মাওলানা লাবীব আবদুল্লাহ, অতিথি লেখক আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
ইলমের পথে প্রথম প্রয়োজন রাহবরের৷ রাহনুমার৷ যিনি কল্যাণকামী৷ অভিজ্ঞ ইলমের অলিগলি সম্পর্কে৷ আপনি যদি হিফয শেষ করে কিতাব বিভাগে পড়ার ইচ্ছে করেন তাহলে প্রথমে তাইসীর জামাত, খুসুসী জামাত বা মাদানী নেসাবের প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে পারেন৷ সাধারণত তাইসীর জামাতে উর্দু ফার্সী কিতাবের মাধ্যেমে শুরু হয় ইলমী সফরের৷ মাদানী নেসাব শুরু এসো আরবী শিখির মাধ্যমে৷
যদি মেখল পদ্ধতিতে পড়া শুরু করেন তাহলে উর্দুখানা, ফার্সীখানার পথে চলতে হবে দু এক বছর৷ এটি ইলমের পথের ভাষা শেখার জামাত৷ উর্দু, ফার্সির এই শেখা চলবে হেদায়াতুন্নাহু জামাত পর্যন্ত৷ চার বছরে উর্দু ও ফার্সীর ১০/১৫ টি কিতাব পড়তে হবে৷ আরবী ভাষা শেখার ব্যাকারণগত কিতাব নাহু সরফের মূল কিতাব সবগুলো ফার্সীতে৷ ফার্সী ভাষায় রচিত তাইসীরুল মুবতাদী, মাছদার ফায়ূজ, ফার্সী পহেলী, মীযান, মুনশাইব, কারীমা, পান্দেনামা, গুলিস্তা, বুঁস্তা, নাহবেমীর, সরফে মীর, পাঞ্জেগঞ্জ, ইলমুস সীগা ইত্যাদী৷ প্রবীন উলামায়ে কেরাম সাধারণত নাহু সরফের কিতাব মুখস্ত করতেন ফার্সী ভাষায়৷ যদিও তাজ্জাবের কথা৷ মনে হবে অসম্ভব৷ কিন্তু বাস্তবতা হলো সেই কিতাবগুলো উর্দু অনুবাদ করা হতো প্রথমে ফার্সী থেকে এরপর বাংলায় তকরীর করে বোঝিয়ে দিতেন উস্তাযজী৷ এতে উর্দু ফার্সী ভাষা চর্চায় এসে যেতো৷ পদ্ধতিটি জটিল মনে হতে পারে এই যামানার তালেবে ইলমের কাছে৷ দুই দশক আগেও এই ফার্সী থেকে উর্দু তরজমার যুগ ছিলো৷ যারা দরসি কিতাবগুলো অনুবাদ করে ইলম ধ্বংস করছেন সেই হালাকীরা সেই উর্দু ফার্সী প্রজন্মের৷ তাঁরা আর্থিক লাভমান হলেও ইলম শেখার নামে প্রচুর প্রতারণা হচ্ছে সহজ সিরিজ বা নানা মাকতাবার দরসি কিতাবের বাংলা প্রকল্পের কারনে৷
বাংলা বাজারে বা চকবাজারে সেইসব বাংলা তরজমার কিতাব এখন প্রতারণার ফাঁদ৷ এইসব বাংলা নোট বা বাংলা শরাহ পড়ে কখনও গভীর ইলমের অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়৷ সম্ভব নয় বিজ্ঞ আলেম হওয়া৷ প্রাজ্ঞ হওয়া৷ মাকতাবাগুলোর কাছে এই তালেবে ইলমরা ভালো গ্রাহক৷ আগামী একমাসে মাকতাবাওয়ালারা কোটিপতি হলেও তালেবে ইলমের ইলমী জীবনের ধবংসের শুরু হবে সেই বাংলা নোট কিনে ইলমের পথে চলতে চাইলে৷ তবে সেইসব বাংলা নোট পড়লে আমাদের বোর্ডগুলোর মেধাতালিতায় শততম স্থান পেয়েই তৃপ্তির ঢেকুর তোলা যাবে৷ আত্মতৃপ্তিতে ঢেকুর তুলতে পারবে মাদরাসা কর্তপক্ষে৷ বলবে আমরাই মেধাতালিকায় শীর্ষে দেশে৷ আমরা একশটা মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছি এবং সিরিয়ারে একশত একতমও আছে মেধা তালিকায়৷ তালেবে ইলম এই মেধা তালিকার প্রতারণায় পড়ে ইলমী জীবন বরবাদ করবে এবং যখন হাদীস, ফিকহ ও তাফসীরে তাখাসসুস করবে তখন এই বরবাদি সম্পর্কে নিজেই সব উপলব্দি করতে পারবে তিন্তু তখন করতে হবে শুধুই আফসোস৷ অনুতাপ৷ সহজ পথে হাঁটতে গিয়ে মূলত চলা হয়েছে ভুল পথে এবং উল্টো পথে৷
