কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক; আওয়ার ইসলাম
ফিরে দেখা আরব বসন্ত : মাত্র এককোটি মানুষের দেশ তিউনিসিয়া। ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি দেশটির ধূলিধূসর শহর সিদি বৌজিদে যে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল সেটাই ছড়িয়ে পড়েছিল একের পর এক আরব দেশগুলোতে। তখন ধারণা হয়েছিল, আরবরা হয়তো শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ অন্ধকার এক টানেল থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজে পেয়েছে।
কিন্তু আজ? আরবে আজ বসন্ত নেই। ওখানকার আকাশে ইউরোপ-আমেরিকার যুদ্ধবিমান আর মাটিতে ভ্রাতৃঘাতী উন্মাদনা। বেন আলি নির্বাসনে। গদ্দাফি মৃত। মোবারক বিচারাধীন। সকলের নজর সিরিয়ার ওপর। কিন্তু কেউ কি ভাবছেন আরব বসন্তের সূতিকাগার সেই তিউনিসিয়ার বর্তমান অবস্থা কী? কেমন আছে বেন আলীর দেশটির জনগণ? পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে মুদির দোকানদার মুহম্মদ বওয়াজি প্রকাশ্যে গায়ে আগুন লাগিয়ে কী পেলেন তার প্রতিদান? অর্ধযুগ না পেরোলেও সেই আত্মবলিদানের ঘটনা হয়তো অনেকেই ভুলতে বসেছেন। আগ্রহী পাঠকদের সুবিধার্থে ঘটনাটির গোড়ার দিকে নজর দেয়া যেতে পারে।
দেশটিতে একদিকে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, একচ্ছত্র রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অন্যদিকে সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য, কর্মসংস্থানের সঙ্কট, বেকারত্ব এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির রাহুগ্রাসে বিপর্যস্ত নাগরিক সমাজের সংক্ষোভ বারুদের আগুনের মতো জ্বলে উঠেছিল জেসমিন রেভ্যুলেশনে। রাজধানী তিউনিস থেকে প্রায় ৩শ’ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর সিদি বাওজিদ এলাকার ছাব্বিশ বছর বয়েসী শিক্ষিত তরুণ মুহাম্মদ বওয়াজি ভালো কোন কর্মসংস্থান করতে না পেরে ধার দেনা করে একটি ভ্যানগাড়ি কিনে রাস্তায় তরকারি বিক্রি করে ৮ সদস্যের পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করত। প্রায়শ, পুলিশ তার কাছ থেকে ঘুষ দাবি করে। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ১০ দিনার চাঁদা না দেয়ায় ভ্যানগাড়িটি বাজেয়াপ্ত করে একজন মহিলা পুলিশ কর্মকর্তা। শুধু বাজেয়াপ্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি, বওয়াজির প্রতিবাদের মুখে তার গালে সজোরে থাপ্পড় মারে এবং তার মৃত বাবার নামে গালিগালাজ করে। এর বিরুদ্ধে সে প্রাদেশিক সরকারের সদর দফতরে গিয়ে স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির প্রতিকার চায়। এতে বিফল হয় এবং বিরূপ আচরণের শিকার হওয়ার পর সে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে নিজের গায়ে তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে সিদি বওয়াজি এলাকায় রাজপথে প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে। সংকটাপন্ন অবস্থায় বাওজিজিকে চিকিৎসার জন্য তিউনিসে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট বেন আলী তাকে দেখতে হাসপাতালে যান। আঠার দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি মোহাম্মদ বওয়াজির মৃত্যু হলে তিউনিসিয়াজুড়ে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। বিক্ষুব্ধ মানুষ একনায়ক বেন আলীর পতনের সেøাগান দিতে শুরু করে। পুলিশি অ্যাকশনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বেন আলী জরুরি অবস্থা বা স্টেট অব ইমার্জেন্সি জারি করে ১৪ জানুয়ারি দেশ ছেড়ে পালিয়ে সউদী আরবে আশ্রয় নেন। মোটা দাগে এই হচ্ছে তিউনিসিয়ান রেভ্যুলেশন বা আরব বসন্তের গোড়ার কথা।
গৃহযুদ্ধ থেকে গণতন্ত্রের পথে
