সাঈদ কাদির; আওয়ার ইসলাম
মুহিব খান। উপনাম, তাকরীম খান। উপাধী, জাগ্রত কবি। সীমান্ত খুলে দাও, ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি, এ মেরা ওয়াতান ও দাস্তানে মুহাম্মাদের মতো কালজয়ী সব এ্যালবামের সবগুলো সঙ্গীতের রচয়িতা, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী তিনিই। একই সাথে তিনি আলিম ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিপ্রাপ্ত। প্রায় দু'দশক ধরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর সগৌরব পদচারণা। বাংলদেশে ইসলামের তাহযীব ও তামাদ্দুনকে কবিতা ও গানের মাধ্যমে বিকশিত করার প্রয়াস পেয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর কাব্য-প্রতিভাকেও একদম খাটো করে দেখার উপায় নেই। কারণ, তিনি পৃথিবীর সর্বমৌলিক গ্রন্থ আল-কুরআনের কাব্যনুবাদ পর্যন্ত করেছেন বেশ কয়েক পারার।
গত দুই দশকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কবিতা ও গানের প্রবর্তক মুহিব খান। একটি নতুন ধারা নির্মান করে দেশময় সাড়া ফেলে দিয়েছেন।
সুবোধজাগানিয়া কাব্য ও সঙ্গীতচর্চার মাধ্যমে জাগ্রত কবি মুহিব খান অর্জন করে নিয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। বিশেষ করে কওমী মাদরাসা সংশ্লিষ্ট ও ধর্মীয় গান-কবিতায় রসবোধ আছে, এমন প্রায় সব মানুষের কাছেই তিনি সমাদৃত। কারো কারো কাছে অনুসরণীয়। অনেক তরুণেরই আদর্শ হবার যোগ্যতা পর্যন্ত অর্জন করে নিয়েছেন মধ্যবয়সী এই মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
পারিবারিক দিক থেকেও তিনি সমাদর ও সম্মান পাবার দাবিদার। কিশোরগঞ্জের এক অভিজাত ও সুঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা মাওলানা আতাউর রহমান খান সেকালের সাংসদ ছিলেন। এছাড়াও মাওলানা আতাউর রহমান খান একাধারে একজন জাতীয় পর্যায়ের বিশিষ্ট আলেম, রাজনীতিবিদ, সফল বাগ্মী, চিন্তাশীল লেখক, আদর্শ সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী এবং সুতীক্ষ্ণ চিন্তার অধিকারী সংগঠক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
কর্মজীবনে তিনি ইসলাম, দেশ ও জাতির কল্যাণার্থে বহুমুখী দায়িত্ব ও খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান আল জামেয়াতুল ইমদাদিয়ার সাথে প্রায় শুরু থেকে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। দীর্ঘ ৪২ বছর পর্যন্ত তিনি এর বিভিন্ন দায়িত্বে থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে খ্যাতির শীর্ষে তুলে আনতে বিরাট ভূমিকা রাখেন। ১৯৯১ সালে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে বিএনপির টিকিটে তিনি বিপুল ভোটে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন।
