মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। মাসিক আল কাউসারের নির্বাহী সম্পাদক। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন। লিখেছেন অসংখ্য জনপ্রিয় বই। ময়মনসিংহে জন্ম নেয়া এ কৃতি সন্তান বর্তমানে পরিবার নিয়ে বাস করছেন ঢাকার মিরপুরে।সম্প্রতি ঢাকার বাসাবোতে অবস্থিত মাদরাসাতুস সুফ্ফার স্মারকগ্রন্থ পুস্পকাননে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি আওয়ার ইসলামের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশের মিডিয়ায় ইসলামী মহল ও মূল্যবোধ কি উপেক্ষিত ও আক্রান্ত হয় বলে মনে করেন? কেন?
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। প্রথম যে প্রশ্ন এই প্রশ্ন আসলে পরিষ্কার। আমি বলব এটা মোটামুটি সব মহলের কাছেই স্পষ্ট। বাংলাদেশের মিডিয়ার প্রধান অংশের কাছে বা ব্যাপকভাবে মিডিয়ার বড় অংশ প্রায় নব্বই ভাগ বা আশি ভাগ যদি আমি বলি তাদের কাছে ইসলামী মহল, ইসলামী মূল্যবোধ ইসলামী শিক্ষা, ইসলামী চেতনা, ইসলামের ইতিহাস, ব্যক্তিত্ব উপেক্ষিত এবং আক্রান্ত দুটোই।
এটার অনেকগুলো কারণ, প্রথমত বাংলাদেশে যারা মিডিয়া চালান বা ভেতরে কাজ করেন তাদের চিন্তা চেতনাটা উল্টো, ইসলামী বিশ্বাস ও চিন্তাচেতনার বিপরীত।
দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো পশ্চিমা মিডিয়ার যে এজেন্ডা আছে মুসলিম দেশগুলো নিয়ে, মুসলিম দেশগুলোর জীবনযাত্রা ও শিক্ষা নিয়ে এই এজেন্ডার বাইরে তারা যেতে পারে নাই। সব সময় আমাদের মিডিয়া পশ্চিমা মিডিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়। মিডিয়ায় ইসলামী ভাবধারার অনুপস্থিতির পেছনে এটাও একটা কারণ।
তৃতীয়ত: মিডিয়ার কর্মী যারা তাদের ঐতিহ্যগত ধারার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাম রাজনীতি থেকে এদের অধিকাংশ এসেছে। সেটার একটা প্রভাব এখানে আছে।
চতুর্থত: এখানে যারা বিনিয়োগ করেন তারা আর্দশিক বা চিন্তাচেতনার দিক থেকে কোন একটা পাশের না হলেও তাদের মিডিয়া কতটা মুসলিম জাতিসত্তার পক্ষে বা বিপক্ষে যাচ্ছে সে ব্যাপারে তারা উদাসীন থাকেন। ফলে কিছু বুঝ এবং কিছু অবুঝের কারণে মিডিয়াতে যারা দুষ্টুমিগুলো করতে চায়, ইসলামী জাতিসত্তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায় তারা এটা পারে এবং করে। এতে দেশের ভেতরে ও বাইরে তাদের যে মিশ্র শক্তি আছে তারাও আনন্দিত হয়। এর মধ্যে বৃহৎ পশ্চিমা গোষ্ঠীও আছে, পাশাপাশি আমাদের প্রতিবেশী বড় বড় কিছু রাষ্ট্রও আছে। যাদের সরাসরি রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে এই উপেক্ষা এবং আক্রমণের সাথে। সেসব কারণেই এটা হতে পারে।
আরেকটা ব্যাপার হলো এটা যারা প্রতিরোধ করবেন দেশের ভেতরের চিন্তাশীল মুসলিম ব্যবসায়ী রাজনীতিক এবং উলামায়ে কেরামের বাইরে ডানপন্থী বিশাল যে নাগরিক জনগণ, তারাও বাস্তবিক অর্থে এটা প্রতিরোধের কোন বিষয় বলে মনে করেন না। আমলে নেন না। এ কারণেই দুদিক থেকে এটা টিকতে পারে বা চলতে পারে বলে আমি মনে করি।
এদেশের মিডিয়া কারা চালান, কারা বিনিয়োগ করেন এবং কারা নিয়ন্ত্রণ করেন?
মাশাআল্লাহ এটাও একটা সুন্দর প্রশ্ন। প্রশ্নের মধ্যেই আসলে দুটো অংশ আছে। কারা চালান এবং কারা বিনিয়োগ করেন। আর কারা নিয়ন্ত্রণ করেন এটাও একটা প্রশ্ন। আমি এটাকে দুই ভাগে ভাগ করব। বিনিয়োগ তো করেন বাংলাদেশের পুঁজিপতি শিল্পপতিরা; কিছু শিল্প বা গ্রুপ অব ইন্ডাষ্ট্রির মালিক। আর কিছু পত্রিকা আছে, কিছু মিডিয়া আছে যেগুলো আগ থেকেই চলতো। তখন মিডিয়ার মালিকেরাই মিডিয়া করেছেন। কিন্তু এখন বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মিডিয়াই কোন না কোন ব্যবসায়ীক গ্রুপের দ্বারা পরিচালিত।
আমি আগেও প্রশ্নের উত্তরে বলেছি যে, এইসব মালিকদের বড় একটা অংশ আছে অসচেতন। আর কিছু লোক হয়ত সচেতন জাতিসত্তার বিষয়ে ইতিহাসের বিষয়ে। কিন্তু সবার মধ্যে একটা বিষয়ে মিল আছে। সেটা হচ্ছে মিডিয়ার যেন সার্কুলেশনটা বাড়ে, প্রভাব বাড়ে। এতে তাদের যে ব্যবসায়ীক স্বার্থ আছে সেটা যেন রক্ষিত হয়। ফলে মিডিয়া যারা চালান তারা ভেতরে নিয়ন্ত্রক শক্তি যেই লোকগুলো আছে- যারা কিছুটা বাম আদর্শে উদ্বীপ্ত ছিলেন ৪০/৫০ বছর আগে অথবা তাদের অনুচর এখন, বিশ্বাসে যারা ইসলাম থেকে একটু দূরত্ব রক্ষাকারী, চিন্তায় যারা মুসলিম জাতিসত্তার বিরোধী- তাদের আদর্শ বা লক্ষ্যটাকে রক্ষা করেই তারা বিনিয়োগটা করেন, কিছুটা অসহায়ের মত। কারণ তাদের প্রধান টার্গেট থাকে ব্যবসায়ীক সাফল্য। তাদের অন্য যে ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে সেখানে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখা। কোন কোন ক্ষেত্রে দুষ্টু লক্ষ্য থাকে সেই লক্ষ্যগুলো পূরণ করা। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের উপর অন্য দিক থেকে আক্রমণ আসে সেই আক্রমণগুলো প্রতিহত করা। অর্থাৎ একটা মাস্তান বা লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে মিডিয়াকে ব্যবহার করাটাই থাকে তাদের প্রধান টার্গেট। ফলে চেতনার দিক থেকে, আর্দশের দিক থেকে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের দিক থেকে তার বিনিয়োগ করা মিডিয়াটা স্বয়ং তারই পুরো জাতিসত্তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে কি যাচ্ছে না এটা নিয়ে তার মধ্যে ভাবনা বেশি একটা থাকে না। এটা হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের ব্যাপারে আমার বক্তব্য।