আফ্রিকার উত্তর উপকূলে ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত তিউনিসিয়ায় শেষ পর্যন্ত জনতাই জিতল। ২০১১-এর অক্টোবরে সংসদীয় ভোটে কয়েকটি ধর্মনিরপেক্ষ দলকে সঙ্গে নিয়ে আননাহদা ইসলামি পার্টি কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। গেল বছর ১৯৫৬ সালে স্বাধীনতা লাভ করা তিউনিসিয়াকে গৃহযুদ্ধের প্রান্তসীমা থেকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে অবদান রাখায় ন্যাশনাল ডায়ালগ কোর্য়াট্টেট নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেছে।
দেশটির স্বাধীনতার পূর্বাপর আমরা দেখতে পাই, আধুনিক তিউনিসিয়ার স্থপতি হাবিব বুর্গিবা দেশটির স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দেন এবং ৩০ বছর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর তিউনিসিয়া উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে স্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ইসলাম দেশটির রাষ্ট্রধর্ম এবং প্রায় সব তিউনিসীয় নাগরিক মুসলিম। তিউনিসিয়া প্রায় পুরোপুরি সুন্নি একটি দেশ। ফলে ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ার মতো এখানে সাম্প্রদায়িক বা উপজাতীয় মতভিন্নতার সৃষ্টি হয়নি।
তিউনিসিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট হাবিব বুর্গিবাকে একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করার পর জয়নুদ্দিন বেন আলী ১৯৮৭ সালে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আরোহন করেন। এরপর থেকে নিজের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী রাখতে সম্ভাব্য সবকিছুই করেছেন বেন আলী। বেন আলীর ২৪ বছরের শাসনামলে তিউনিসিয়ায় ৪টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এর প্রতিটিতেই গড়ে নব্বই শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে অপ্রতিদ্বন্ধী শাসক হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বেন আলীর নির্বাচন এবং বার বার নিরঙ্কুশ বিজয়ের ভেতরকার ম্যাকানিজম সম্পর্কে আলোচনায় না গিয়ে বলা যায়, শুধুমাত্র নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। হিটলারও জার্মান জনগণের দ্বারা নির্বাচিত ছিলেন। একইভাবে বেন আলীও নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বার বার পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পরও সারাবিশ্বে তিনি একজন স্বৈরশাসক হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছিলেন। তবে পশ্চিমা সমর্থন না থাকলে তার পক্ষে এভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা সম্ভব ছিল না। মিসরের হোসনি মোবারকের মতোই পশ্চিমা সমর্থন নিয়েই বেন আলী তিউনিসিয়ান জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর স্বৈরতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরিসংখ্যানের হিসেবে ২৪ বছরের শাসনামলে বেন আলী তিউনিসিয়ার অর্থনীতিকে বেশ শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ সময়ের তিউনিসিয়ার জিডিপি প্রবৃদ্ধি তিনগুণ বেড়েছিল। সেই সাথে মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দুর্নীতিও বেড়েছিল আরো বেশি গতিতে। যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল জেসমিন রেভ্যুলেশনের বা আরব বসন্তের উদ্ভব।
তিউনিসিয়ায় শুরু হলেও বসন্তের পলাশ ফুটল আরও কয়েকটি আরব দেশে। জানুয়ারিতে যখন তিউনিস জনতা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল, সেই সময় মিশরের মানুষও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়াজ তুলল। তারা চিৎকার করে বলল, ‘হোসনি মুবারক, তোমার জন্য বিমান নিয়ে অপেক্ষা করছে বেন আলি।’ সারা দেশ কায়রোয় জড়ো হল। কায়রোর সব রাস্তা মিশল তাহরির স্কয়ারে। ২৫ জানুয়ারি যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তা চলল ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ওই দিন হোসনি মুবারক পদত্যাগ করলেন। বলা ভাল, জনতা পদত্যাগ করতে বাধ্য করল। ২০১১-এ তিউনিসিয়ায় যা শুরু হয়েছিল, অচিরেই তা আরবভূমিতে ছড়িয়ে পড়ল। তিউনিসিয়া, মিশরের পাশাপাশি লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, সিরিয়া, মরক্কো, জর্দানেও স্বৈরাচারী ও পারিবারিক একনায়কতন্ত্রী সরকারকে উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ রাস্তায় নামে।
