এডিটর’স নোট: তুরস্কের রয়েছে সুদীর্ঘ গৌরবময় ইতিহাস। উসমানী খেলাফতের পতন পরবর্তী দীর্ঘ বিরতির পর সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার তুর্কি আকাঙ্খার ইঙ্গিত এরদোয়ানের তৎপরতায় রয়েছে। বলাবাহুল্য, সেলজুকদের সময় থেকে তুরস্কের সাথে ইসলামের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। আবার সবচেয়ে কট্টর সেক্যুলার শাসনও তুরস্কের মানুষ দেখেছে। সম্প্রতি তুরস্ক ধীরে ধীরে তার অতীতে ফিরে যাচ্ছে। তুরস্কের উত্থান-পতনের নানা বাঁকে ইসলামের অবস্থান কী ছিলো, বোধকরি তা জানতে অনেকেই আগ্রহী। এ বিষয়ে লিখেছেন আবিদুল ইসলাম চৌধুরী।
আজকের মধ্যপ্রাচ্য ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন ছিল। সপ্তম শতাব্দী অর্থাৎ ওমর (রা)-এর শাসনামল হতে রোমানদের শক্তি খর্ব হতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ১০৪৮ সালের যুদ্ধে সেলজুক তুর্কি মুসলিমরা এশিয়া মাইনরে (তুরস্ক ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল) বাইজেন্টাইনদেরকে (রোম সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল) পরাজিত করে। ১০৭১ সালের ২৬ আগস্ট সংঘটিত মানযিকার্টের যুদ্ধে জয় লাভের মাধ্যমে তুরস্কে (তৎকালীন সময় থেকে খেলাফতের পতনের আগ পর্যন্ত বর্তমান তুরস্কের ইস্তানবুল বাদে এশীয় অংশটুকু আনাতোলিয়া নামে পরিচিত ছিল) সেলজুক শাসন পাকাপোক্ত হয়।[1]
তবে কয়েক শতাব্দী পরেই সেলজুকরা দুর্বল হতে শুরু করে। আনাতোলিয়ার ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর সাথে বিচ্ছিন্নতা ও মোঙ্গলদের সাথে শক্তির ভারসাম্যে ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকে সেলজুকরা। অপরদিকে, উসমান গাজীর নেতৃত্বে তাঁর বাহিনী তুরস্কের সর্ব পশ্চিমের নগর বুরসাতে বাইজেন্টাইনদের বিভিন্ন দুর্গ দখল করে দ্রুত শক্তি অর্জন করতে থাকে। ধীরে ধীরে তারা এ অঞ্চল থেকে সেলজুকদের হটিয়ে দিয়ে প্রভাব বাড়াতে থাকে। ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল (ইস্তানবুল) জয় করার মধ্য দিয়ে উসমানীয় খেলাফত পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে।
ভৌগোলিক অবস্থান
ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব ও এশিয়ার পশ্চিম-দক্ষিণাংশে তুরস্ক অবস্থিত। যার পশ্চিমাংশের বসফরাস প্রণালী থেকে পুরো ইস্তানবুল অংশটি পড়েছে ইউরোপের অংশে। দেশটির উত্তর দিকের সীমানা ঘেঁষে জর্জিয়া ও বুলগেরিয়ার মাঝামাঝিতে রয়েছে কৃষ্ণসাগর। এছাড়া পশ্চিম-দক্ষিণাংশে গ্রীস ও সিরিয়ার মাঝামাঝিতে আছে ইজিয়ান ও ভূ-মধ্যসাগর। পূর্ব-দক্ষিণাংশের সীমানায় অবস্থান করছে ইরাক, ইরান, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া।
খেলাফতের পতন
প্রায় সাড়ে চার’শ বছর ধরে এশিয়ার বৃহদাংশ, উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপের বলকান ও ককেশাশ অঞ্চলে উসমানীয় খেলাফতের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই উসমানীয় খেলাফতের প্রতাপ কমতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তা বিলীন হতে শুরু করে। মূলত বলকান অঞ্চলে নিজের আধিপত্য ধরে রাখতেই ১৯১৪ সালে খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের কারণে তিনি রাশিয়ার বিপরীতে জার্মানির পক্ষে অবস্থান নেন। শেষ পর্যন্ত সব অঞ্চল হারিয়ে উসমানীয় খেলাফত শুধু তুরস্কে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারপরও ইউরোপীয় প্রতিবেশীরা পরাজিত তুরস্ককে পুরোপুরি দখল করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। এ লক্ষ্যে ইউরোপীয় সৈন্যদলগুলো তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করছিল।
এমতাবস্থায়, খলিফা ষষ্ঠ মোহাম্মদ ইউরোপের হাত থেকে তুরস্কের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে ‘গেলিপোল্লি’ যুদ্ধের নায়ক মোস্তফা কামাল পাশাকে ১৯১৯ সালের ৩০ এপ্রিল সেনাবাহিনীর নবম ডিভিশনের ‘জেনারেল ইন্সপেক্টর’ হিসেবে নিয়োগ দেন।[2] তবে খলিফার সাথে দ্বিমত করে ৮ জুলাই তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। উসমানীয় সরকার তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিলেও তিনি রক্ষা পেয়ে যান। ওই বছরই উসমানীয় সরকারের সর্বশেষ নির্বাচনে কামালের দল বিজয়ী হয়। পরবর্তীতে বৃটিশরা তুরস্কের ‘মিশাক-ই-মিল্লি’কে (জাতীয় ঐক্যের ঘোষণা) ভেঙ্গে দিলে কামাল পাশা ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি’ (জিএনএ) প্রতিষ্ঠার জন্যে জাতীয় নির্বাচনের ডাক দেন। জিএনএ প্রতিষ্ঠিত হলে উসমানীয় সরকারকে চ্যালেঞ্চ করে দেশে আরেকটি কর্তৃপক্ষের (দ্বৈত) শাসন চালু হয়।[3]
বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া সেভরে চুক্তি (১৯২০) প্রত্যাখান করে জিএনএ’র নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। ১৯২১ সালের ৫ আগস্ট কামাল পাশাকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯২২ সালে গ্রিস-তুরস্ক যুদ্ধে তুরস্ক চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। যুদ্ধে জয়ের ফলে জিএনএ আরো প্রভাবশালী হয়ে উঠে। পরিণতিতে উসমানীয় খলিফা জিএনএ’র হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে বাধ্য হন। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর উসমানীয় খেলাফতের অবসান ঘোষণা করা হয়। তবে মুসলিম সেন্টিমেন্টকে অনুকূলে রাখতে দ্বিতীয় আব্দুল মেজিদকে প্রতীকী খলিফা হিসেবে বহাল রাখা হয়। অবশেষে ১৭ নভেম্বর ক্ষমতাচ্যুত খলিফা ষষ্ঠ মোহাম্মদ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর জিএনএ কামাল পাশাকে প্রেসিডেন্ট এবং তুরস্ককে ‘প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা করে। এ পর্যায়ে প্রতীকী খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল মেজিদকেও নির্বাসনে পাঠিয়ে ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ উসমানীয় খিলাফতকে চূড়ান্তভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
প্রজাতান্ত্রিক শাসনে তুরস্ক
কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে প্রজাতান্ত্রিক শাসনের নামে শুরু হয় একনায়কতন্ত্রের শাসন। পাশ্চাত্যের ‘আধুনিকতা’র সাথে তাল মেলাতে জনগণের ওপর সেক্যুলারিজমের আবরণে ধর্মহীনতাকে চাপিয়ে দেয়া হয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলাম অনুসারীদের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। কোরআন শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করা হয়। মসজিদে আরবিতে আজান নিষিদ্ধ করে টার্কিশ ভাষায় আজান প্রচলন করার হয়। তুর্কি ভাষা থেকে আরবি বর্ণমালা বাদ দিয়ে ল্যাটিন বর্ণমালা চালু করা হয়।
১৯৪৩ সালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইস্টন চার্চিল তুরস্ক সফরকালে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান ইসমত ইনউনু’র সাথে বৈঠক করে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তাগাদা দেন। ১৯৪৬ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তিত হলে রিপাবলিকান পিপলস পার্টির এমপি জেলাল বায়ার ও আদনান মেন্দারিস প্রতিষ্ঠা করেন ডেমোক্র্যাট পার্টি। ১৯৫০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আদনান মেন্দারিস আরবিতে আজানের অনুমতি প্রদান করেন। পাশাপাশি কোরআন শেখা ও নামায পড়ার অনুমতিসহ মুসলিমদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চর্চার ওপর থেকে বেশকিছু বিধি-নিষেধ তুলে নেন। মেন্দারিস সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিকে অর্থাৎ ১৯৬০ সালে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল গুরসেল ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। সামরিক আদালতে আদনান মেন্দারিসের বিরুদ্ধে তুরস্কের সেক্যুলার শাসনতন্ত্রের বিরোধিতা ও আরবিতে আজান পুনঃপ্রতিষ্ঠার অভিযোগ আনা হয়। এক সংক্ষিপ্ত বিচারে তাঁকে মৃতুদণ্ড প্রদান করা হয়। মেন্দারিসকে ফাঁসি দেয়ার ঘটনায় পুরো জাতি শোকাহত হলেও সেনাবাহিনীর ভয়ে বিক্ষোভ থেকে বিরত থাকে। সামরিক শাসন পরবর্তী ১৯৬৫ সালের ১০ অক্টোবরের নির্বাচনে সুলাইমান ডেমিরিলের ‘আদালত পার্টি’ (True Path Party) সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে।
বদিউজ্জামান নূরসীর প্রভাব