আর যারা চালান বা নিয়ন্ত্রণ করেন আমি আগেও বলেছি তাদের বড় অংশটাই হচ্ছে ইসলামী জাতিসত্তার বিরোধী চেতনা থেকে উঠে আসা; রাজনৈতিকভাবে, আর্দশিকভাবে এবং চিন্তাগতভাবে। তাদের ওরিয়েন্টেশন বা শিক্ষাগত ভিত্তিই ওটার ওপরে। এভাবে একটা ধারা তৈরি হয়েছে। ফলে এখন একটা ছেলে যে একটা বিশ বছর বয়সী বা ত্রিশ বছর বয়সী, শুরু থেকে হয়ত তার চিন্তা কোন একদিকে ছিলো না। কিন্তু ঐ মিডিয়ার ক্ষেত্রটাতে ঢুকতে গেলে তাকে ফিল্টারিং করেই ওখানে ঢুকানো হয়। অর্থাৎ তাদের মত চিন্তা, তাদের মত ভাবনা। তাদের মত এজেন্ডাগুলোই মাথার মধ্যে ঢুকানো। তাদের মত করেই দেখতে শেখা বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনাকে। এভাবেই মিডিয়াটা বিকশিত হচ্ছে। ফলে এই নিয়ন্ত্রণটা তারা সহজে করতে পারছে ইসলামবৈরী শক্তি হিসেবে।
এজন্য বাংলাদেশে কোন মাদরাসার ছাত্র আক্রান্ত হলে ঐ নিউজটা বড় করে না হয়ে তাদের প্রতিবাদের ঘটনাকে নেগেটিভ আকারে বড় করে প্রচার করা হয়। এজন্যই ইসলামের কোন শিক্ষাকে পজেটিভ বা ইতিবাচকভাবে না দেখে এটাকে দেশের জন্য একটা বড় বোঝার ব্যাপার মনে করা হয়। এজন্যই কোন একটা ক্যাম্পাসে টুপি, বোরকা, নামাজ, রোজা ইত্যাদি বন্ধ করার অপচেষ্টা হলে এটা মানবাধিকারের লংঘন হচ্ছে এইভাবে নিউজটা না করে ওটা নিয়ে যদি প্রতিবাদ করা হয় তাহলে সেটাকে মৌলবাদী তরুণ তরুণীর চর্চা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশে যারা মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাদের মুসলিম জাতিসত্তার এই বিরোধীতার স্বরূপ সম্পর্কে মোটামুটি ধার্মিক এবং শিক্ষিত নাগরিক মহলের বেশির ভাগ মানুষই এখন সচেতন।
এসব কারণে দ্বীনি মহলের বড় কোন ক্ষতির আশংকা কি আছে? অর্থাৎ মিডিয়ার গুরুত্ব বর্তমানে কতটুকু?
আমার কাছে মনে হয় এই দিকটা নিয়ে এখন চিন্তা করার সময় হয়েছে। এই যে অপপ্রচার এর দ্বারা ক্ষতি কি আসলে হতে পারে। প্রথম কথা হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন আল্লাহ হেফাজত করবেন এই ভরসা আমাদের রাখতে হবে এবং এই ভরসা রেখেই কাজ করতে হবে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে একদম ইসলামের প্রথম যুগ থেকে দেখা যায় যে কোন বিপদ বা ষড়যন্ত্র নিয়ে নবী সা. থেকে শুরু করে খোলাফা, সাহাবা, তাবেয়ীন কেউ সেটাকে হালকা চোখে দেখেননি। আমরা কাব ইবনে আশরাফের ঘটনা যদি দেখি, আবু রাফের ঘটনা যদি দেখি, পরবর্তী সবগুলি জিহাদের ঘটনা যদি দেখি তাহলে এই বিষয়টা পরিষ্কার দেখতে পাব যে, ইসলাম প্রতিটা অপপ্রচারের আক্রমণকেও গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।
