ইউসুফ সুলতান : এক. ঢাকার গুলশানে যা হয়েছে আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। কেউ যদি সেটাকে ইসলামের নামে বা ইসলামের সাথে মেলানোর চেষ্টা করে থাকে, তা সন্দেহাতীতভাবে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা, উলামায়ে কিরাম এর সাথে বিন্দুমাত্র একমত নন।
যে ছেলেগুলো জড়িত ছিল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেইসবুকে প্রকাশ পাচ্ছে, তাদের সম্পর্কে জেনে তাদের অধিকাংশকেই বিলাসবহুল পরিবারের ছেলে বলে মনে হয়েছে। যাদের জীবন-অধ্যায়ে ছিল গান, ক্লাব, নাচানাচি, ফুটবল আর দুনিয়ার তাবৎ আমোদ-ফুর্তি। হঠাত গায়েব হয়ে তিন-চার মাসের শর্ট কোর্স গ্রহণ করে এসব হামলা চালিয়েছে তারা। এত অল্প সময়ে দ্বীনের সামষ্টিক জ্ঞান যে কোনোভাবেই অর্জন সম্ভব নয়, এতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
তাদের জীবনকে সামনে রাখলে ঘটনাটি তাদের কাছে সেসব ভিডিও গেইমের বাইরে কিছু নয়, যা তারা প্রতিনিয়ত খেলে থাকে। মানুষ মারাকে তাদের কাছে বড় কৃতিত্বের ব্যাপার মনে হয়েছে, আবার সাথে আল্লাহর নাম জুড়ে দিলেই ভেবে নিয়েছে জান্নাত নিশ্চিত। অথচ, আল্লাহর নাম নিলেই যে কোনো হারাম ‘হালাল’ হয়ে যায় না, আল্লাহর কালাম পড়ে তা তাদের বুঝার সময় ও সুযোগ কোনোটিই হয় নি।
দুই.
এই ছেলেগুলোর এ পরিণতির পেছনে অনেকে অনেক কারণ খুঁজে পাবেন। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ মনে হয়েছে উলামায়ে কিরাম থেকে এদেরকে দূরে সরিয়ে রাখা। মোটা দাগে উলামায়ে কিরাম থেকে সাধারণ মানুষকে দূরে সরানোর পেছনে আমার ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণে যাদের প্রভাব বেশি চোখে পড়েছে:
১. সরকার (বর্তমান/ সাবেক) সমর্থিত কিছু মন্ত্রী, প্রভাবশালী ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা: যারা ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকে তাদের বিভিন্ন বক্তব্যে ও লেখায় কওমী মাদ্রাসাকে জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করে থাকে। কোথাও কিছু হলেই মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের হেনস্থা করেছ। এরা সমাজের মানুষকে বরাবরই উলামায়ে কিরাম থেকে দূরে রাখতে হেন কাজ নেই যে করে না।
