মুসা আল হাফিজ; অতিথি লেখক, আওয়ার ইসলাম
বিশাল কলেজ, পনেরো-বিশ হাজার ছাত্র। উন্নত সুযোগ-সুবিধা সবই আছে। প্রতিটি বিভাগই সচল। অচল কেবল লাইব্রেরিটি। শতাধিক বছর ধরে সঞ্চিত হাজার হাজার গ্রন্থের যে বিশাল লাইব্রেরি মুখর থাকার কথা ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদের পদচারণায় , সেই লাইব্রেরি মৃতপ্রায়।সিলেট এম সি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি অবহেলা, অপমান ও লজ্জায় ম্রিয়মান।
শত বছরের ঐতিহ্য সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থাগারসমূহের একটি এই জামেয়ায়। কিন্তু আজ যদি দেখেন লাইব্রেরিটি, চোখ কচলাবেন। এ কী লাইব্রেরি না ভূতুড়ে নিবাস। মাকড়শার জাল, ধুলোর আস্তরণ, কোনো মানুষের ছোঁয়া যেনো লাগেনি বহুদিন। কিন্তু কেন? লাইব্রেরিকে মেরে ফেলে কোনো শিক্ষাগার বাঁচে কীভাবে? শিক্ষকরা খোরাক পান কোথায়? ছাত্ররা কোথায় নিবারণ করে জ্ঞানতৃষ্ণা? ভার্চুয়াল? না, ভার্চুয়াল লাইব্রেরির বিকল্প হয়ে গেলে পশ্চিমাবিশ্বে লাইব্রেরির মৃত্যু হতো বহু আগেই। সেখানে ছাত্ররা লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরিতে কাটাচ্ছে দিনের পর দিন, শিক্ষকরাও! চীন, জাপান কিংবা ইসরাইলে একই চিত্র। কিন্তু আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ধারণা, পশ্চিমাধরণের পোশাক, নৈতিকতার প্রতি অবজ্ঞা, স্বকীয় ঐতিহ্য পরিহার ও বিয়েবহির্ভূত নারী-পুরুষের মেলামেশা ইত্যাদির প্রশ্নে দায়িত্বহীন হলেই বোধ হয় পশ্চিমাদের মতো জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় প্রাগ্রসর হওয়া যাবে। অথচ জ্ঞানের প্রতি অদম্য আকর্ষণ ও নিরন্তর সাধনাই কেবল একজন মানুষকে এই অঙ্গণে এগিয়ে দিতে পারে। এই আকর্ষণ তৈরি ও সাধনার পথনির্মাণ শিক্ষাগারের দায়িত্ব। কিন্তু সে দায়িত্ব প্রকৃতঅর্থে আদায় করছে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়? এই আদায় না করার লজ্জাজনক প্রদর্শনী হচ্ছে লাইব্রেরি সমূহের বিপন্নদশা।
বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ ও প্রধান এক আলীয়া মাদ্রাসার লাইব্রেরি শুধু এদেশে আমাদের জ্ঞানসাধনার দারিদ্রের কথা জানাচ্ছে না, বরং অধিকাংশ মুসলিমরাষ্ট্রের জ্ঞানতাত্ত্বিক চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে এর চেহারায়! শিক্ষার্থীরা যে নিখিলের জ্ঞানরাজ্যে অবদান রাখবে, এজন্য তাদের তৈরি করা হচ্ছে না মোটেও! পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন-এ গত ৪ জুলাই প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন শুরু হয়েছে এই দুঃখবোধের সঙ্গে যে বিশ্বের ১৬০ কোটি মুসলমান, যারা ৫৭টা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী, বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারে তাঁদের অবদান লজ্জাজনকভাবে কম। শতাধিক বছরের ইতিহাসে বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মাত্র তিনজন মুসলমান বিজ্ঞানী। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও ওআইসির সদস্যদেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা গুটি কয়েক। ২০১৪-২০১৫ বছরের কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্র্যাংকিংয়ে শীর্ষ ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মুসলিম বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। শীর্ষ ৪০০টির মধ্যে আছে মাত্র ১৭টি; ৩০০ ও ৪০০-র মধ্যে আছে মাত্র ১১টি।
মুসলিম বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা হয় খুবই কম, গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ করা হয় কম, দক্ষ শিক্ষকের অভাব প্রকট এবং বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়ানোর ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কল্পনা, সৃজনশীলতা ও বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি হয় না। বিজ্ঞান শিক্ষাদানে অত্যন্ত সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর পাশাপাশি দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব ইত্যাদি পড়ানো হয় না। এমনকি বিজ্ঞানের ইতিহাসও তাদের পাঠ্যতালিকায় থাকে না। বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে এই সংকীর্ণ পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গির ফলে শিক্ষার্থীদের মনে বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ, কৌতূহল, অনুসন্ধিৎসা তৈরি হয় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, খণ্ডিতভাবে বিজ্ঞান পড়ার ফলে চিন্তাপদ্ধতি হয় অবৈজ্ঞানিক। বৈজ্ঞানিক চিন্তাপদ্ধতির মূল কথা জিজ্ঞাসা বোধ করা এবং সেই জিজ্ঞাসার উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে অভিজ্ঞতাপ্রসূত তথ্য-উপাত্ত (এমপেরিক্যাল ডেটা) ব্যবহার করা। বিজ্ঞানের সঙ্গে দর্শন, ইতিহাস ও লিবারাল আর্টসের সমন্বয় সাধনের ফলে যে নমনীয় (ফ্লেক্সিবল) ও উদার (লিবারাল) মনোভঙ্গি তৈরি হয়, মুসলিম বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তার প্রকট অভাব রয়েছে।
হায় ! যে জাতির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান ও চেতনার গুরুস্তান হয়ে যায়, যে জাতির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজের লাইব্রেরিতে ফেলে দেয় ধুলোর আস্তরণ; সে জাতিকে কে উদ্ধার করবে ইতিহাসের আস্তাকুড় থেকে?
লেখক: কবি কলামিস্ট ও গবেষক