শোনা যাচ্ছে মুহিব খান নাকি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা-ভাবনা করছেন। অনেকেই তাঁর এই সিদ্ধান্তকে উচিত পদক্ষেপ বলেও মন্তব্য করছেন। তাঁকে কাজ চালিয়ে যাবার পরামর্শ দিচ্ছেন। আবার অধিকাংশ রাজনীতিসচেতন মানুষই তাঁর এই সিদ্ধান্তকে অপরিণামদর্শী বলে মতামত ব্যক্ত করছেন। তাঁদের যুক্তি হলো, তিনি আপাদমস্তক একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ। তিনি গান-কবিতা ভালো বোঝেন। এক্ষেত্রে তাঁর কৃতি ও সুনামেরও অভাব নেই। কিন্তু তিনি রাজনীতিসচেতন হলেও এক্ষেত্রে তাঁর পূর্বঅভিজ্ঞতা বা দূরদৃষ্টি নাই।
মুহিব খানের নতুন এই সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণকারীদের তাঁদের স্বপক্ষে আরো জোরালো যুক্তি হচ্ছে, মুহিব খানের পিতা সাংসদ হবার আগে দীর্ঘদিন নেজামে ইসলাম পার্টির সাথে কাজ করেছেন। তিনি মাঠে ময়দানে কাজ করে গণমানুষের হৃদয় জয় করেছেন। সমাজের মানুষের সাথে মিলেমিশে কাজ করেছেন। সমাজের মানুষ তাঁকে নিজেদের মানুষ বলেই মনে করেছে। তাঁকে সুখে-দুঃখে কাছে পেয়েছে। তাঁর কাছে মনের কথা বলবার সুযোগ পেয়েছে। তিনি সমাজের মূলস্রোতের মাঝে অবগান করে সমাজের নেতিবাচক বিষয়গুলোর ইতিবাচক সমাধান দান করার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ তাঁকে চিনেছে। জেনেছে। তাঁকে নিজেদের মানুষ ভেবেছে। তাঁকে সমাজের মূলস্রোতের একজন মাটির মানুষ হিসেবে কাজকর্ম করতে দেখেছে। তার পরে তিনি সাংসদ হয়েছেন। সে বিবেচনায় মুহিব খানের সাধারণের সাথে ওই সম্পর্কটা যদি থাকতো, তিনি যদি গণমানুষের কাছে রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত হতে পারতেন, সাংসদ না হলেও কমছে কম দুএকটা সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতেন, তার মোটামুটি ধরনের পাবলিক সাপোর্টও থাকতো। তাহলে তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা-ভাবনা করতে পারতেন। এ ময়দানে সফলতাও পেতে পারতেন।
তাঁর যে জনপ্রিয়তা আছে, এটি তাঁর রাজনীতিক হিসেবে নয়। তাঁকে সাধারণ মানুষ চেনেও কম। তিনি নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠির কাছে পরিচিত ও সমাদৃত। হয়তো দেশের বিশ পার্সেন্ট লোক তাকে চেনে। এর মধ্যে আবার বিভিন্ন দলের কর্মীসমর্থক রয়েছে। সুতরাং বোঝা যায়, তিনি দল গঠন করলে তাঁকে গ্রহণ করবেন, বা নির্বাচনে অংশ নিলে ভোট দিবেন, এমন জনসংখ্যার পরিমাণটা খুবই নগণ্য হবে।
অনেকেই বলছেন যে, আমরা ডক্টর কামালের মতো একজন পোড়খাওয়া ও আন্তর্জাতিক মানের রাজনীতিবিশ্লেষকের রাজনৈতিক দল গঠনের নজীর সামনে আনতে পারি। তিনি উচ্চ মাপের একজন আইনজীবি, আন্তর্জাতিক মানের বুদ্ধিজীবী ও কিংবদন্তীতুল্য সংবিধানবিশ্লেষক হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতিতে এসে লজ্জাকর একটি হোচট খেয়েছেন। কারণ তিনি হঠাৎই রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন যে, আমি বড় ধরনের একজন আইনবিশেষজ্ঞ। বিশ্বমানের সংবিধানবিশ্লেষক। সুতরাং আমি রাজনীতিতে আসলে আমার এই ইমেজটা কাজে লাগবে। আমার এই পরিচিতিটা আমাকে জনসমর্থনে সাহায্য করবে। কিন্তু ড. কামালের ধারণা ও উচ্চাশা চূর্ণ হয়ে গেছে। তিনি মানুষের কাছে আরো বেদামী হয়ে