কামাল পাশার একনায়ক সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মহীনতা চাপিয়ে দেয়ার কারণে জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারগুলো খর্ব হতে শুরু করে। সে সময় তুরস্কের কয়েকজন মুসলিম আলেম এসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী।
১৮৭৭ সালে বিৎলিস প্রদেশের নূরস গ্রামে জন্ম নেয়া সাঈদ নূরসী ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সেই সফলতার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৯১৩ সালে তিনি তুরস্কের ভ্যান প্রদেশে জেহরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে নিরপেক্ষ থাকলেও পরবর্তীতে খেলাফত রক্ষার তাগিদে যুদ্ধে যোগ দেন। জ্ঞান অর্জনে তিনি যেমন অসাধারণ, তেমনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী। তাঁর ছাত্রদের নিয়ে গঠন করেন আধাসামরিক বাহিনী। তুরস্কের পূর্বদিকে পাসিলোনা ফ্রন্টে রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁর বাহিনী নিয়ে। যুদ্ধের একপর্যায়ে বন্দি হওয়া নুরসী যুদ্ধ শেষে রাশিয়ান কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন। সরকারের ইসলাম নিধন কার্যক্রমের বিরোধিতা ও পরবর্তীতে ‘শেখ সাঈদ বিদ্রোহে’ প্ররোচনার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন। অথচ তিনি ‘সাঈদ বিদ্রোহ’ থামাতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় আরো অনেকবার তাঁকে গ্রেফতার ও নির্বাসনে পাঠানো হয়। কষ্টকর নির্বাসন ও কারান্তরীণ অবস্থায় তিনি বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘রিসালায়ে নূর’ রচনার কাজ সম্পন্ন করেন। এই তাফসীর গ্রন্থটিতে তিনি ইসলাম সম্পর্কে যুক্তিভিত্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বস্তুবাদ ও কমিউনিস্ট চিন্তাধারার মোকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব এবং এসব মতবাদের সাথে ইসলামের পার্থক্য যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেন।
১৯১৯ সালের পর রাজনীতি থেকে দূরে থাকা নূরসী ১৯৫০ সালের দিকে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি কট্টরপন্থী সেক্যুলারদের বিপরীতে ডেমোক্র্যাটকে সমর্থন করেছিলেন। কারণ, ডেমোক্র্যাটরা ধর্ম ও মৌলিক অধিকারের ব্যাপারে ছিল অনেকটা উদার। এ ব্যাপারে তাঁর ছাত্ররা প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দেন, ডেমোক্র্যাট পার্টি পরাজিত হলে কট্টর সেক্যুলার এবং জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতা দখল করবে। ফলে সামাজিক ও জাতীয় জীবনে এক বড় বিপর্যয় নেমে আসবে। সুতরাং তারা যাতে ক্ষমতা দখল করতে না পারে, তাই আমি আদনান মেন্দারিসকে অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটকে দেশ, ইসলাম ও কোরআন রক্ষার স্বার্থে সমর্থন দিয়েছি।[4]
তবে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেননি, বরং ইসলামের সামাজিক কার্যক্রমকে জোরদার করতে থাকেন। যা পরবর্তীতে ইসলামপন্থী রাজনীতির জন্যে শক্তিশালী ‘ভিত্তি’ হিসেবে কাজ করে। সাঈদ নূরসী জীবনে বহু ধকল সহ্য করেছেন। এমনকি কারাগারে তাঁর খাবারে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টাও করা হয়। ১৯৬০ সালের ২৩ মার্চ তুরস্কের এই মহান ব্যক্তিত্ব মৃত্যুবরণ করেন।
মিল্লি গুরুশ: ইসলামপন্থীদের সম্মিলিত ইশতেহার
প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. নেজিমুদ্দিন এরবাকান সমসাময়িক আলেমদের সমর্থন নিয়ে ১৯৬৯ সালে স্বতন্ত্রভাবে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন। তৎকালীন সকল ইসলামী সংগঠনের সক্রিয় সহযোগিতায় ‘মিল্লি গুরুশ’ (National Vision) নামে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন।[5] এই ইশতেহারকে কেন্দ্র করে ইসলামী সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি সাধারণ প্লাটফরম গড়ে ওঠে। এরবাকান মিল্লি গুরুশকে স্থান-কাল-পাত্রভেদে কাজে লাগাতেন। তাঁর এই আন্দোলন অল্প সময়ে সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করে কোয়ালিশনের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করে। তাঁর আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল:
- অর্থনৈতিক ভিত্তি অর্জন।
