কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক: মুজাফফর আহমদ ওয়ানি। ভূস্বর্গ কাশ্মিরের একজন গর্বিত নাগরিক। তবে তাঁর এই গর্ব অর্জনের নয়; বিসর্জনের। দুই ছেলে এক মেয়ের জনক এই মুজাফফর। কোনো সংগঠনের সঙ্গেই জড়িত না থাকলেও প্রথম ছেলে খালিদ ওয়ানিকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ‘হত্যা’ করেছিল ভারতীয় বাহিনী। আর দ্বিতীয় ছেলে বুরহান ওয়ানি ছিলেন হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার, ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার প্রতিবিম্ব তিনি কাশ্মিরবাসীর কাছে। গত মাসের ৮ তারিখে সেই বুরহানকেও হত্যা করে ভারতীয় সেনারা। তবে এতে বিচলিত নন তাদের বাবা মুজাফফর। এতে বরং তিনি নিজেকে শহিদ ছেলে পিতা বলেই গর্ববোধ করছেন। খালিদ-বুরহানের একমাত্র বোনই এখন তার বেঁচে থাকা একমাত্র সন্তান। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবার সেই সন্তানকেও কোরবানি করতে রাজি আছেন বলে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছেন মুজাফফর।
প্রিয় পাঠক! বিস্ময় জাগছে না কি, কেন আদরের সন্তানদের একে একে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে একটুও বিচলিত হচ্ছেন না এই মুজাফফর? এই প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের ফিরে যেতে হবে নিকট ইতিহাসে এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বৈরি আচরণের দিকে। ২০১০ সালে আমরা দেখেছি, দীর্ঘ চার মাস ধরে কাশ্মিরে এবারের মতো উত্তপ্ত সংঘর্ষাবস্থা অব্যাহত থাকে। তখন প্রাণ হারায় ১১০ জন। এদের মধ্যে কাশ্মিরি তরুণের সংখ্যাই ছিল বেশি। এবারও উত্তপ্ত পরিস্থিতির সাথে প্রধানত সংশ্লিষ্ট রয়েছে কাশ্মিরের শিক্ষিত তরুণেরা। আগের বিপ্লবীদের চেয়ে এরা অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী ও স্বাধীনচেতা। কাশ্মিরের স্বাধীনতার জন্য এরা উদগ্রীব। এসব তরুণের সংখ্যা আগের তুলনায় অভাবনীয়ভাবে অনেক বেশি। এরা দক্ষিণ কাশ্মিরসহ পুরো কাশ্মির উপত্যকাকেই সশস্ত্র আন্দোলনের এক হটবেডে পরিণত করেছে। এরা ভ্রুক্ষেপহীনভাবে হামলা চালাচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশবাহিনীর ওপর। এই সশস্ত্র তরুণেরা ব্যাপক জনসমর্থনও পাচ্ছে। আসলে ১৯৮৯ সাল থেকে এদের প্রতি এই জনসমর্থন বেড়েই চলেছে। সেই সাথে কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী জন-আন্দোলনের তীব্রতাও বাড়ছে সমান গতিতে।
কাশ্মিরে ভারতের প্রতি আস্থাহীনতার অনুভব করা যায় মুজাফফরের অভিব্যক্তিতে এবং নিহতদের জানাজায় মানুষের ঢল দেখে। নিহত বুরহান ওয়ানি এখন কাশ্মিরজুড়ে এক পোস্টার বয়ে পরিণত হয়েছেন। ২৩ বছর বয়সী ক্রিকেটার সামির আহমদ ভাট। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাধ্য করা হচ্ছে তাদের প্রতি পাথর ছুড়তে। তারা আমাদের উসকে দিচ্ছে। যতক্ষণ তারা আমাদের ওপর তাদের নৃশংসতা বন্ধ না করবে আমি পাথর ছুড়ে যাবো।’
দেশের অন্য জায়গায় আন্দোলন হলে জলকামান ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। আর কাশ্মিরে ব্যবহার করা হয় বুলেট। গত কয়েক দিনে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে চোখ হারিয়েছে বেশ কিছু কাশ্মিরি তরুণ। মারাত্মকভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে দিন কাটাচ্ছে শত শত লোক। গত ৯ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে অন্তত ৫০ জন কাশ্মিরি এবং আহত হয়েছে তিন হাজার। আহতদের বেশিরভাগই চোখের কাছে জখম হয়েছে ভারতীয় হামলায়। অন্তত ৮০ জন আহত কাশ্মিরি যুবকের চোখে অস্ত্রোপচারের পর তাদের রেটিনায় ক্ষুদ্র স্টিল বুলেট পাওয়া গেছে। ব্রিটেনের দৈনিক গার্ডিয়ান লিখেছে, ভারতীয় সেনারা এভাবে ইচ্ছা করেই প্রতিবাদী কাশ্মিরি যুবকদের অন্ধ করে দিচ্ছে। অথচ এসবের কোনও বিচার হচ্ছে না। ক্ষুদ্র বুলেট অপসারণের জন্য এক সপ্তায় প্রতিবাদী কাশ্মিরি যুবকদের ১৫০ টি চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এদের বেশিরভাগই দৃষ্টি শক্তি হারাবেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। একজন ডাক্তার বললেন, এদের অবস্থা মৃত্যুর চেয়েও খারাপ।