আর বর্তমানে বাংলাদেশ ত্রিশ চল্লিশ বছরের আগের সময় থেকে অনেক পরিবর্তিত। মিডিয়ার পরিমাণ ও প্রভাব খুব বেশি। সারা দিন রেডিও স্টেশন এবং টিভি চ্যানেলগুলো চলতে থাকে। পত্রিকার সংখ্যা অনেক বেশি। কম দামী বেশি দামী। মানুষের পড়ার যোগ্যতা বেড়ে গেছে। দেখার সুযোগ বেড়েছে। নিম্নবিত্ত মানুষের ঘরেও টিভি রেডিও থাকে।
এজন্য সহজেই মিডিয়া মানুষের মনোজগত ও চিন্তা চেতনা বদলে দিতে পারে। আগের দুটো প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলেছি মিডিয়ার বিনিয়োগটা হয় অসচেতন। আর চালায় যারা, তারা পুরোই ধর্মবিরোধী। ধর্মবিরোধী না বলে ইসলাম বিরোধী বলা যায়। আমি ধর্ম ব্যাপকভাবে বলব না। কারণ কোন কোন ধর্মের ব্যাপারে মিডিয়ার লোকজনকে যথেষ্ট দুর্বল ও অনুরক্ত বলে আমরা দেখতে পাই। ইসলাম বাংলাদেশের প্রধান ধর্ম। এই ধর্মের প্রতিই কেবল আমরা তাদের বৈরী আচরণ লক্ষ্য করি। এটা যেহেতু তাদের হাতে পরিচালিত হচ্ছে সেহেতু মিডিয়ার এই অব্যাহত অপপ্রচারের দ্বারা মানুষের মধ্যে ইসলামের ব্যাপারে প্রতিকূল মানসিকতা তৈরি হওয়া এবং সঠিক ইসলামী মূল্যবোধ সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার সমূহ আশংকা আছে। কোন ভাবেই সেই আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি মিডিয়ার ধ্বংসাত্মক ক্ষতি সম্পর্কে আমাদের আসলে সচেতন হওয়া দরকার। এটার গুরুত্ব আছে। দেশে ডেঙ্গুজ্বরের সমস্যা হলে, হেপাটাইটিস ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে চিকিৎসক এবং সংশ্লিষ্ট মহলগুলো থেকে মানুষকে সচেতন করা হয়, তেমনি আমরা দ্বীনদার মহল থেকে মনে করি এখন সময় এসেছে সর্তক করার। মানুষ যেন প্রচারিত, সম্প্রচারিত বা মুদ্রিত মিডিয়ার বিষফল গোগ্রাসে না গিলে এবং অহী বা ঐশী বাণীর মত সেটাকে বিশ্বাস না করে, মানুষ যেন এটাকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করে।
প্রচলিত মিডিয়ার এই বিষফল ও কুপ্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া উপায় কী?
এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, এখানে কয়েকটা বিষয় আছে। প্রথম কথা হচ্ছে মিডিয়া তো চলছে। হঠাৎ করে এটাকে বন্ধ করে দেয়ার কোন সুযোগও নেই। পৃথিবীতে এটা একটা অধিকারেরও বিষয় এবং এটা একটা প্রতিষ্ঠিত বিষয়। অতএব সারা দেশ ও বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের জাতিসত্তার অস্তিত্বের সাথে যেহেতু বিষয়টা জড়িত, সেহেতু আমার বক্তব্য হচ্ছে, ইসলামী জাতিসত্তার ও ভাবাদর্শের বিরোধী এই মিডিয়া প্রতিরোধে আমরা কয়েকটা কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারি।
