ফারুক ফেরদৌস: ‘এই উপত্যকায় ঈদ নেই। কবরখানায় জায়গা নেই। এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে একজনও শহিদ নেই।’ কথাটি কাশ্মিরের নারী তাবাসসুমের। তিনি ‘বিতর্কিত বিচারে’ হত্যাকাণ্ডের শিকার আফজাল গুরুর স্ত্রী।
সাংবাদিকদের কাছে তিনটি বাক্যে কাশ্মির পরিস্থিতির নিখুঁত চিত্রায়ন এভাবেই করলেন তিনি। এটা আজকের বা গত সাপ্তাহ খানেকের পরিস্থিতি না। বছরের পর বছর ধরে এমনই চলে আসছে কাশ্মিরে। ঈদ নেই, কবরখানায় জায়গা নেই, শহিদহীন কোনো বাড়ি নেই। কবর আর শহিদের জনপদ কাশ্মির। ছবিতে কাশ্মিরকে খুব সুন্দর দেখায়। কাশ্মিরের প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোরম। কাশ্মিরকে বলা হয় ভূস্বর্গ। এই সবুজ শ্যামল মনোরম প্রকৃতির আড়ালে রক্ত আর অশ্রুর চড়া পড়ে পড়ে পুরু হয়েছে গত ছয় দশক ধরে।
কতবার লাল হয়ে আবার সবুজ হয়ে উঠেছে কাশ্মিরের জমিন! কত লাশ ঝিলাম নদীতে হারিয়ে গেছে গত ৬০ বছরে! গত বছরের ডিসেম্বরে বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে প্রকাশিত কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিস এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা জম্মু-কাশ্মীরে ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৯৪ হাজার ২৯০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে ভারতীয় বাহিনী। এদের মধ্যে সাত হাজার ৩৮ জন মারা গেছে ভারতীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায়। ২২ হাজার ৮০৬ জন নারী বিধবা এবং ১০ লাখ সাত হাজার ৫৪৫ জন শিশু এতিম হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী ১০ হাজার ১৬৭ জন নারীকে ধর্ষণ করেছে এবং প্রায় ১০ লাখ বসতবাড়ি ও ভবন ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আট হাজার নিরপরাধ মানুষ ভারতীয় কারাগারে থাকা অবস্থায় নিখোঁজ হয়ে গেছে।
এই পরিসংখ্যানটি দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। এই জুলুম নির্যাতনের মহোৎসব যে চলছে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তেমন উচ্চবাচ্য নেই। কাশ্মিরিদের জীবনের যেন কোন মূল্য নেই। এরা মরে লাশের পর লাশ জমে পাহাড় হয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো গুরুত্বের সাথে নিউজ করতেও সীমাহীন ঔদাসিন্য দেখায়। পাঁচ দশ জন কাশ্মিরির মৃত্যু কোনো নিউজ না। অল্প স্বল্প তো মরবেই! এ আর নতুন কি! সেই কত বছর ধরেই তো মরে আসছে!
গত কয়েকদিন ধরে আবার রক্ত বন্যায় ভাসছে কাশ্মির। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে রাজপথে গড়াচ্ছে মানুষের টকটকে লাল তাজা রক্ত। কাশ্মির এবার উত্তাল হয়ে ওঠে হিজবুল মুজাহিদিনের কমান্ডার বুরহান ওয়ানি পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার প্রতিবাদে। স্বাধীনতাকামী এই যোদ্ধার জানাযায় উপচে পড়া ভিড়ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কাশ্মিরের জনগণ কী চায়? বুরহান ওয়ানি কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে হয়ে উঠেছিলেন। স্বাধীনতাকামী লড়াইয়ে তরুণ কাশ্মিরিদের উদ্বুদ্ধ করতে নিজের যোদ্ধা জীবনের বিভিন্ন ছবি ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে পোস্ট করতেন তিনি। স্থানীয় তরুণদের অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন বুরহান। কাশ্মিরের মানুষ এই ২২ বছরের তরুণ স্বাধীনতাকামীর মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না। টানা পাঁচদিন কেটে গেছে তবু বিক্ষোভ চলছেই। আর নিরস্ত্র কাশ্মিরিদের পাথরের জাবাবে ভারতীয় বাহিনী ছুড়ছে গুলি। নির্বিচারে মানুষকে হত্যা করছে। আহতদের বহনকারী এম্বুলেন্সে হামলার মত নৃশংসতা দেখাচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। চারদিনে প্রায় অর্ধশত কাশ্মিরি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শত শত। কারফিউ জারি করা হয়েছে। ইন্টারনেট ও সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবু মানুষকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। জম্মু-কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ মন্তব্য করেছেন, কবরের বুরহান জীবিত বুরহানের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। জীবিত বুরহানকে ছাপিয়ে যাবে মৃত এই বুরহানের ক্ষমতা।
বিশ্বের স্বঘোষিত মোড়লরা যারা জায়গায় বেজায়গায় ইনসাফ কায়েম করার জন্য নাক গলাতে ব্যস্ত থাকেন কাশ্মির পরিস্থিতি নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কাশ্মিরে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চলছে সপ্তাহ পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই ইস্যুতে একটা বিবৃতি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার ভদ্রতাও দেখাচ্ছেনা মোড়ল রাষ্ট্রগুলো। জাতিসংঘ যথাযথ পদক্ষেপ নিলে বহু আগে কাশ্মির সংকটটি একটি সুরাহার মুখ দেখতো। এই সংকটকে ইচ্ছাকৃতভাবে ৬০ বছর ধরে জিইয়ে রাখা হয়েছে। একটি অবাধ সুষ্ঠু গণভোট বহু বছর আগেই এই সমস্যা সমাধান করে ফেলতে পারতো। সমাধানের পথে না হেঁটে কথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত বছরের পর ধরে কাশ্মিরকে কয়েদখানা বানিয়ে রেখেছে। ৮৫, ৮৬৬ বর্গমাইল আয়তনের কাশ্মিরে জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি। ভারতীয় দখলদাররা এই এক কোটি মানুষের জন্য সেখানে ৫ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে। সারা পৃথিবীতে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। বলা যায় বন্দুকের নলের মুখে এক প্রকার জিম্মি করে রাখা হয়েছে এক কোটি কাশ্মিরিকে। এই অবরুদ্ধ জনপদে ভারত আবার নির্বাচনের তামাশা করে!
গত কয়েকদিনের বিক্ষোভে আহত-নিহতদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। তাদের বয়স ১৬ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে। বুরহান ওয়ানির শাহাদাত কাশ্মিরের তরুণদের গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি কাশ্মিরি বাবা-মায়েদের তাদের অল্পবয়সী সন্তানদের বাড়ি থেকে বের হতে না দেয়ার আবেদন জানালেও শহিদ আফজাল গুরুর স্ত্রী তাবাসসুম বলেছেন, কিশোর পুত্রকে বিক্ষোভে যেতে বাঁধা দেন না তিনি। পড়াশোনা করে তো সেই ভারত সরকারের জন্যই কাজ করতে হবে। পড়াশোনা করে ভারতের গোলামি করার চেয়ে আজাদ কাশ্মীরের জন্য লড়াইকেই ভালো মনে করেন তাবাসসুম। স্বাধীনতার এই প্রবল আকাঙ্ক্ষী মায়েদের পুত্ররা একদিন নিশ্চই মাতৃভূমির জন্য আজাদির সূর্য ছিনিয়ে আনবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর