ডেস্ক নিউজ : ঈদ আনন্দ, সুবিস্তৃত অবসর। এবার টানা ৯ দিনের দীর্ঘ ছুটিতে ঈদ আনন্দ উচ্ছাসে মেতে উঠেছে সারা দেশ। কিন্তু এই আনন্দ উৎসবেও কারও কারও মোটেও অবসর নেই। ইচ্ছে করলেই তারা মন মতো সময় কাটাতে পারে না। শুধু পেশাগত দায়িত্বের কারণে পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে হৈচৈ করে সময় কাটানোর সুযোগ মেলে না বললেই চলে। কর্মস্থলে থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয় ঈদের দিনও। ঈদের সময় সরকারি-বেসরকারি বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই বন্ধ থাকে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বের ধরন এমন যে সেগুলোতে সারা বছর এক মুহূর্তের জন্যও কাজ বন্ধ থাকে না।
ঈদের ছুটি উপেক্ষা করেও শহরের পরিচ্ছন্নতা কর্মী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কর্মী, কারাগারে দায়িত্বপ্রাপ্তরা, চব্বিশ ঘণ্টার সংবাদ মাধ্যম, হাসপাতাল, পরিবহন কর্মী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মীজীবীদের ঈদের দিনেও কাজ করতে হয়। তাদের জীবনে ঈদ বলতে আলাদা কিছু নেই। এর মধ্যে পুলিশ সদস্যরা কেউ কেউ ঈদের ছুটিতে গ্রামে যেতে পারলেও, অনেকেই ঈদের দিনও থাকবেন কর্মস্থলে। সাধারণ মানুষের ঈদের আনন্দকে নির্বিঘ্ন করতে তারা রাত-দিন পরিশ্রম করে দায়িত্ব পালন করবেন। নাড়ির টানে অনেকে বাসা কিংবা অফিসে তালা ঝুলিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন। তাদের সবকিছু নিরাপদে থাকার জন্য নগরজুড়ে নিরাপত্তা দিতে প্রহরায় থাকবেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। একই দায়িত্ব পালন করবেন বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসের নিরাপত্তা কর্মীরাও। ঈদেও ছুটি নেই তাদের। মুমূর্ষু ও জরুরি রোগীদের সেবায় ঈদের দিনও হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করবেন চিকিৎসক, নার্স ও আয়ারা। ঈদে হাসপাতালের রোগী ও সেবাদানকারী কর্মীদের সময় কাটে সবচেয়ে করুণভাবে। অনেকে ছুটিতে চলে যাওয়ায় যারা দায়িত্বে থাকেন তারাই বাড়তি চাপ সামলান দ্বিগুণ পরিশ্রম করে। তেমনি ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার অনেক সাংবাদিক নিজেদের ঈদ আনন্দ বাদ দিয়ে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকেন। টিভি পর্দায় অন্যদের ঈদ আনন্দের জোগান দেন।
ঈদেও যাদের ফুরসত নেই : জীবনে প্রথমবারের মতো ঈদের সময়ও ডিউটি করছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী সানোয়ার হোসেন। গুলশান দুই নম্বর গোলচক্কর এলাকায় কর্তব্যরত সানোয়ারের অভিমত, জীবনে কোনোদিন বাড়ি ছাড়া ঈদ করিনি, এবার ছুটি পাওয়া গেল না। আমার গ্রুপের আটজন ছুটিতে যাওয়ায় বাকি ১২ জনের বিরতিহীন ডিউটি পড়েছে। বাড়তি ডিউটি করে বাড়তি টাকাও পাওয়া যাবে। ঈদের পরে ছুটিও নিতে পারব। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য রজব আলী বলেন, অন্যদের আনন্দের জন্য কাউকে না কাউকে ঈদ আনন্দ মাটি করতেই হবে। তবে আনন্দের সময়ে পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকা বড় কষ্টের। ঈদের ছুটিতে মানুষজনের ঘরের তালা পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু পাহারাদার, দারোয়ান, নিরাপত্তাকর্মীর। সারা বছর হেলায় ফেলায় কাটালেও ঈদ এলে তাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। ঈদের সময় সবার ছুটি জুটলেও তাদের বেলায় খুব কম সময়ই ছুটি মঞ্জুর হয়। এ কারণে অফিস আদালত, ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মীদের সেই অর্থে ঈদ আনন্দ নেই। মানবতার সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের ঈদ, পূজা বলে কিছু নেই। যে কোনো হাসপাতালের দিকে তাকালে খুব সহজেই বোঝা যায়। এ সময় রোগীর সংখ্যা কিছু কম থাকলেও মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসা বন্ধ রাখার কোনো উপায় নেই। তাই ডাক্তার, নার্স, আয়া ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঈদ ছুটি মিলে না। এ ছাড়া রোগবালাই তো আর ঈদের ছুটি উপলক্ষে বিরত থাকে না। ঈদের ছুটি বঞ্চিত ডা. রাজীব দে সরকার