একই সময়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কাশ্মিরে বন্ধ করে দিয়েছে বহু সংবাদপত্র এবং সংবাদ প্রকাশের ওপর আরোপ করেছে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা। এ ছাড়াও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কাশ্মিরে কারফিউ বা সান্ধ্য আইনও জারি করে রেখেছে এক সপ্তারও বেশি সময় ধরে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানমালা, ইন্টারনেট ও টেলিফোন নেটওয়ার্ক। কাশ্মিরে নৃশংস দমন অভিযানের খবর প্রচার করা হলে সেখানে গণ-বিক্ষোভ আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
এমন পরিস্থিতিতে ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মিরে বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের জন্য ভারতের বিরোধী দলগুলো মোদি সরকারের সমালোচনা করেছে। ভারতীয় কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী সম্প্রতি পার্লামেন্ট অধিবেশনের ফাঁকে বলেছেন, ‘সরকার যেভাবে আনাড়ির মতো সেখানকার বিক্ষোভ মোকাবেলা করছে তাতে মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করতে পারে।’ জম্মু ও কাশ্মিরে মোদি সরকারের নীতি নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই সমালোচনা করে আসছে ভারতের বিরোধী দলগুলো। বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধে সরকারের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে তারা। তবে প্রথমবারের মতো বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা বললেন সোনিয়া গান্ধী। কংগ্রেস নেত্রী আরো বলেন ‘এখানকার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বেদনাদায়ক এবং এটি দেশের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে আপস করার সুযোগ নেই। জঙ্গিদের অবশ্যই কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। তবে তার আগে আমাদের যাচাই করে দেখা দরকার, কেন অসংখ্য তরুণ আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে। আমরা কি কখনোই তাদের অভিযোগের প্রতি যথাযথ দৃষ্টি দিয়েছি।’
এ দিকে নেবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারত সরকার যেভাবে আনাড়ির মতো কাশ্মিরের সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খলা মোকাবেলা করেছে তাতে এই অঞ্চলটি পশ্চিমাদের কাছে ভারতীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় কলঙ্ক হিসেবে প্রতিফলিত হবে। ভারতীয় সংবাদপত্র ইন্ডিয়া টুডের সাথে আলাপে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘এটি ভারতীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় কলঙ্ক। এ বিষয়ে কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই। বিদেশীদের কাছে এটি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। পুলিশি বর্বরতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে সিএনএন দীর্ঘ রিপোর্ট প্রচার করেছে।’
কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দেয়ার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গিয়ে ভারতের প্রতিটি সরকার কাশ্মিরকে ভারতের দখলে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিন্তু সময়ের সাথে ভারতকে কাশ্মির প্রশ্নে কঠিন থেকে কঠিনতর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কাশ্মিরে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এরই বড় প্রমাণ। কাশ্মিরে হাজার হাজার মানুষ হত্যা, গুম, গণধর্ষণ চালিয়ে ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক আইন প্রয়োগ করেও সেখানকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পাছে না ভারত। সেখানে আজ আবিষ্কার হচ্ছে নানা গণকবর। এটি বহু আগেই প্রমাণ হয়ে গেছে, ভারত কাশ্মির শাসন করছে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। কাশ্মিরের জনগণের সাথে বিশ্ববাসী মনে করে, কাশ্মিরে চলছে অবৈধ দখলের শাসন।
