয়, তুমি তো আগামী বছর বুখারি পড়বে, যদি বুখারির প্র“ফ দেখো তাহলে তোমার জন্য উপকার হবে। আমি তোমাকে প্রতিদিন প্র“ফ দেখার জন্য লেখা এনে দিবো। তুমি দেখে আমাকে দিয়ে দিবে। পরের দিন আবার দিবো। সেমতে হুজুর আমাকে বুখারির বঙ্গানুবাদের প্র“ফ এনে দিতেন, আমি সারা দিন রাত দেখে কাজ শেষ করে রাখতাম। পরের দিন হুজুরকে দিয়ে দিতাম, হুজুর তখন আমাকে আরও নতুন কতগুলো দিতেন। এভাবেই আমার বাংলা বুখারির কাজে শরিক হওয়ার সুযোগ হলো।
এরই মধ্যে একদিন হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আর কী করবে? আমি বললাম, আপনি যা করতে বলবেন তাই করবো। তবে আমার ইচ্ছা ছিল, কাশশাফের শরাহ আল ওয়াসসাফ আলাল কাশশাফ, যেটা মাওলানা ইদ্রীস কান্দলভি রহ. এর ছেলে মাওলানা মালেক কান্দলভি সাহেব লিখেছেন- সেটা প্রতিদিন একটু করে মুতালাআ করা। হুজুর শুনে খুব খুশি হলেন, বললেন তুমি তো ছাত্র, মাদরাসা থেকে তোমাকে কিতাব দিবে না। ঠিক আছে কিতাব আমি আমার নামে তুলে তোমাকে দিবো। হুজুর মাদরাসা থেকে কিতাব তুলে আমাকে মুতায়ালার জন্য দিলেন। আমি সারা রমজান সেটা পড়লাম। রমজান শেষ করার পর আবার হুজুরকে দিয়ে দিলাম।
বুখারির প্রুফ দেখলাম, ওয়াসসাফ মুতালাআ করলাম, হুজুরের খেদমতে থাকলাম এভাবে রমজানটা কাটলো।
রমজানে কি পরিমাণ সময় শাইখুল হাদীস রহ. মাদরাসায় থাকতেন?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: হুজুর সকাল সকাল মাদরাসায় চলে আসতেন। লেখার কাজ করতেন। প্র“ফও দেখতেন। কয়েক ঘণ্টা মাদরাসায় অবস্থান করতেন।
হুজুরের স্নেহের কোনো উদাহরণ যদি দিতেন?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: দাওরায়ে হাদিসের বছর প্রায় সময় আমি এবারত পড়তাম। অন্য কেউ এবারত পড়লে তিনি খুশি হতেন না। সবকের মধ্যেই বলতেন, আব্দুল হাই তুমি পড়। অন্য কেউ যদি পড়তো তাহলে সে কিছুক্ষণ পড়ার পর হুজুর বলতেন এবার আব্দুল হাই পড়–ক। হুজুরের কাছে সারা সপ্তাহ বুখারি পড়তাম। আর শুক্রবার আসলে ছাত্রদের নিয়ে লালবাগের বিভিন্ন মসজিদে তাকরার করতাম। হুজুর সারা সপ্তাহ যা পড়াতেন সেগুলো তাকরার করতাম।
তাকরার করতে মসজিদে যাওয়ার কী কারণ ছিল?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: মসজিদ নিরিবিলি হওয়ার কারণে তাকরার করতে সুবিধা হত। সঙ্গী সাথিদের নিয়ে তাকরার করতাম। লালবাগে এমন মসজিদ কম ছিল যেখানে গিয়ে আমরা তাকরার করিনি। হুজুরের তাকরির ক্লাসে লিখতাম। আর তাকরারে আমি সেগুলো আলোচনা করতাম। এভাবে বছরটা শেষ করলাম।
সেই সময়ের বিশেষ কোনো ঘটনা কি মনে পড়ে?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: আমি যেই বছর দাওরায়ে হাদিস পড়ছি সেই বছরেরই মাঝমাঝি সময়ে একবার আমার আব্বা ঢাকায় আসলেন। বললেন শাইখুল হাদীস সাহেবকে আমাদের মাদরাসায় দাওয়াত করবো। আব্বা আমাকে নিয়ে হুজুরের আজিমপুরের বাসায় গেলেন। আজিমপুরের বাসায় তখনও বিল্ডিং হয়নি। টিনের ঘর ছিল। আব্বা বাসার ভিতরে খবর পাঠালেন। আমাদের ভিতরে যেতে বলা হলো। আমরা ঘরে প্রবেশ করলাম। হুজুর তখনও বাংলা বুখারির কাজ করছিলেন। আব্বা হুজুরকে পাহাড়পুর মাহফিলের জন্য দাওয়াত দিলেন। হুজুর বললেন আলহামদুলিল্লাহ আমি তো দাওয়াত কবুল করলাম, কিন্তু আমি তো পাহাড়পুর চিনি না আমি যাব কী করে। তখন আব্বা আমাকে দেখিয়ে বললেন, আমার ছেলে আপনাকে নিয়ে যাবে। ও আপনার সাথে যাবে। হুজুর আশ্বস্ত হলেন।