পড়েছেন। দেশের সব মানুষ তাঁকে গালমন্দ করেন। এখান থেকেও মুহিব খান সবক নিতে পারেন। জাগ্রত কবিও হয়তো ভাবছেন যে, আমার বাবা রাজনীতিক ছিলেন। সাংসদ ছিলেন। আমি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। সুতরাং আমার একটা জনমত আগে থেকেই তৈরি আছে। আমি দল গঠন করলে ভক্ত-অনুরাগীরা আমাকে সমর্থন দেবে। অথচ অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক ইতিহাস একথা প্রমাণ করে যে, সমাজের একদম নাড়ি থেকে জনপ্রিয়তা অর্জন না করতে পারলে রাজনীতিতে সফল হওয়া যায় না। এছাড়া তাঁর বাবার সঙ্গে তাঁর কোন তুলনাই চলে না। কারণ তাঁর বাবা সুদীর্ঘকাল রাজনীতির সাথে কার্যকরীভাবে সক্রিয় ছিলেন। তারপরেও নিজ পার্টি নেজামে ইসলামের টিকিটে তিনি সফলতা পান নি। বরং বিএনপির টিকিটে তিনি সাংসদ হবার গৌরব অর্জন করেছিলেন। একথাও বলে রাখা ভালো যে, মাওলানা আতহার আলী খানের মৃত্যুর পরে নেজামে ইসলাম পার্টি নানা কারণে কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার পরেও মাওলানা আতাউর রহমান খান নিজে কোন রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন না। বরং অন্য দলে যোগ দিয়ে সাংসদ হতে পেরেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর ছেলে মুহিব খান বাবার রাজনীতিদর্শন থেকেও শিক্ষা নিতে পারেন। বড়জোর তিনি যদি বিদ্যমান কোন দলে ভেড়েন। সেখান থেকে রাজনীতিতে নিজেকে মেলে ধরতে পারেন। তবে আস্তে আম্তে রাজনীতির মাঠে তাঁর একটা চাহিতা তৈরি হতে পারে। ভারতের কেজরিওয়ালকে দেখে যারা ক্রাশ খেয়েছিলেন, তারাই কিন্তু পরবর্তীতে বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, তাঁর হঠাৎ উত্থানই তাকে কালের লজ্জাজনক অধ্যায়ে জায়গা করে দিয়েছে। রাজনীতেত আসতে হলে ধৈর্য-সহ্যেরও দরকার হয়। কিন্তু মুহিব খান সাম্প্রতিক একটি ইস্যুতে প্রমাণ দিয়েছেন যে, তিনি চরম অধৈর্য ও অসহিঞ্চু। তিনি নিজের শিল্পের গঠনমূলক সমালোচনা পর্যন্ত সহ্য করতে পারেন না। তাঁর সর্বশেষ সঙ্গীএ্যালবাম 'দাস্তানে মুজাম্মাদ'-এ মিউজিক ট্রাক ব্যবহার করে তিনি বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন। তখন তিনি রেগেমেগে সমালোচকদের একহাত নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, 'আমার গান পছন্দ না হলে তারা যেন বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোন মুহিব খানের জন্ম দেয়'। বিষয়টি প্রমাণ করে যে, তিনি বালোকোচিত স্বভাব প্রদর্শন এখনো ছাড়তে পােরন নি। এহেন অধৈর্য ও অসহিঞ্চু মানুষ রাজনীতিতে আসলে নিজ দলের কর্মীসমর্থকদের সাথে বনিবনা হয় কিনা, এটিই চিন্তার বিষয়! সুতরাং জাগ্রত কবি খ্যাত মুহিব খানের কাছে আমাদের দাবি থাকবে -- আপনি আমাদের অহংকার। আপনি আমাদের সম্পদ। আমরা আপনার শুভ ভবিষ্যত চাই। আপনার বিফলমনোরথ কোন মলিন চেহারা দেখতে আমরা প্রস্তুত নই। যা করবেন, যে সিদ্ধান্ত নেবেন -- সেটা যেন আপনার নিজের অবনতি ডেকে না আনে। আশা করি বিষয়টা ভেবে দেখবেন।
এইচএ