একজন তালেবে ইলমকে কওমী মাদরাসার জামাত, দরস বা মারহালাগুলোর অলিগলি সম্পর্কে জেনে নিতে হবে৷ ইলমের নানা স্তর সম্পর্কে জেনে নিতে হবে৷ চোখ বন্ধ করে তাইসীর থেকে তাকমীলের পথে নয় বছর চলতে গিয়ে পিপথে চলা যাবে না৷ প্রথমেই ইলমের মানচিত্র জেনে নিতে হবে৷ জানতে হবে অভিজ্ঞদের সাথে কথা বলে৷ সাধারণত কওমী নেসাবের ভুলত্রুটি সম্পর্কে কেউ মুখ খোলতে রাজি নয়৷ সবকিছু জেনেও নীরব থাকেন অনেকে৷ নিরাপদ পথ বেছে নিয়ে নিজের ছেলেদের জন্য ভিন্ন পথ নির্বাচণ করে নেন৷
একজন তালেবে ইলমকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ইলমের পথের প্রথম ধাপ জানতে হবে৷ উর্দু ফার্সীরও প্রয়োজন আছে৷ প্রয়োজন আরবীরও৷ সমন্বয় করতে হবে সতর্কতার সাথে৷ হাফেয তালেবে ইলমরা ইচ্ছে করলে ইলমের প্রাথমিক জামাতগুলোতে কী পড়ানো হয়? কেন পড়ানো হয়? কীভাবে পড়ানো হয়? এইসব তথ্য জেনে নিতে পারেন উচ্চস্তরে কোনো মেধাবী ছাত্র ভাইয়ের কাছেও৷ জানতে পারেন যারা দাওরায়ে হাদীস শেষ করে উচ্চ শিক্ষা শুরু করেছেন তাদের কাছেও ইবতেদায়ি মারহালার কিতাব ও বিষয়াবলী সম্পর্কে জানতে পারেন৷ তবে কওমী মাদরাসার সিলেবাস নিয়ে সাধারণত কেউ কথা বলতে রাজি নয়৷ এই কথা না বলাটা কিন্তু নীরবে পিছিয়ে পড়ার কারণ একুশ শতকে৷
দরসে নেজামী হোক বা মাদানী নেসাব বা সমন্বিত কোনো খিঁচুরি নেসাব আপনি একজন তালেবে ইলম হিসেবে তথ্য জানার অধিকার রাখেন৷ যদিও অভিভাবকগন এই জানার কোনো আগ্রহ বা চেষ্টা করেন না৷ একজন তালেবে অলমের ভিত্তিমূলক জামাতগুলো যদি ভালো না হয় তাহলে সেই দাওরা ফারেগ কিন্তু ইবারত পড়তে পারেন না প্রজন্মের সংখ্যা বাড়বে দিন দিন৷ আমাদের মাদরাসায় মেলা ছাত্র!, এবার অনেক ছাত্র! আমরা ছাত্র জায়গা দিতে পারছি না! এইসব বাজে কথায় মন দেওয়া যাবে না৷ কোন জামাতে বা শ্রেণিতে কতজন তালেবে ইলম মাদরাসায় ভর্তি করা হলো সেটিও জানতে হবে তালেবে ইলমকে৷ তাইসীর বা মীযান নাহমীর জামাতে ২৫:১ অনুপাতে ছাত্র হতে পারে৷ প্রতি পঁচিশ জনের জন্য একজন শিক্ষক৷ পঁচিশের বেশি হলে পৃথক শাখা৷ যেমন হিফয বিভাগে একজন হাফেয উস্তাযের ভাগে ছাত্র থাকে ১৫/২০ জন৷ কিন্তু খুসুসী বা তাইসীর জামাতে যদি ৮০/৯০ জন তালেবে ইলমের জন্য একজন উস্তায হোন তাহলে প্রতি দশজনে একজন বেড়ে ওঠবে ভালো হয়ো বাকীরা সেই দাওরা ফারেগ প্রজন্ম যারা ইবারতই পড়তে পারেন না!