কাশ্মিরের তরুণ রাজনীতিবিদ সালমান সাগর (৩৬)। তিনি বলেন, ‘এটা শুধু বুরহান ওয়ানির হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত নয়। আরো অনেক ইস্যুই এর সঙ্গে জড়িত। বর্তমান সরকার আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দুঃখজনক হলেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে।’ তিনি জানান, এক দশকে এই প্রথম এত লোক মারা গেল। তরুণরা একটি রাজনৈতিক সমাধান চাচ্ছে। শিতি তরুণরা স্বাধীনতার পথ বেছে নিচ্ছে। বুরহানও একটি শিক্ষিত পরিবার থেকে এসেছিলেন। শুধু একটি সমাধানের আশায় তরুণরা অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে। এটাকেই তারা একমাত্র সমাধান মনে করছে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই জম্মু ও কাশ্মির ১৮৪৬ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি প্রিন্সলি স্টেট, যা শাসন করত রাজপুত ডুগরা রাজারা। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যে নামেমাত্র সার্বভৌম স্টেটগুলোকে বলা হতো প্রিন্সলি স্টেট বা ন্যাটিভ স্টেট। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর জম্মু ও কাশ্মির স্টেট গঠন করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর সাথে কাশ্মির উপত্যকাকে সংযুক্ত করে গোলাব সিংয়ের কাছে হস্তান্তর করেন ৭৫ লাখ রুপির ইনডেমনিটি পরিশোধের বিনিময়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হয়। তখন এই রাজ্যে মুসলমানেরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এই স্টেট ছিল অমুসলিম মহারাজা হরি সিংয়ের শাসনাধীনে। তখন প্রশ্ন দেখা দেয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জম্মু ও কাশ্মির কার পক্ষে যোগ দেবে পাকিস্তানের পক্ষে, না ভারতের, না এ দুই দেশের কোনোটির সাথে সংযুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষ স্বাধীন কাশ্মির রাষ্ট্র গঠন করবে? এ নিয়ে নানা বিশৃঙ্খলা চলার মধ্য দিয়েই মহারাজা হরি সিং সামরিক সহায়তার বিনিময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই রাজ্যকে ভারতীয় ডোমিনিয়নে যোগ দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর। এ নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই রাজ্যের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পাকিস্তানের হাতে, যা আজ আজাদ কাশ্মির ও গিলগিটস্তান নামে পরিচিত। একাংশ চলে যায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে, যা ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, কাশ্মিরের ২০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চীনের হাতে, যা আকসাই চীন নামেও পরিচিত।
আজকে জম্মু ও কাশ্মির হাইকোর্ট বলছে, জম্মু ও কাশ্মির ভারতের কোনো অংশ নয়। ২০১০ সালের দিকে ভারতের স্পষ্টবাদী লেখিকা অরুন্ধতী রায় ঠিক একই কথা বলেছিলেন ‘কাশ্মির ইজ নট অ্যা পার্ট অব ইন্ডিয়া’। এই সত্য উপলব্ধির ওপর ভর করে ওই সময় নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন ‘কাশ্মির শুড গেট আজাদি ফ্রম ভুখে নাঙ্গে ইন্ডিয়া।’ সুতরাং একথা আজ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, কাশ্মিরের জনগণ চায় আজাদি। তারা ভারত কিংবা পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত হতে চায় না। আমরাও আশা করবো যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা কাশ্মিরিদের আজাদী আন্দোলনের মর্মার্থ অনুধাবন করে চিরবৈরি দেশ দু’টি সময়োচিত ও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে কার্পণ্য করবে না।
আবার ফিরে আসি মুজাফফরের গল্পে। এ বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মুজাফফর আহমদ বলেছিলেন, ‘আমি বুরহানের লাশের জন্য অপেক্ষা করছি। একজন স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে সাত বছরের বেশি বাঁচে না। বুরহানের ছয় বছর হয়ে গেছে। এবার তার যাবার সময় হয়েছে।’
শেষ হয় বাবার অপেক্ষা। বুরহান বিগত ইতিহাস হয়ে যায়। বুরহানের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় বাবা মুজাফফর ওয়ানি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘তার ছেলে শহিদ হয়েছে’, তিনি বলেন, আল্লাহ আমাদের বলেছেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তারা মরে না, শহিদ হয়।’
এফএফ