৫ই মে ২০১৩ কাপুরুষের মতো হাজার হাজার বুলেট খরচ করে নিরস্ত্র-তাসবীহ হাতে এসব উলামায়ে কিরামকে কথিত 'নিধন' করতে অপারেশন চালানো হয়েছে। ইতোপূর্বে গত সরকারের আমলে জেএমবি ভূত চাপার পর সব অভিযোগ উলামায়ে কিরামের ওপর ফেলেছিল। সাধারণ মানুষের কাছে তাদের পরম হিতাকাঙ্ক্ষী উলামায়ে কিরামকে ভিলেন সাজিয়েছে। বাসে-সিএনজিতে কোনো মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক বা দাড়ি-টুপির কেউ বসলে পর্যন্ত মানুষ সরে গিয়েছে - এ পরিস্থিতিও আমাদের দেখতে হয়েছে।
২. তথাকথিত কিছু দ্বীনী ভাইয়েরা: যারা মানুষকে সুনির্দিষ্ট ফিকহ বা সুনির্দিষ্ট উসূলের উলামায়ে কিরামের অনুসরণে নিরুৎসাহিত করেন। তাদের কার্যক্রমের কারণে ধীরে ধীরে উলামায়ে কিরাম থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে গেছে অনেকাংশেই। মসজিদে মসজিদে এখন অসন্তোষ চলে, একে অপরকে সামান্য মাসয়ালাগত মতপার্থক্যের কারণে কাফের/ মুশরিক বলতেও দ্বিধা করে না। দ্বীন মানতে এসেও মানুষ দ্বিধান্বিত হয়ে ফেরে।
মানুষ এখন যে কোনো প্রয়োজনে বাস্তব উলামায়ে কিরামের দ্বারস্থ হওয়ার চেয়ে বিভিন্ন ভার্চুয়াল মাধ্যম যেমন টিভি, অনলাইন ভিডিও, ফাতওয়ার প্রতি বেশি আস্থা রাখছে। এগুলো দেখে ও পাঠ করে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অনলাইনে বসে সামান্য ঘা কে বড় কোনো আলসার বা ক্যানসার মনে করে ঔষধ সেবন করা যেমন জীবনঘাতী বিষয়, তেমনি বিজ্ঞ উলামায়ে কিরামের পরামর্শ ছাড়া দ্বীনী বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নেয়া দ্বীনঘাতী সিদ্ধান্ত।
যে ছেলেগুলো মাত্র দ্বীনে এসেছে, যাদের দরকার উলামায়ে কিরামের তত্ত্বাবধানে থেকে দ্বীন শেখার, তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, দ্বীনের ক্ষেত্রে প্রত্যেকে নিজের বুঝের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, কোনো উলামায়ে কিরামের প্রয়োজন নেই। তাকলীদ – যা মূলত এসব দ্বীনী শিক্ষাহীন মানুষের দ্বীন জানার জন্যই উলামায়ে কিরাম প্রেসক্রাইব করেছেন, সেটাকে শিরকের সাথে তুলনা করে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে।
বাংলা সহীহ বুখারী আর সহীহ মুসলিম থাকলেই হলো। বরং, এসব কিতাবের কেবল কিতাবুল ফিতান থাকলেই হলো। মালহামা, গাজওয়াতুল হিন্দ, এসব গুরুত্বপূর্ণ টার্ম তাদের কাছে ফ্যান্টাসি। কোথাও কিছু হলেই তারা গাজওয়াতুল হিন্দের গন্ধ পেয়ে যান, এ ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের মতামত যাচাই করার প্রয়োজন মনে করেন না। কিতাবুল ফিতান ছাড়াও যে আরো অনেক অধ্যায় সহীহ বুখারী - সহীহ মুসলিমে আছে, সেটা জানার ও বুঝার সময় ও সুযোগ তাদের কোথায়!