ভর্তির ক্ষেত্রে আমরা কোথায় বেশি ছাত্র এবং বোর্ডিংএ উন্নত তিনবেলা সেই পথে ভুঁ দৌড় দেই৷ কিন্তু কয়েক দিন পর হতাশা৷ ডিপ্রেশনে৷ তিন মাস পর সেই হাফেয তালেবে ইলমরা অন্ধকার দেখেন খুসুসী জামাতে৷ উর্দু ফার্সীর সাথে বোর্ডের মানহীন পাঁচ বছরের সিলেবাস এক বা দুই বছরে পড়তে গিয়ে মানসিক রোগী হয়ে আলিয়ার অন্ধকার পথে যাত্র শুরু করার স্বপ্ন দেখে৷ ইলমের পথে চলতে গেলে প্রথমেই নিতে হবে পথের খবর, পথের ভালোন্দ দিক৷ মনে রাখতে হবে ইলমের সংক্ষিপ্ত কোনো পথ নেই৷ নেই শর্টকোর্স৷ ইলমের পথ দীর্ঘ এবং অনেক পথ পারি দিতে হয়৷ রাহবর, নাহনুমা ও গাইড ছাড়া এই পথ চললে পথ হারিয়ে বিপথে চলার সম্ভাবনাই বেশি৷
সচেতন তালেবে ইলম না হলে শুধু পথ চেনে না এমন কারোর কথার ওপর বিশ্বাস করে ইলমের পথ চলতে গেলে আপনি হতাশ হবেন৷ ময়দানে তিহ এর মতো চলতে হবে উদ্ভান্ত ও বিভ্রান্ত হয়ে৷ সময়৷ সময়ই জীবন৷ ইলমের পথে সময় অপচয় করা যাবে না৷ নষ্ট করা যাবে না৷ সময় অপব্যায়
সময় পূঁজি৷ এই পূঁজি পাথেয় পথ চলার৷ সঠিক পথে পরিচালিত করবেন আল্লাহই৷ তিনিই ইলমদাতা৷ আলীম৷ হাকীম৷
ইলমের মহাসগর থেকে একবিন্দু ইলমের জন্য পারি দিতে হবে সিন্ধু৷ মহাসিন্ধু৷ সাতসাগরের মাঝি হয়ে চলতে হবে সিন্দাবাদের মতো৷ নাবিক তোমাকে হতে হবে যুগের নাকীব৷ যুগের গাযালী, রাজী, রুমী সাদী, থানুবী মাদানী৷ হতে হবে ইবনে সিনা ও ইবনে খালদুন৷ চলবে...
লেখক: পরিচালক, মাদরাসা ইবনে খালদুন ময়মনসিংহ ১৯/৭/২০১৬ সকাল: ৬:৩০
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম/আরআর