- আধ্যাত্মিক উন্নতি। ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া জাতিকে পুনরায় ইসলামের দিকে আহ্বান ও তাদেকে যোগ্য মুসলিম রূপে গড়ে তোলা। বিশেষ করে যুবকদের মাঝে ইসলামের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা।
- ইসলামী ইউনিয়ন গড়ে তোলা ও মুসলিমদেরকে এক প্লাটফরমে নিয়ে এসে সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করা।
১৯৭০-২০০০: এরবাকানের সংগ্রাম
মিল্লি গুরুশের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে এরবাকান ১৯৭০ সালের ২৬ জানুয়ারি ‘মিল্লি নিজাম পার্টি’ (National Order Party) গঠন করেন। বছরখানেকের মধ্যেই একে ইসলামী মৌলবাদীদের দল হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। সেক্যুলারিজম সংক্রান্ত সংবিধানের ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে দলটিকে ১৯৭১ সালের ২০ মে নিষিদ্ধ করা হয়।
তারপর ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবর এরবাকান ‘মিল্লি সালামত পার্টি’ (National Salvation Party) প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ১৯৮০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কোনিয়া শহরে ‘আল-কুদস’ দিবসের সমাবেশ পালনের অভিযোগে মাত্র ছয় দিন পর অর্থাৎ ১২ সেপ্টেম্বর সামরিক ক্যু করে এই পার্টিকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।[6] সেই সাথে দেশে সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৮২ সালে এক বিতর্কিত গণভোটের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়। ১৯৮৩ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ‘মাদারল্যান্ড পার্টি’র একদলীয় শাসন শুরু হয়।
ব্যক্তিগতভাবে এরবাকানের উপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও তিনি দমে যাননি। ১৯৮৩ সালে তিনি ‘রেফাহ পার্টি’ (Welfare Party) গঠন করেন। খুব অল্প সময়ে এই পার্টিও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৭ সালে তাঁর উপর জারি থাকা সকল রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তিনি আবারো আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে আসেন এবং পার্টির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালের স্থানীয় মেয়র নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন।
নেকমেত্তিন এরবাকানের ১১ মাসের শাসনামল নানা মাত্রায় সাফল্যমণ্ডিত। এ সময় ‘ডি-৮’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি কূটনৈতিক বিচক্ষণতা প্রদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি আরব রাষ্ট্রসমূহ এবং ফিলিস্তিনের সাথে সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি ঘটান। এছাড়া দেশের অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে সুদের হার কমানোসহ নানা রকমের গঠনমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী হন।
রেফাহ পার্টির এসব সফলতা সেক্যুলারিস্টদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরবাকান ও তাঁর পার্টি শরীয়াহ কায়েম করবে- এহেন অভিযোগে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য সেনাবাহিনীকে উস্কানি দেয়া হয়। পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন এরবাকান সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা তুলে দিতে বাধ্য হন।
১৯৯৮ সালে সাংবিধানিক আদালত রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করে। পাশাপাশি এরবাকানকেও রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু তিনি মিল্লি গুরুশের অপর নেতা রেকাই কুতানের মাধ্যমে ‘ফজিলেত পার্টি’ (Virtue Party) গঠন করেন। ২০০১ সালে সাংবিধানিক আদালত এ দলটিকেও নিষিদ্ধ করে। তারপর ফজিলেত পার্টির সদস্যরা দুই ভাগ হয়ে যান।
পার্টির নেতৃত্বে থাকা অপেক্ষাকৃত তরুণ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা ২০০১ সালে গঠন করে ‘জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ (একেপি)। অধিকতর রক্ষণশীল অন্য সদস্যরা গঠন করে মূলধারার ইসলামী আন্দোলনধর্মী সংগঠন ‘সাদাত পার্টি’ (Felicity Party)।