চ্যালেঞ্জ নিয়ে পথচলা
প্রথম অবাধ নির্বাচনে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও তিউনিসিয়ার ঘানুচির দল আননাহদা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথে আপস করেছে, ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিউনিসিয়াকে আরব বসন্তের একমাত্র সফল দেশে পরিণত করতে সহায়তা করেছে। বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কেন তার ছোট দেশটির গল্প এত গুরুত্বপূর্ণ তা রশিদ ঘানুচি নিজেই ব্যাখ্যা করে বলেছেন- ‘আইএসআইএসকে সত্যিকারভাবে পরাজিত করার একমাত্র উপায় হলো বিশ্বের কোটি কোটি তরুণ মুসলিমের সামনে আরো ভালো কিছু হাজির করা। আমরা তা করেছি- মুসলিম গণতন্ত্র। তরুণরা আইএসআইএসকে পছন্দ করে না। কোটি কোটি লোক তাদের কাছ থেকে পালিয়ে আসাটাই এর বড় প্রমাণ। তবে তারা স্বৈরাচারের অধীনেও বাস করতে চায় না।’
তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্র টিকে থাকার অন্যতম কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ব্রিটিশ-তিউনিসীয় লেখক এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও তিউনিসিয়ার আন নাহদা প্রধান ড. রশিদ ঘানুশির মেয়ে সুমাইয়া ঘানুশি বলেন- ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। তারা রাজনীতিকে ঠেলে এর চরম সীমাবদ্ধতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে বাস্তবমুখী যৌক্তিকতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। দুই স্বনামধন্য রাজনীতিকের হত্যাকা-ের পর সঙ্কটে পড়ে ক্ষমতাসীন আন নাহদা পার্টি। তবে পরিস্থিতি সাফল্যের সাথে সামাল দেয় তারা। আরব রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়ে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও জোট করে তারা। ফলে কয়েক মাস ধরে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটে। তাদের সংবিধান প্রণয়নের পথও সহজ হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দলের এই ছাড় দেয়ার মানসিকতাই দেশটিকে ব্যর্থ হওয়ার থেকে বাঁচিয়ে দেয়। প্রতিবেশী লিবিয়া বা সিরিয়ার মতো তারা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। মিসরের মতো কর্তৃত্বপরায়ণদের হাতে পড়েনি। (মিডল ইস্ট আই)
তাই বলা যায়- আরব বসন্তের ক্ষীণ আলো এখনো জ্বলছে শুধু তিউনিসিয়াতেই। তারা ইতোমধ্যে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রগতিশীল সংবিধান তৈরি করেছে। ২০১৪ সালে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতেও সক্ষম হয়েছে তারা। বর্তমানে চার দলের জোট সরকার তিউনিসিয়া চালাচ্ছে। তবে এরপরও তিউনিসিয়াকে পুরোপুরি সফল বলার অবকাশ খুব বেশি নেই। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী লিবিয়ার সঙ্কট তিউনিসিয়াকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অতীতের প্রশাসনের পক্ষে বর্তমান নিডা টোনস নামে পরিচিত বহুদলীয় সরকার ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতেও সঙ্কটে পড়ছে। বর্তমানের জোট সরকারে সাবেক স্বৈরশাসক বেন আলির লোকজনও রয়েছে।
বহু বিপ্লবী গ্রুপ এই সমঝোতাকে পছন্দ না করলেও রাজনৈতিক মানচিত্রে এর কারণেই তিউনিসিয়া সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছে। তারপরও এই দেশটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিপ্লবের সময় মানুষের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে যে উচ্চাশা জেগেছিল তার সাথেও বর্তমান পরিস্থিতির কোনো সমন্বয় নেই। পাশাপাশি সন্ত্রাসী হামলার হুমকি তো রয়েছেই।
আরআর