আবু তাহের; আওয়ার ইসলাম
মিয়ানমারের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করছিল শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি’র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বা এনএলডি। ঐতিহাসিক এজন্য যে দীর্ঘ ২৫ বছর পর এই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচেনে পরাজিত হয়েছে দীর্ঘদিনের সেনাসমর্থিত ক্ষমতাসীন দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা ইউএসডিপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তাই উ। আর গত ২৫ বছরের মধ্যে দেশটিতে সবচেয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কিন্তু এই নির্বাচনে সু চি’র বিজয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভাগ্যের কি পরিবর্তন ঘটবে? কারণ দেশের ৩০ লাখ মুসলমান এই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। নিতে পারেনি বললে ভুল হবে। তাদেরকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হয়নি। অনেকটা জোড় করেই তাদেরকে উপেক্ষা করা হয়েছে। আর সু চি এখন পর্যন্ত এই রোহিঙ্গা মুসলমান ইস্যুটি সমাধানের বিষয়ে স্পষ্ট কোন বক্তব্য দেননি। তিনি এ বিষয়ে ‘ধীরে চলো নীতি’ অনুসরণের পক্ষে।
দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, রাতারাতি রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেছিলেন, এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ইস্যু। এর সঙ্গে অনেক জাতিগত এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী জড়িয়ে রয়েছে। তার মতে, এক গোষ্ঠীর জন্য কিছু করতে গেলে অন্য গোষ্ঠীগুলোর ওপর তার প্রভাব পড়বে। এ কারণেই রোহিঙ্গা সঙ্কটটি অত্যন্ত জটিল পর্যায়ে রয়েছে। এটাকে যদি সু চির রাজনীতির সুক্ষ্ম কৌশল ধরা হয় তবে হয়ত ভুল হবে না। কারণ রাখাইন প্রদেশের বড় শহর সিউইর আশপাশের ২০টি আশ্রয় শিবিরের এক লাখ মুসলিমের মধ্যে মাত্র ১৫০ জন্য ভোটের জন্য যোগ্য বলে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। তারও আবার তারা গোলাপী রঙের পরিচয়পত্রধারী।
কিন্তু সু চির দলকেই সর্বাগ্রে প্রধান্য দেয় দেশটির মুসলমানরা। কিন্তু সু চি কতটুকু তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে! সম্প্রতি মুসলমানদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সংগঠনটি বাঙালিবিরোধী আন্দোলন বলছে। সংগঠনটির এসব বিদ্বেষ ও হিংসাত্মক কর্মকা- দমন করতে না পারায় দেশটির মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরকারের কঠোর সমালোচনা শুরু করেছে। তারা অভিযোগ তুলেছে, সরকার মানবিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অং সান সুচির সরকার নড়েচড়ে বসেছে। প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের ধর্মমন্ত্রী উগ্রবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আর ইসলামবিরোধী ঘৃণ্য বক্তব্য না দেয়। অং সান সুচিও গত মাসে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি নিষিদ্ধ করার দাবী জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যের মুসলিম গোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করতে। যদিও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তার এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে এবং রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করে ঘৃণামূলক প্রচারণা শুরু করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ধর্মমন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন।
