যুবায়ের আহমাদ : প্রত্যেক জাতিরই স্বতন্ত্র ঈদ উৎসব রয়েছে। মুসলিম জাতির প্রাণের উৎসব হলো দুই ঈদ। ঈদে অভিবাদন বা শুভেচ্ছা বিনিময়েরও বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে ইসলামে। তবে তা অন্যান্য জাতির অভিবাদন পদ্ধতির চেয়ে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামের শিষ্টাচার অন্যান্য জাতির থেকে অনেক অর্থবহ, সমৃদ্ধ, প্রাণসম্পন্ন ও কল্যাণমুখী।
ঈদ আমাদের বাংলাদেশীদের জাতীয় জীবনেরও এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। আমাদের দেশে ‘ঈদ মোবারক’ বলে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর প্রচলন রয়েছে। ‘ঈদ মোবারক’ বলে শুভেচ্ছা বিনিময় জায়েজ। কিন্তু সালামের আগেই ঈদ মোবারক বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করা বৈধ নয়। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ বলা। এর অর্থ হলো, আল্লাহ আমাদের এবং আপনার পক্ষ থেকে কবুল করুন। হজরত ওয়াসিলা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে ঈদের দিন স্বাক্ষাত করলাম। আমি বললাম, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ আর তিনিও বললেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’। (বায়হাকি: ৩/৪৪৬)।
তাছাড়াও ঈদের দিনে সালাম, মুসাফাহা ইসলামী শিষ্টাচারের মৌলিক অনুষঙ্গ। এ দিনে মুআনাকা বা কোলাকুলিরও অনুমোদন রয়েছে ইসলামে। সালাম ইসলামি অভিভাদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সুন্নত। সালামের মাধ্যমে আল্লাহ পারস্পরিক মুহব্বত বৃদ্ধি করে দেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইমানদার না হওয়া পর্যন্ত তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর একে অন্যকে ভালো না বাসলে ইমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কাজ শিখিয়ে দেব না, যা কারলে তোমরা পরস্পরে ভালোবাসতে পারবে? তোমাদের মধ্যে সালামের প্রচলন করো।’ (মুসলিম: ১/৪৭)।
সালামের পূর্ণ বাক্যটি বললেই বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে। হজরত আবু উমামা (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলবে তার জন্য ১০টি নেকি লেখা হবে, যে ব্যক্তি ‘আস সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলবে তার জন্য ২০টি নেকি লেখা হবে আর যে ব্যক্তি ‘আস সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’ বলবে তার জন্য ৩০টি নেকি লেখা হবে। (তাবরানী: ৩/২০)। সালামের উত্তর প্রদান ওয়াজিব। সালাম দাতার চেয়ে উত্তম করেই দিতে হয় সালামের উত্তর। পবিত্র কোরআনুল করিমে এরশাদ হয়েছে, ‘যখন তোমাদেরকে সালাম দেয়া হলে তোমরা তার চেয়ে উত্তম সালাম দেবে অথবা উক্ত সালামের মতোই উত্তর প্রদান করবে। আল্লাহ সব বিষয়ে পূর্ণ হিসাবগ্রহণকারী।’ (সুরা নিসা: ৮৬)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টির পর বললেন, “যাও ফেরেশতাদেরকে সালাম দাও এবং তারা কী অভিবাদন করে তা শোন। তারা তোমাকে যে অভিবাদন করবে তাই হবে তোমার ও তোমার সন্তানদের অভিবাদন।” আদম (আ.) গিয়ে “আসসালামু আলাইকুম” বলে সালাম দিলে উত্তরে ফেরেশতারা ‘আসসালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বললেন। তারা উত্তরে ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বাড়িয়ে দিলেন।’ (বুখারি: ২/৯১৯)।
পারস্পরিক সাক্ষাতে মুসাফাহা বা হত মেলানোর অনেক ফজিলত রয়েছে। হজরত বারা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যদি দুজন মুসলিম সাক্ষাত করে পরস্পরে হত মেলানো বা মুসাফাহা করেন তাহলে তাদের উভয়ের পৃথক হওয়ার আগেই তাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।’ (তিরমিজি: ৫/৭৪; ইবনে মাজা: ২/১২২০)। মুসাফাহার নিয়ম হলো দুই হাতে মুসাফাহা করা। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন (মাসাফাহার সময়) আমার হাতটি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দু হাতের মধ্যে ছিল। (বুখারি: ৫/২৩১১)। অন্যের ডান হাতকে নিজের দুহাতের মধ্যে এবং নিজের ডান হাতকে অন্যের দুহাতের মধ্যে রেখে এই দুআ পাড়া, ‘ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়া লাকুম’। মুসাফাহার পর হাত বুকে লাগানো উচিত নয়।
মুআনাকা বা কোলাকুলি করাও ইসলামী আদবের অন্তর্ভূক্ত। হাদিসে একে ইলতিজাম (কোলাকুলি) বা মুআনাকা (ঘাড় মেলানো) বলা হয়েছে। হজরত আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবীগণ পরস্পরে সাক্ষাত করলে মুসাফাহা করতেন বা হাত মেলাতেন। আর সফর থেকে আগমন করলে মুআনাকা করতেন। (তাবরানি: ৩/২২)। উভয়ের ডান ঘাড় ও বুক মিলিয়ে ঘাড়ের উপর দিয়ে হাত দিয়ে একবার জড়িয়ে ধরাই মুআনাকা। ঈদের দিনে মুআনাকা জায়েজ কিন্তু একে জরুরী মনে করা যাবে না। ইসলামী অভিভাদনের আরেকটি বৈধ বিষয় হলো চুমু খাওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবীগণ পরস্পরের হাতে চুমু খেয়েছেন বা তাবেয়ীগণ সাহাবীগণের হাতে চুমু খেয়েছেন এমনটি হাদিসে পাওয়া য়ায়। সন্তান, পিতামাতা, উস্তাদ, আলেম বা নেককার বুজর্গদের হাতে চুমু খাওয়া ইসলামী শিষ্টাচারের অংশ। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, জায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) মদিনায় আগমন করে আমার বাড়ির বাইরে এসে সাড়া দিলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর দিকে দৌড়ে যান তাকে জড়িয়ে ধরেন এবং চুমুখান। (তিরমিজি: ৫/৭৬)। তাছাড়া শিশুদের গালে, কপালে বা মাথায় আদরের চুমু দেয়াও রাসুলুল্লাহ (সা.) এর রীতি ছিল। (নববী, আল আজকার: ১/২৬২)।
লেখক: খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ, বোর্ড বাজার, গাজীপুর।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর/ওএস