মাহফিলের দিন আসলো। হুজুরকে নিয়ে আমি রওনা হলাম। নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত টেক্সি দিয়ে গেলাম। আমরা যখন ফরিদাবাদ মাদরাসার পাশ দিয়ে যাচ্ছি, তখন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফরিদাবাদ মাদরাসার একজন মুহাদ্দিস, তারও পাহাড়পুর যাওয়ার কথা। হুজুর তার প্রতি লক্ষ করেন নি। আমি তাকে দেখেছি, কিন্তু শাইখুল হাদীস সাহেবের সাথে যেহেতু আর কাউকে নিবো না তাই তাকে আমাদের টেক্সিতে উঠালাম না। তিনি এতে মনে কষ্ট পেলেন। আমি নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত হুজুরকে নিয়ে গেলাম। তিনিও নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত অন্য গাড়ি দিয়ে গেলেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত স্টিমার চলতো। ওই ইস্টিমারে আমি হুজুরকে নিয়ে উঠলাম। মাওলানা সাহেবও ওই স্টিমারে গিয়ে উঠলেন। তার মনে একটু কষ্ট, তাই সে হুজুরের সাথে দেখা করলেন না। কাছেও আসলেন না। দূরে গিয়ে বসলেন।
ব্যাপারটা শাইখুল হাদীস রহ. এর নজরে পড়লো। হুজুর বললেন, ওই মাওলানা সাহেব সেখানে কেন বসেছে? আমাকে বললেন, ওই যে মাওলানা সাহেব বসা সে আমার ছাত্র, তাকে আমার কাছে নিয়ে আসো। আমি গিয়ে তাকে বললাম, শাইখুল হাদীস সাহেব হুজুর আপনাকে স্মরণ করছেন। তিনি নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলেন। বললেন হুজুর কোথায়? আমি বললাম ওইখানে, তিনি এসে হুজুরের সাথে মুসাফাহা করলেন। বসলেন ও পুরো রাস্তা হুজুরের সাথে আসলেন। দাউদকান্দি পর্যন্ত আমারা পৌঁছলাম।
সেখানে পাহাড়পুরের অনেক ছাত্র এসেছিল হুজুরকে নেয়ার জন্য। দাউদকান্দি থেকে পাহাড়পুরে যাতায়াতের ভাল কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তখন রাস্তাও হয় নি। সেখান থেকে রিকশায় যেতে হতো। হুজুরকে একটি রিকশায় বসানো হলো। হুজুর রওনা হলেন। আর আমরা পিছনে পিছনে হাঁটছিলাম। কিছুদূর গিয়ে হুজুর রিকশা থামিয়ে পিছনের দিকে তাকালেন। বললেন আব্দুল হাই! তুমি হেঁটে গেলে আমি আর রিকশায় যাব না। আমি হুজুরকে অনেক করে না করলাম। কিন্তু হুজুরের এক কথা আমার সাথে রিকশায় বসতে হবে আর না হলে আমি নেমে যাব। এক পর্যায়ে হুজুর রিকশা থেকে নেমে যেতে উদ্যত হলেন। তখন আমি বাধ্য হয়ে হুজুরের সাথে রিকশায় উঠলাম। মাদরাসা পর্যন্ত গেলাম।