২০০১ সালের ২০ জুলাই যাত্রা শুরু করা সাদাত পার্টি রয়ে যায় ইসলামী দল হিসাবে। আর একেপি পূর্ববর্তী দৃষ্টিকোণকে পরিবর্তন করে লিবারেলিজমের আদলে গড়ে ওঠে। যদিও ‘আমরা সবাই মিল্লি গুরুশ ও আমরা হলাম তার পরবর্তী প্রজন্ম’ এই স্লোগান দিয়ে জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে একেপি।
রাজনীতি থেকে সাময়িকভাবে দূরে থাকলেও ড. এরবাকান একেপি এবং সাদাত- উভয় পার্টির তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এ কারণে এরবাকানের বিরুদ্ধে বাম ও সেক্যুলারদের অভিযোগ ছিল, তিনি দুই পার্টি দিয়ে দেশ চালাচ্ছেন। এক পার্টি দেশ শাসন করছে, আর অন্য পার্টি সামাজিক কাজ ও ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত। পরবর্তীতে সাদাত পার্টিতে নেতৃত্ব নিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হলে ৮৪ বছর বয়সে ২০১০ সালে এরবাকান সাদাত পার্টির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ অবস্থায় ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
গুলেনের ‘হিজমেত’ আন্দোলন
ফেতুল্লাহ গুলেনের হাত ধরে তুরস্কে ১৯৬০ সালের দিকে শুরু হওয়া আন্দোলন হিজমেত বা স্বেচ্ছাসেবী আন্দোলন নামে পরিচিত। শিক্ষা, গণমাধ্যম, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ইত্যাদি নানা ধরনের সামাজিক কার্যক্রম তারা পরিচালনা করে। এই আন্দোলনের আওতায় সেক্যুলার কারিকুলাম অনুসারে তুরস্কে তিন শতাধিক এবং বিশ্বের ১৪০টি দেশে সহস্রাধিক স্কুল পরিচালিত হচ্ছে।[7] এছাড়া তুর্কি ও ইংরেজি ভাষায় বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া প্রতিষ্ঠান এই আন্দোলনের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে Cihan News Agency’র মতো প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মিডিয়া গ্রুপও রয়েছে। ’৯০-এর দশকে হান্টিংটনের ‘সভ্যতার সংঘাত’ তত্ত্বের বিপরীতে গুলেনের ‘আন্তঃধর্মীয় সংলাপ’ এই আন্দোলনকে বেশ জনপ্রিয় করে তোলে। ১৯৯৮ সালে ফেতুল্লাহ গুলেনের আয়োজনে দেশের সেক্যুলার ও ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। যা দেশে-বিদেশে সবার নজর কাড়ে।
সরাসরি সক্রিয় না হওয়া সত্ত্বেও তুরস্কের রাজনীতিতে এই আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে। ইসলামের অনুকূলে এরবাকান সরকার কর্তৃক গৃহীত নানা পদক্ষেপের কঠোর সমালোচক ছিলেন ফেতুল্লাহ গুলেন। তবে একেপি গঠন ও একেপি সরকারের প্রাথমিক পর্যায়ে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় গুলেন আন্দোলন। সেক্যুলার সংবিধানের মূলনীতি মেনে চলা, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও চ্যারিটিভিত্তিক আর্থ-সামাজিক গতিশীলতা আনয়ন- এসব ইস্যু উভয়ের মধ্যে ঐক্যমত গড়ে উঠতে সাহায্য করে।[8]
নতুন সহস্রাব্দের উল্লেখযোগ্য ঘটনা
- ২০০২ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আইনি জটিলতা কাটিয়ে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ২০০৩ সালের ১৪ মার্চ তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
- ২০০৭ সালের এপ্রিলে সেক্যুলাররা এরদোয়ানের ইসলামী ব্যাকগ্রাউন্ডের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তবে ধর্মীয় উদারতা ও কুর্দীদের প্রতি সহনশীল নীতি অবলম্বনের ফলে সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠী ও কুর্দীদের মধ্যে জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ওই বছরের নির্বাচনে সাড়ে ৪৬ শতাংশ ভোট পেয়ে একেপি জয় লাভ করে।
- বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে হেডস্কার্ফ পরিধানের অনুমতি দিয়ে আইন সভাতে পাস হওয়া একটি আইন ২০০৮ সালের জুন মাসে বাতিল করে দেয় তুরস্কের সাংবিধানিক আদালত। অবশ্য আন্দোলনের মুখে পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে এ ব্যাপারে আইন কিছুটা শিথিল করা হয়।
- ২০১০ সালের মে মাসে তুরস্ক অবরুদ্ধ গাজায় ‘ফ্লোটিলা’ নামক ত্রাণবাহী জাহাজ পাঠায় যা ইসরাইলি হামলার শিকার হয়। একই বছরের জুলাইয়ে সেনাবাহিনীর সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৯৬ জনকে ক্যু করে ক্ষমতা দখল প্রচেষ্টার জন্যে আদালত অভিযুক্ত করে।