দেশটির প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই রাখাইন প্রদেশ তথা সাবেক আকিয়াব অঞ্চলে বাস করে। পিতদের মতে রাখাইন বা আকিয়াব অঞ্চলে আট শতক থেকে রোহিঙ্গা বসতি শুরু। সপ্তদশ শতকে তাদের অভিবাসন এবং বসতি স্থাপন বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে তারা সেসব দেশের পূর্ণ নাগরিক। শুধু বার্মার উগ্রজাতীয়তাবাদী সামরিক সরকার ১৯৮২ সালে পাসকৃত একটি নাগরিকত্ব আইন বলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বঞ্ছিত করে। তাদের যুক্তি হলো রোহিঙ্গারা বাঙালি। ১৮২৩ সালের পর তারা বার্মায় এসেছে এবং তাই তারা নাগরিকত্ব পাবে না। অর্থাৎ দেড়শ থেকে পৌঁনে দুইশ' বছর একটি দেশে বসবাস করলেও নাগরিকত্বের দাবিদার হবে না। এই অদ্ভুত এবং অমানবিক আইনের বলে আজ রোহিঙ্গারা নিজ দেশে পরবাসী এবং চরম নৃশংসতার শিকার। বার্মায় প্রায় অর্ধশতাব্দী যাবত বহাল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দীর জীবনযাপন করেছেন। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন এবং গৃহবন্দীর জীবনযাপনের জন্য তিনি ১৯৯১ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু সামরিক সরকারের প্রতিবন্ধকতার কারণে ২০১২ সালে তিনি নিরাপদে দেশ ছেড়ে পুরস্কারটি গ্রহণের সুযোগ পান। পুরস্কার গ্রহণকালে তিনি যে বক্তৃতাটি দেন, তার কথাগুলো ছিল এরকম- ‘নোবেল কমিটি আমাকে এই শান্তি পুরস্কারের মাধ্যমে এটাই স্বীকৃতি দিল যে বার্মার অত্যাচার ও কোণঠাসা মানুষও এই বিশ্বের অংশ। এর মাধ্যমে বিশ্ব মানবতার অভিন্নতা ও ঐক্যের স্বীকৃতিও পাওয়া গেল। সুতরাং আমার জন্য এই পুরস্কার গ্রহণের অর্থ হলো গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য আমার উদ্বেগ জাতীয় সীমানার বাইরে সম্প্রসারিত করে দেয়া। নোবেল পুরস্কার আমার মনের একটি দরজা খুলে দিয়েছে।'
আমরা বিশ্ববাসীও আশা করেছিলাম তেমনটিই হবে। কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সেরকম কোন পদক্ষেপই লক্ষ করা যায়নি। আরও মজার বিষয় হলো, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সু চিকে এগিয়ে আসার জন্য বলেছিলেন তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামা। ২০১২ সালের জাতিগত দাঙ্গার সময়ও তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন সু চিকে। কিন্তু এক অদৃশ্য কারণে বরাবরই নিশ্চুপ ছিলেন সু চি। আর এই বিষয়টি উদ্বেগের। কিন্তু বর্তমানে মানবধিকার সংগঠনদের সমালোচনার কারণে সরকার কিছুটা নড়েচড়ে বসেছেন। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দল এনএলডি আনুষ্ঠানিকভাবে দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এমনকি দলগুলোর নেটওয়ার্ক নিষিদ্ধ করার কথাও ভাবছে। দেরিতে হলেও মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশার বিষয়টি উপলব্ধি করেছে এটাই হয়ত আশার আলো। রোহিঙ্গারা যে সে দেশেরই নাগরিক এবং সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে, সরকারের এ চিন্তা-ভাবনা ও উদ্যোগ গ্রহণকে আমরা স্বাগত জানাই। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য অং সান সুচির দাবীর প্রতিও একাত্মতা প্রকাশ করছি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের অভ্যন্তরে জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক দন্দ্ব বিরাজমান রেখে কোনো দেশই ভাল থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের চোখে যদি সকল নাগরিক সমান না হয়, সে রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। মিয়ানমারের সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিদ্বেষ ও ঘৃণামূলক বক্তব্য না দেয়ার নির্দেশ ও অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
রোহিঙ্গা এক বড় ইস্যু। শুধু সে মিয়ানমার জন্য তা নয়, আমাদের দেশের জন্যও। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফরে গেলে তখন বিভিন্ন ব্যস্ততার অযুহাতে অং সাং সু চি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করেননি। বরাবরই শান্তিতে নোবেল পাওয়া সু চি রোহিঙ্গা বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। আর যার ফলে দীর্ঘায়িত হচ্ছে এক গভীর সংকট। মানবতার বিষয়ে আপোষহীন বিখ্যাত এই ব্যক্তিটি যদি নীতির ব্যাপারে আপোষ করেন তখন সবকিছুই অর্থহীন হয়ে যায়। আমরা আশা করব, মিয়ানমার সরকার ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সে দেশের সকল নাগরিকের প্রতি সমান আচরণ করবে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
আরআর