প্রথম বিষয়টা হচ্ছে নিজে সচেতন হওয়া, মানুষকেও সচেতন করা। মসজিদের মিম্বারে, তাবলীগের বয়ানে, ওয়াজের মাহফিলে, মাদরাসার দরসে অর্থাৎ যেখানেই জনগণের সাথে মেশার ক্ষেত্র থাকে, তখন বক্তারা যেন অন্যান্য ফেতনার পাশাপাশি মিডিয়ার ভয়াবহ ফেতনার ব্যাপারেও মানুষকে সচেতন করে তোলেন। যেই বিষয়গুলো মিডিয়ায় কৌশল ও প্রতারণার সাথে প্রচারিত হয় তারা যেন সেগুলোর স্বরূপ জনগণের সামনে উন্মোচন করে দেন।
একই সাথে আমাদের এটাও বলতে হবে যে, মিডিয়া মানেই মন্দ নয়। সব মিডিয়াও সমান মন্দ নয়। ভালো কিছু দিকও আছে। এই বিষয়টা মাথায় রেখেই মিডিয়ার অপপ্রচার সম্পর্কে মানুষকে সজাগ করে তোলা কর্তব্য।
দ্বিতীয় ধাপের কাজ হচ্ছে, বর্তমানে বিরাজমান মিডিয়াগুলোর মধ্যেই উপযোগী এবং নিজেদের ঘরানার কিছু লোক ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা। কওমী মাদরাসার ছেলেরা আলহামদুলিল্লাহ এখন অনেকেই লিখতে শিখেছেন, আরো চর্চা করতে চান, গত দশ পনের বছরে একটা ইতিবাচক চিত্র সামনে চলে এসেছে। এটাকে আরো বিকশিত করা যায়। অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী এবং আর্দশিক বিচারে কম সাংঘর্ষিক মিডিয়াগুলোর মধ্যে এদেরকে ঢুকানো যেতে পারে। রিপোর্টার হিসাবে, ফিচার লেখক হিসাবে, সাব এডিটর বা বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে নিজেদের লোকদের ঢুকিয়ে দেয়ার ফিকির এখন করা উচিৎ।
তৃতীয়ত আমরা বলব কিছু বিকল্প মিডিয়াও তৈরি করা চাই। যেমন নেটের এই যুগে ইচ্ছা করলে ইউটিউবের কোন একটা অংশ বরাদ্দ নিয়ে তার মাধ্যমে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়া যেতে পারে, কেউ কেউ করছেনও কিছু ফেতনার বিরুদ্ধে। এছাড়া অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্যাদি ছোট ছোট কাজগুলো করা যেতে পারে।
চতুর্থত বৃহৎ পরিসরে বড় বড় ওলামায়ে কেরাম, বিত্তশালী দ্বীনদার মানুষদের নিয়ে বড় বড় মিডিয়া প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। দৈনিক পত্রিকা, রেডিও স্টেশন, টিভি চ্যানেল ইত্যাদি গড়ার ফিকির করা। তাহলেই আমরা মনে করি মিডিয়ার এই দুষ্টুমি ও কুপ্রভাব থেকে জাতিকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে।
কওমী অঙ্গনের ছেলেরা মিডিয়ায় কিভাবে কাজ করতে পারে এবং নিজেদের প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে তাদের কী কী পন্থা অবলম্বন করা উচিৎ?
এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ইতোমধ্যে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিকে কওমী মাদরাসার ছেলেরা কাজ করছেন। এক্ষেত্রে কে কিভাবে ঢুকতে পারছেন, কিভাবে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এবং কে কতটা সফল, অথবা এর মধ্যে আরো কিছু করা যায় কিনা- আমি বলব এক্ষেত্রে স্বতঃসিদ্ধ কোন নিয়ম আসলে অনুসরণ করার কিছু নেই। এটা অভিজ্ঞতাজাত একটা কর্মপ্রয়াস। দেখে দেখে কাজ শুরু করতে হয়। এরপরও একটা জিনিস সত্য যে, একটা মৌলিক যোগ্যতা লাগবেই বলার এবং লেখার। কিছু বাক্য তৈরির অনুশীলন, সাহিত্য সাংবাদিকতার বুনিয়াদী চর্চা, প্রবন্ধ ও কলাম লিখতে পারা, ফিচার তৈরি করা, সুন্দরভাবে বলতে পারা যদি আমি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করতে চাই। বুনিয়াদী যোগ্যতাগুলোর অনুশীলন নিজে নিজে করেই এরপর যোগাযোগগুলো করা, বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় ঢোকার সুযোগ তৈরি করা।
একই সঙ্গে আমি একটা জিনিস বলব- এই প্রসঙ্গটা আসলে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই আমি বলার চেষ্টা করি-আমরা যেন গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে হারিয়ে না যাই। আগের আলোচনাগুলোতে উঠে এসেছে, বাইরের জগত ও মিডিয়া বৈরি শক্তিরই নিয়ন্ত্রণে। দেখা যায় আমাদের তরুণ ছেলেরা ইসলামের খেদমতের জন্যে মিডিয়াতে যাওয়ার নিয়ত করে। এবং ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলন করে নিজেকে সেভাবে তৈরি করার চেষ্টা করে। পরে মিডিয়ার স্রোতে গা ভাসিয়ে সে কেবল তার পোশাকই না, তার চিন্তাধারা সবই বদলে ফেলে। আমি বলব এটা আমাদের জন্য ইতিবাচক কিছু না। বরং এতে আমাদের কিছু ছেলে হারিয়ে যায়। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।
এজন্য যখন মিডিয়াতে ঢোকার চেষ্টা করবে কোন ছেলে, আমি বলব আর দুটো দৃঢ়তা লাগবে। একটা হলো সাহিত্য শেখার, লিখতে শেখার এবং বলতে শেখার দৃঢ়তা। দ্বিতীয়ত টিকে থাকার দৃঢ়তা। অর্থাৎ অবহেলিত ও উপেক্ষিত মহলের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আমি মিডিয়াতে যাচ্ছি, অতএব কোন কিছু করলে আমি নিজের স্বকীয়তা রক্ষা করে করব। তা না হলে আমি ওখানে যাবই না। আমার কাজের অঙ্গন অন্যটা হবে।
এই দুইটা দিক বজায় রেখে যেন আমাদের ছেলেরা কাজ করে। আমি তাদের সুন্দর ভবিষ্যতের উজ্জলতম দিনের অপেক্ষায় আছি। সম্ভাবনা মাদরাসার ছেলেদের অনেক। যারা কাজ করছেন প্রত্যেকেই বিপুল যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। এখনো যারা ভাবছেন, কিছু করার চেষ্টা করছেন এবং বিরাজমান মিডিয়ায় যারা কাজ করছেন তাতে আমি মনে করি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বিপুল সম্ভাবনা আছে।
আরেকটা কথা আমি বলব, আমাদের কিছু লোকের তো এমনিতেই তৈরি হওয়া উচিত। কারণ এখনকার মিডিয়াই তো শেষ কথা না। ভবিষ্যতে মুরুব্বীদের পরামর্শে, দিক নিদের্শনা ও আয়োজনে দুই চার বছরের মধ্যে বড় বড় দৈনিক পত্রিকা, বড় বড় চ্যানেল এবং রেডিও স্টেশনের ব্যবস্থা যদি হয়, অনলাইন মিডিয়া বা আরো অনেক কিছু হয়, জেলায় জেলায় বা কেন্দ্রীয়ভাবে হয়, তখন তো আমাদের ছেলেদের লাগবে।
এজন্য আমরা তৈরি হতে থাকি। আমাদের বর্তমান কর্মক্ষেত্র কেবল দ্বীনি অঙ্গন হলেও লেখালেখি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে এমনভাবে তৈরি থাকা উচিত যাতে ভবিষ্যতে চাহিদা আসলে আমরা স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে মুরুব্বীদের নির্দেশনায় কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করে মিডিয়ায় নিজেদের কাজ শুরু করতে পারি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তৌফিক দান করুন। মিডিয়ার মাধ্যমেই মিডিয়ার দ্বীন বিরোধী আগ্রাসন রুখে দেয়ার তাওফীক দান করুন।
আরআর