- ২০১০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সংবিধান সংশোধনের জন্যে অনুষ্ঠিত গণভোটে সেনাবাহিনী ও সাংবিধানিক আদালতের অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা সংকুচিত করা, কিছু স্বৈরতান্ত্রিক ধারায় পরিবর্তন আনা এবং ইইউ’র সদস্যপদ অর্জনসহ ২৬টি ধারা সম্বলিত একটি প্যাকেজ প্রস্তাব পাশ হয়। যদিও ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার গোপন কূটনীতির কারণে ইইউ’তে তুরস্কের সদস্যপদ আটকে আছে বলে নভেম্বর মাসে উইকিলিকসের ফাঁস করা এক নথি থেকে জানা যায়।
- ২০১১ সালের ১২ জুনের বহুল আলোচিত নির্বাচনে একেপি প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত হয়।
- ২০১৩ সালে একেপি ও গুলেনের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। মে-জুন মাসে সেক্যুলারদের ‘সরকার বিরোধী আন্দোলন’ কয়েকটি শহরে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে দেশে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। ডিসেম্বর মাসে দুর্নীতির অভিযোগে এরদোয়ান সরকারের তিন মন্ত্রী পদত্যাগ করে, যা ঐ সময় সরকারকে কিছুটা হলেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়।
- ২০১৪ সালের মার্চে গুলেন নিয়ন্ত্রিত সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সংসদে বিল পাশ হয়।
- ২০১৩ সালের সরকার বিরোধী আন্দোলনে আহত এক যুবকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পুনরায় দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। তা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ান নির্বাচিত হন।
- ইরাক ও সিরিয়ার কিছু অংশ নিয়ে গড়ে উঠা কট্টরপন্থী গ্রুপ ISIS দমনে চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ন্যাটো’র সাথে শর্তসাপেক্ষে যুক্ত হতে সম্মত হয় তুরস্ক।
একেপি’র সফলতা
এরদোয়ানের সময়ে তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিস্ময়করভাবে বেড়েছে। ক্রয় সক্ষমতা (পিপিপি) অনুযায়ী তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১৬৭ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৪ সালে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৯৫ ডলারে।[9]
তুরস্কের এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মধ্য এশিয়াসহ মুসলিম বিশ্বে বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করেছে। ২০১২ সালে তুরস্ক মুসলিম বিশ্বে বিনিয়োগ করেছিল ২২২ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ২০১৩ সালের হিসাবে, তুরস্ক মুসলিম বিশ্বে মানবাধিকার সহায়তা প্রদান করে ১.৯ বিলিয়ন ডলার। যেখানে সৌদি আরব করেছিল ১.৬ বিলিয়ন ডলার। বৈশ্বিকভাবে মানবাধিকার সাহায্য দেয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কের (১.০৪ বিলিয়ন ডলার) অবস্থান চতুর্থ।[10]
একেপি’র জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে, যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন তারাই এ দলের নেতৃত্ব আছেন। ফলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় একেপি’র ভূমিকাকে জনগণ সমর্থন করে। ‘ইসলাম গণতন্ত্রের শত্রু নয় কিংবা গণতন্ত্র ইসলামের বিরোধী নয়’– এই বিষয়টি একেপি বাস্তবায়ন করে দেখাতে পেরেছে।
তারা সীমিত পরিসরে মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যবস্থা ও তার আধুনিকায়ন করেছে। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সরকারের সহযোগিতায় নারীরা হিজাব পড়ার অধিকার ফিরে পেয়েছে। এছাড়া ২০১৪ সালে গাজায় ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও একেপি জোড়ালো অবস্থান নিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও সেখানকার দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করতে পিছপা হয়নি।
পর্যালোচনা
- সেক্যুলারিজমের ঝড়: সেক্যুলারিজমের তিনটি মডেল বিভিন্ন দেশে চর্চা হচ্ছে: রেডিক্যাল ফরাসী মডেল, মডারেট বৃটিশ মডেল ও লিবারেল আমেরিকান মডেল। আধুনিকতার নামে ফ্রেঞ্চ রেডিক্যাল সেক্যুলারিজমের মডেলটি কঠোরভাবে তুরস্কের জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। অন্য কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের জনগণকে এ রকম প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি।