উলামায়ে কিরামের তত্ত্বাবধান থেকে বের করার পরিণতি কত খারাপ হতে পারে, তা গত বছর দুয়েক আগে মালয়েশিয়ার কুয়ালালাম্পুরে অবস্থিত কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার সহকারী মুফতীর সাথে আলাপে উঠে আসে। মালয়েশীয়রা এমনিতে ফিকহ শাফেয়ী অনুসরণ করে থাকে। সম্প্রতি তাদের এখানে কাদিয়ানী ফিতনা, আহলে কুরআন, এমনকি ভণ্ড নবীর আবির্ভাব তারা লক্ষ্য করেন। তাদের পর্যবেক্ষণে তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই প্রথম পদক্ষেপ ছিল ফিকহী শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে যাওয়া। মুফতী সাহেব খুব দৃঢ়ভাবে বলেন, সুনির্দিষ্ট ফিকহের শৃঙ্খল থেকে বের হওয়ার পরিণতি কত ভয়াবহ, তা আমরা টের পাচ্ছি, এবং এজন্য আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছি। তিনি আমাকে ফিকহ শাফেয়ীর আলোকে তাদের প্রকাশিত কিছু বইও উপহার দেন।
৩. এছাড়া দেশি-বিদেশি প্রোপাগান্ডা, নাস্তিক ও ইসলাম বিরোধীদের অপতৎপরতা তো আছেই। সুযোগ পেলেই তারা কোনো প্রমাণ ছাড়াই কওমী মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক তথা আলেম সমাজের ওপর আঙুল তুলে, সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
উলামায়ে কিরাম সমাজের পাহাড়ের ন্যায়। যে সমাজে উলামায়ে কিরাম নেই, সেই সমাজ ভারসাম্যহীন। তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে গেলে এসব 'ইয়ো ইয়ো' প্রজন্মের ছেলেগুলো কী সব করতে পারে, গত পরশু তার শুরুটা আমরা দেখলাম। পাশ্চাত্যে দয়া করে নজর দিন, হতাশ যুবকেরা স্কুলে ঢুকে শিশুদের মারছে, রেস্টুরেন্টে মারছে, নিজেদের হতাশাকে ঢাকার উপায় হিসেবে মানুষ মারাকে বেছে নিচ্ছে।
আজ সময় এসেছে উলামায়ে কিরামের সাথে মানুষের সম্পর্ক বাড়ানোর। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া যদি এ সমস্যার মুকাবিলা করার চিন্তা করা হয়, তাহলে তা হবে অবাস্তব।
প্রিয় পিতা-মাতা, আপনাদের সন্তানদের সময় দিন, তাদের খোঁজ-খবর নিন। তাদেরকে দ্বীনের প্রয়োজনীয় শিক্ষাটুকু দেয়া নিশ্চিত করুন। উলামায়ে কিরামকে ভালবাসুন, তাদের সাথে পারিবারিকভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলুন। দ্বীনী মজলিসের আয়োজন করুন।
প্রিয় স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ, ন্যূনতম দ্বীনী শিক্ষা আপনাদের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করুন। হক্ক্বানী উলামায়ে কিরামকে আপনাদের প্রতিষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করুন, দ্বীনের বিষয়াদি শোনার সুযোগ দিন আপনাদের ছাত্রদের।
প্রিয় যুবক ভাইয়েরা, দ্বীনকে বুঝতে উলামায়ে কিরামের সাথে সময় কাটান। ঘরে বসে অনলাইনে হাদীস-কুরআন পড়ে আর লেকচার শুনে দ্বীনের সঠিক বুঝ নিশ্চিত করা যায় না। দ্বীনের শিক্ষা পৌঁছেছে অন্তর থেকে অন্তরে। তাইতো কোনো হাদীস জানা থাকা সত্ত্বেও ইমাম বুখারী রহ. তা সরাসরি শোনার জন্য সফর করেছেন শত শত মাইল। অনুরূপভাবে প্রত্যেক যুগের উলামায়ে কিরাম অনেক দূর সফর করে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করে হলেও সরাসরি উলামায়ে কিরাম থেকে দ্বীনের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। বইয়ের পাতা আর অন্যসব তো কেবল মাধ্যম।
শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কিরাম, দয়া করে এ প্রজন্মকে নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবুন, তাদের কাছে দ্বীনকে, দ্বীনের সৌন্দর্যকে তুলে ধরুন। তারাবীহর রাকাত-সংখ্যা, রাফয়ুল ইয়াদাইন, আমীন আস্তে বলা – এসব মাসায়েল নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। একই বিষয় নিয়ে আলোচনা-বাহাস ইত্যাদি করে বছর শেষ না করে নতুন নতুন এ সব ফিতনা মুকাবিলাই কি বর্তমানে বেশি জরুরী নয়? আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে ফিতনার এ সময়ে দ্বীনের সঠিক বুঝ গ্রহণ করে তার ওপর আমৃত্যু অটল থাকার তাওফীক দিন। আমীন।
লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর/ওএস