মাহফিলে হুজুর বয়ান করলেন। বয়ান শেষ করে রাত্রে মাদরাসায় ঘুমালেন। সকালে হুজুর ঢাকায় আসবেন। হুজুর আমাকে বললেন, তোমার বাসা কোথায়? আমি বললাম মাদরাসা থেকে একটু দূরে। হুজুর বললেন, তোমার বাসায় আমাকে নিয়ে চল। আমি তোমার বাড়িতে যাব। মাদরাসা থেকে আমাদের বাসায় হেঁটে যেতে হয়। রিকশাও যায় না। হুজুর হেঁটেই আমাদের বাসা পর্যন্ত গেলেন। আম্মা হুজুরের জন্য বিভিন্ন পদের খাবার রান্না করে রেখেছিলেন। হুজুরের সামনে খাবার পরিবেশন করা হলো। খাবার দেখে বললেন, আমি এই খাবার খাব না। শহরের খাবার পোলাও কোরমা আমি খাব না। এগুলোতো সব সময়ই খাওয়া হয়। আমি গ্রামের খাবার খাব। আমি দৌঁড়ে আম্মার কাছে গেলাম। বললাম, আম্মা হুজুরতো এই খানা খাবেন না, হুজুর গ্রামের খানা খেতে চাচ্ছেন। আম্মা বললেন আমি হুজুরের জন্য গ্রামের খানাও তৈরি করে রেখেছি। লাও চিংড়ি মাছ, দেশি চালের ভাত, এগুলোও আম্মা তৈরি করে রেখেছিলেন। হুজুর খুব খুশি হলেন। বললেন, এ গুলিই না আমার খানা। শহরের থেকে আমি গ্রামে আসছি শহরের খানা খাওয়াার জন্য? হুজুর খাবারা খেয়ে আবার মাদরাসায় গেলেন। হুজুর যখন রওনা হবেন তখন আব্বা হুজুরের হাতে গাড়ি ভাড়ার কথা বলে কিছু টাকা দিলেন। হুজুর টাকা গুলো গুণলেন। এরপর বললেন, এত টাকা তো গাড়ির ভাড়া হয় না। এখানে তো অনেক টাকা। এই কথা বলে ভাড়ার জন্য অল্প যে কয় টাকা লাগে সেটা রেখে বাকি টাকা আব্বার হাতে দিয়ে দিলেন। আর বললেন, ভাড়ার জন্য যতটুকু লাগে সেটা আমরা রেখেছি। বাকি টাকা আপনি মাদরাসার কাজে লাগাবেন।
আমরা হুজুরকে এগিয়ে দিলাম। এবার হুজুর আমাকে আর আনলেন না। আমাকে বললেন, তুমি তোমার বাবা মার খেদমতে থাকো। আমি একা যাব। তোমাকে আর কষ্ট দিবো না।
পড়া শেষ করে শিক্ষক হিসেবে কোথায় যোগ দিলেন?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: পড়া শেষ করার পর আমি নূরিয়ার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। আমি পড়াতাম বুখারি সানি। আর হুজুর পড়াতেন বুখারি আউয়াল। আমি তখন হুজুরের ক্লাসে নিয়মিত বসতাম। বুখারি সানি পড়িয়ে বুখারি আউয়ালের ঘণ্টায় গিয়ে বসতাম। আমি হুজুরের কাছে এভাবে পাঁচ বার বুখারি পড়েছি। তখনো আমি ছাত্রদের মতো এবারত পড়তাম।
হাফেজ্জি হুজুরের সাথে শাইখুল হাদীসের সম্পর্ক কেমন দেখেছেন?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: হযরত হাফেজ্জি হুজুর রহ. শাইখুল হাদীস রহ. কে ‘ফখরে বাঙ্গাল’ বলতেন। একদিন আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, তোমারা আজিজুল হক সাহেবকে কি বলে ডাকো? শাইখুল হাদীস? আমি বললাম জ্বি। হুজুর বললেন, কিন্তু আমি বলি- ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা আজিজুল হক সাহেব। শাইখুল হাদীস তো শুধুমাত্র যে ব্যক্তি হাদিসের খেদমত করেন তার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে তার বহুমুখী খেদমত, কুরআনের খেদমত, হাদিসের খেদমত, সিয়াসাতের খেদমত এই সব গুলোর জন্য তাকেই সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত মনে করি। এজন্য তাকে আমি বলি ফখরে বাঙ্গাল।
রাহমানিয়ায় যোগদানের ঘটনা একটু জানতে চাই।
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: সেই ১৯৯৫ সালের কথা। আমি তখন মুহাম্মদপুর জামিয়া মুহাম্মাদিয়ায় পড়াই। সেদিন বাস ধর্মঘট ছিল। আমি পায়ে হেটে কিল্লার মোড়ের দিকে ফিরছিলাম। আর হুজুর আজিমপুর বাসা থেকে যাচ্ছিলেন মুহাম্মদপুর রাহমানিয়ার দিকে। পথে হুজুরের সাথে আমার দেখা হয়ে গেল। সালাম দিলাম। হুজুর জানতে চাইলেন কোথায় যাও? আমি বললাম, কিল্লার মোড় যাব। এবার জানতে চাইলেন কোথায় পড়াও? আমি বললাম আমি তো জামিয়া মুহাম্মাদিয়ায় পড়াই। হুজুর বললেন তোমার আর মুহাম্মাদিয়ায় পড়াতে হবে না। এখন থেকে তুমি রাহমানিয়ায় পড়াবে। আমি বললাম রাহমানিয়ায় এসে কী পড়াবো? হুজুর বললেন বুখারি পড়াবে। বললাম হুজুরের হুকুম পালন করতে আমি খুশি মনে রাজি আছি। যোগ্যতা তো আমার মধ্যে মোটেই নেই। তবে হুজুর দোয়া করলে আল্লাহ তাউফিক দিবেন ইনশাআল্লাহ। এই আমি মুহাম্মাদিয়া থেকে রাহমানিয়ায় এসে পড়লাম। আমাকে বুখারি সানি দেয়া হল। আমি খেদমত শুরু করলাম। আমি ক্লাস করাতাম মাগরিবের পরে, আর হুজুর পড়াতেন দিনে।
একদিন মাগরিবের পরে হুজুর মাদরাসায় ছিলেন। আমি তখন ক্লাসে। হুজুর দাওরার রুমের সামনে বারান্দা দিয়ে হাঁটলেন। আমার ক্লাসের নমুনা দেখলেন। তারপর বললেন, আব্দুল হাই! তুমি পড়াতে থাকো। এতমিনানের সাথে পড়াতে থাকো। আমি আজকে তোমার দরস শুনেছি এবং দেখেছি। মাশাআল্লাহ তুমি পড়াও। হুজুর আমাকে সাহস দিলেন, হিম্মত দিলেন।
শাইখুল হাদীসের সাথে কখনো সফর করেছেন?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: হুজুরের সাথে আমি অনেক সফর করেছি। দেশের বাইরেও গিয়েছি। লন্ডন সফরের কথা মনে পড়ে। ইস্ট লন্ডন মসজিদে হুজুর মাগরিবের পর থেকে এশা পর্যন্ত বয়ান করলেন। হাফেজ্জি হুজুর সেখানে ছিলেন। আমিও ছিলাম। হুজুর হৃদয়গ্রাহী বয়ান করলেন, খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। হুবহু স্মরণ ছিলো, এখন তো স্মরণ শক্তি চলে গেছে তাই আর হুবহু মনে করতে পারি না। সেখান থেকে আরও অনেক জায়গায় গেলেন, বার্মিংহাম গেলেন, সেখানে আর আমি যাই নি। সেখানে সফর করে হুজুর আবার ফিরে আসলেন। এটা ৮৪/৮৫ সালের কথা।
ব্যক্তিগত যোগাযোগ কি সব সময় ছিল?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: হ্যাঁ ছিল, হুজুর আমার মিরপুরের বাসায় গিয়েছিলেন। আমার দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ের সময়। মাওলানা উবায়দুল্লাহ সাহেব এর ছেলে কাতারে থাকতো। সে দেশে আসলো, তাকে বিবাহ করাবে। পয়গাম দিলো। আমি রাজি হলাম। আমি হুজুরকে দাওয়াত দিলাম। মুফতি আমিনী সাহেবও গেলেন। আমার বৈঠকখানায় গিয়ে হুজুর বসলেন। হুজুরই বিবাহ পড়ালেন।
শেষ সাক্ষাৎ কবে করেছেন?
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: একবার রাহমানিয়ায় গেলাম, দোতলায় হুজুর যে কামরায় থাকতেন সেখানে গেলাম। গিয়ে বসলাম। হুজুর তখন আমাকে আপনি আপনি করে বলছিলেন। আমি বললাম হুজুর আমাকে আপনি করে বলছেন কেন, আমি তো আপনার ছাত্র। আমাকে তুমি করে বলেন। আমাকে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাস করলেন। আমাকে বসার জায়গা করে দিলেন।
অনেক কষ্ট করে আমাদের সময় দিলেন, আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী: তোমরাও আমার জন্য দোয়া করবে। এখন তো আমার শেষ সময়। সকালে বিকেলের আশা করি না, বিকেলে সকালের আশা করি না। সকলের কাছে দোয়া চাই।
আরআর