- অরাজনৈতিক ধর্মীয় গণশিক্ষা পদ্ধতি: রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত চরম ধর্মবিরোধী নীতির প্রেক্ষিতে বদিউজ্জমান নূরসী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসলাম সম্পর্কে আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতি-নিরপেক্ষ ধর্মীয় শিক্ষা পদ্ধতির অনুসরণ করেন। ফলে তুরস্কের সমাজ ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠে এবং ইসলামের প্রভাব ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হতে থাকে। এক পর্যায়ে রাষ্ট্র-আরোপিত ধর্মহীনতাবাদ ক্রমান্বয়ে সহনশীল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে রূপ লাভ করে।
- ধর্ম সমর্থনকারীদের দৃশ্যমান নীতিগত ঐক্য: চরম প্রতিকূল অবস্থায় এরবাকানের ‘মিল্লি গুরুশ’কে কেন্দ্র করে ইসলামপন্থীদের মধ্যে আদর্শ ও নীতিগত যে ঐক্য-চেতনা গড়ে উঠে, তা মোটাদাগে এখনো সক্রিয়। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে মতানৈক্য দেখা গেলেও ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে তুরস্কের ইসলামপন্থীদের মধ্যে তেমন কোন দ্বিমত পাওয়া যায় না। যুগপৎভাবে সরকারী ও বিরোধী দলে ইসলামপন্থীদের নানা মাত্রায় প্রভাব লক্ষ করা যায়।
- অর্থনৈতিক সফলতাকে গুরুত্বারোপ: গত এক দশক ধরে ৫ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছে তুরস্ক। সমকালীন বিশ্বমন্দা ইউরোপের বাজারকে স্তিমিত করে দিলেও তুরস্ক তার অর্থনীতিকে উন্নয়নের ধারায় ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। যদিও বর্তমান অনিশ্চিত পরিস্থিতি ও ভূরাজনৈতিক ইস্যুগুলোর কারণে তৃতীয় প্রান্তিকে এসে তারা জিডিপি’র লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ অর্জন করতে পারেনি। ব্যাংক ঋণের লাগাম টেনে ধরার জন্য সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা আগের তুলনায় কিছুটা খারাপ। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে সফল হলে তুরস্কের অর্থনীতি আরো গতি পাবে বলে আশা করা যায়।
- জাতির সামনে বৃহত্তর লক্ষ্যকে হাজির করা: মানযিকার্ট যুদ্ধের এক হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ২০৭১ সালকে তুরস্কের লক্ষমাত্রার বছর হিসেবে এরদোয়ান ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন। যা তুরস্কের জনগণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে বেশ উজ্জীবিত করেছে। গত এক দশকের বেশি সময় থেকে তুরস্ক স্বীয় পররাষ্ট্র নীতিকে ঢেলে সাজিয়েছে। গাজা ইস্যুতে তুরস্কের ভূমিকা, আরবি ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে চালু করার সংকল্প ঘোষণা, পাকিস্তানে সামরিক কর্তৃপক্ষ পরিচালিত স্কুলে তালিবান হামলায় নিহতদের স্মরণে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণাসহ নানা ধরণের ত্বড়িৎ ও সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা মুসলিম বিশ্বের শীর্ষনেতৃত্ব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রভাবে তখন ইসলামের সময়োচিত ব্যাখ্যা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো। তৎকালীন উসমানীয় খেলাফতের রক্ষণশীল কার্যক্রম ইসলামী মূল্যবোধ ও ভাবাদর্শের গতিশীলতাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে এক সময়ের প্রতাপশালী সাম্রাজ্যে ভাঙ্গনের শুরু হয়। মুসলিম সাম্রাজ্যের নেতা তথা খেলাফতকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিচালনাকারী হিসেবে উসমানীয়দের বিভিন্ন অদূরদর্শীতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুরো মুসলিম বিশ্বে। এক পর্যায়ে কামাল আতাতুর্কের মত আধুনিকমনস্ক তুর্কী নেতৃত্ব প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান গ্রহণ করে স্বীয় ইসলামী ঐতিহ্যের বিরুদ্ধেই খড়গহস্ত হয়ে উঠেন।