বলেন, একদল মেধাবী পেশাজীবীদের নিয়ে যে সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমাদের পূর্বপুরুষেরা গড়ে রেখে গেছেন তার ধারা অব্যাহত রাখতেই হবে। মানুষের জন্য, জীবনের জন্য, হাসপাতাল খোলা থাকে, খোলা থাকবে। তিনি বলেন, পবিত্র এই ঈদের দিনেও এক ঝাঁক ডাক্তার-নার্স নিজের প্রিয় মানুষের কথা ভুলে হাসপাতালে থাকবেন, এই যাপিত জীবন অসামান্য গর্বের, মানুষের পাশে থাকার এ সুযোগ অনেক প্রশান্তির। ঈদ মানেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশাল দায়িত্ব। ছুটি খুব কম সদস্যেরই মেলে। মিললেও তা দুই-এক দিনের বেশি নয়। তাতে অবকাশের তেমন কোনো সুযোগ নেই। সবাই এক কাতারে যখন ঈদের নামাজ আদায় করে তখনো এদের দায়িত্ব পালন করতে হয় বন্দুক কিংবা লাঠি-বাঁশি হাতে। ট্রাফিক পুলিশকে ঈদের দিনেও বৃষ্টি, রোদ উপেক্ষা করে তার দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। রাস্তার বাস, ট্রাক, রিকশাই যেন তাদের পরিবারের সদস্য। ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, পুলিশের বেশির ভাগ সদস্যদের ঈদে দায়িত্ব পালন করতে হয়। পরিবার-পরিজনের জন্য মন কাঁদে। তবে এই ভেবে ভালো লাগে যে মানুষের আনন্দে আমরা তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছি। শাহবাগ থানায় কর্তব্যরত এক সাব ইন্সপেক্টর জানান, ঈদে যারা রাজধানীতে থাকেন তারা ছুটিতে বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে যাবেন। তাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকতে হবে আমাদেরকে। তাদের আনন্দের মাঝেই নিজের আনন্দটা হারিয়ে যায়, তাদের মধ্যেই ভেসে উঠে পরিবার-পরিজন, প্রিয় মানুষের মুখ।
ক্লান্তিহীন পথচলায় ঈদ : ট্রেনের টিটি, ড্রাইভার, গাড়ি চালক, লঞ্চ সাড়েং-সুকানিদের কথা ভাবাভাবির বিষয় হয়তো কেউ মাথায়ও আনেন না। কিসের ঈদ, কিসের পূজা! খুব কম সময়ই পরিবারের সঙ্গে তাদের ঈদ আনন্দ ভাগাভাগির সুযোগ হয়। চালক, কন্ডাক্টর, হেলপারদের কোনো ছুটি নেই। ঈদের দিনও তাদের ক্লান্তিহীন পথচলা। মহাখালী টার্মিনালে কথা হয় গাড়ি চালক বাশার মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ঈদ-পূজার ছুটিতে গাড়ি বন্ধ রাখার তো কোনো নজির নেই। যারা পালাক্রমে গাড়ি চালান তারা কেউ কেউ ঈদ ছুটি আংশিকভাবে ভোগ করলেও আমাদের ভাগ্যে সে আনন্দ জোটে না। রাস্তা, গাড়ি, যাত্রীই হয়ে উঠে আমাদের ঈদ আনন্দ। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী সবুজ মিয়া বলেন, রোজার ঈদে ভালোই লাগে, অনেকের ভাগ্যেই ছুটি জোটে। কিন্তু কোরবানির ঈদের সময় খুব ঝামেলা যায়। কারও ছুটি মেলে না। যারা চব্বিশ ঘণ্টার অনলাইন নিউজ পোর্টাল, রেডিও- টেলিভিশনে কাজ করেন তাদের অনেককেই ঈদের সময় দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই দুই মাধ্যমের সাংবাদিকসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কলাকুশলীদেরও থাকতে হয় দায়িত্বের মধ্যে। এসব মিডিয়া কর্মীদের সাপ্তাহিক অফডে ছাড়া কোনো বিরতি নেই। অবশ্য মিডিয়া হাউসগুলোকে ঈদ উৎসব নিয়ে অনেক নিউজ কাভার ও প্রোগ্রাম তৈরি করতে হয়। এটাকেই তারা ঈদ আনন্দেরই অংশ হিসেবে মনে করেন। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনের বাসায় ঘুরে বেড়ানো এমন সৌভাগ্য খুব কম জনেরই হয়। কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন মিডিয়ার সংবাদ কর্মীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, নিজেরা ঈদের আনন্দ পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারছেন না তাতে দুঃখ নেই। ঈদের দিন অন্যের আনন্দে শামিল হয়ে সেই দুঃখটা ভুলে থাকার চেষ্টা করেন তারা। মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিনরা খুব কম সময়ই ঈদের ছুটি পান। বেশির ভাগক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের পরিবার পরিজন থাকেন অনেক দূরে। ঈদে অনেক গুরুদায়িত্ব তাদের ওপর। ঈদের নামাজ পড়ানো, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি। কোনোভাবেই দায়িত্ব পালন না করার সুযোগ নেই।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর/ওএস