ইসলাম চর্চার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সাঈদ নূরসীর মতো তাত্ত্বিক-কর্মবীর ইসলামের সর্বজনীন ব্যাখ্যাকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে তুলে ধরতে সমর্থ হন। এ কারণে, দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মহীনতার চর্চা হলেও তুরস্কের সমাজ থেকে ইসলাম হারিয়ে যায়নি। বর্তমান তুরস্কের রাজনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ‘ইসলামী বহুত্ববাদে’র মূর্ত প্রতীক হিসাবে সেক্যুলারিজমের পথ ধরে ইসলামের সময়োপযোগী ব্যাখ্যাগুলো ধীরে ধীরে সুধীসমাজ ও সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
একবিংশ শতাব্দীর শুরু হতে একেপির মতো ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল দলের ধারাবাহিক বিজয় বিশ্বের মুসলিম রাজনীতির জন্যে একটা ভাল উদাহরণ হতে পারে। অবশ্য সরকারের প্রতি জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও এরবাকানের টিকে থাকতে না পারাটা একেপি’র জন্যে সতর্কবার্তা। এরদোয়ানের মত প্রাজ্ঞ নেতা বর্তমান তুরস্কের তরুণ প্রজন্মকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নই শুধু দেখাচ্ছেন তা নয়, এর সাথে সাথে তুরস্ককে ভবিষ্যত পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্য করে গড়ে তোলার কাজ ইতোমধ্যে শুরু করেছেন। তুরস্ক সরকারের নানা ধরণের সাহসী পদক্ষেপের ফলে বিশ্বগণমাধ্যম কর্তৃক এরদোয়ানকে ‘নতুন খলিফা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
অর্থনীতির উন্নয়ন, প্রবল জনসমর্থন নিয়ে সাহসী রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ ও দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতির সমন্বয়ে তুরস্ক এমন একটা অবস্থানে এসেছে যার ফলে তারা মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শক্তিশালী সমরতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসায় সক্ষম হয়েছে। তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের সেই সব দেশগুলোর অন্যতম যারা নিপীড়ক সেনাবাহিনী, চরম বিরূপ বিচার বিভাগসহ উল্লেখযোগ্য সব বিরোধী শক্তিকে সহনশীল মাত্রায় নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রায়োগিক কর্মনীতি অনুসরণের মাধ্যমে তারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’কে এ পর্যন্ত অকার্যকর প্রমাণ করেছে।
তুরস্ক তার গৃহীত এসব পদক্ষেপ সফলতার সাথে বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখতে পারলে বিশ্ব রাজনীতি এক নতুন সমীকরণ তৈরী হবে। কৌশলগত কারণে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রের তালিকায় থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের পাশাপাশি শক্তিশালী কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের উত্থান পরাশক্তিগুলো কতটুকু সহ্য করবে সেটা অবশ্য দেখার বিষয়। সাবেক প্রতিপক্ষ রাশিয়ার সাথে তুরস্কের দৃশ্যমান সাম্প্রতিক বন্ধুত্ব কতদিন টিকে সেটাও দেখার বিষয়। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ নিয়ে জটিতার অবসান এখনো শেষ হয়নি। এসব বৈদেশিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও পরিপক্ক ও সময়োচিত নীতির কারণে তুরস্ক আজ এপর্যন্ত আসতে সক্ষম হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে তুরস্ক তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
রেফারেন্স:
[1] Grant, R.G. Battle a Visual Journey Through 5000 Years of Combat. London: Dorling Kindersley, 2005. p. 77
[2] Mango, Andrew. Atatürk. John Murray Publishers Ltd., 1999. p. 214
[3] Feroz, Ahmad. The Making of Modern Turkey. Routledge, May 21, 1993. p. 50
[4] " target="_blank">২০১৪ সালের ২ জুন তুরস্কের ইস্পারতায় দেওয়া রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানের বক্তব্য
[5] Atacan, Fulya. Explaining Religious Politics at the Crossroad: AKP-SP.Turkish Studies 6 (2). Routledge, 2005. p. 187–188.
[6] তুরস্কে ইসলামী আন্দোলন
[7] Turkish Islamic preacher – threat or benefactor?
[8] Gulen, Erdogan and democracy in Turkey: What will come out of the struggle between the Gulen movement and the AKP?
[9] Turkey: OECD Data
[10] Turkey’s rise from aid recipient to mega-donor
সূত্র: সিএসসিএসবিডি.কম