ডেস্ক নিউজ : হলি আর্টিজান রেস্তরাঁর রন্ধনশিল্পী (কুক) হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করলেন ওয়াশরুমে। হামলাকারীদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেতে তিনি এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। ততক্ষণে তিনি হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুধাবন করতে পেরেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন রেস্তরাঁর ভেতরের মানুষগুলোকে বাছাই করা হয়ে গেছে বা হচ্ছে।
একজন অস্ত্রধারী চিৎকার করে বললো, বাঙালিরা বেরিয়ে আসুন। এ কথা শুনে কুক সুমীর বাড়ৈ ও অন্য আট জন যখন কম্পিত হয়ে বাথরুমের দরজা খুললেন তারা দেখতে পেলেন দুজন যুবক। তারা ক্লিন সেভ করা। পরনে জিন্স ও টি-শার্ট।
তাদের একজন বললো, আপনাদের অতো দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমরা বাঙালিদের হত্যা করবো না। আমরা শুধু বিদেশিদের হত্যা করবো। এ সময় সুমীর বাড়ৈয়ের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে রেস্তরাঁর মেঝেতে। তিনি দেখতে পান ৬ থেকে ৭টি মৃতদেহ পড়ে আছে। হয়তো তাদেরকে প্রথমে গুলি করা হয়েছে। তারপর চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহতরা সবাই বিদেশি বলে মনে হয় তার।
সুমীর বাড়ৈ বলেছেন, অস্ত্রধারীরা তাদের কর্মকাণ্ড সামাজিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ুক, ভীষণভাবে এমনটা চাইছিল বলে মনে হয় তার। রেস্তোঁরা অতিথিদের হত্যার পর তারা সেখানকার স্টাফদের নির্দেশ দেয় ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক। এরপর তারা কাস্টমারদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে নিহতদের মৃতদেহের ছবি পোস্ট করে ইন্টারনেটে।
শুক্রবার রাতে ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা হয়। হামলাকারীরা কমপক্ষে ২০ জিম্মি ও দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করে।
পুলিশ বলেছে, শুক্রবারের হামলায় নিহতদের মধ্যে ৯ জন ইতালির নাগরিক, ৭ জন জাপানি, ২ জন বাংলাদেশি, একজন মার্কিনি ও একজন ভারতীয়।
এ হামলা আরো বলে দেয় যে, বাংলাদেশের উগ্রপন্থিরা তাদের নেটওয়ার্ক আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসলামিক স্টেটের বিস্তার কমানোর চেষ্টা করছে। সেক্ষেত্রে এ ঘটনা একটি মূল উদ্বেগের বিষয়।
বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের বেশির ভাগই সুন্নি মুসলিম। এর মধ্যে রয়েছে ২৫ বছর বয়সী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যুবক। এটাই ইসলামিক স্টেটের সদস্য সংগ্রহের একটি মূল্যবান ক্ষেত্র। উল্লেখ্য, ইসলামিক স্টেট এখন ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের মূল উৎপত্তিস্থলে তীব্র চাপের মুখে রয়েছে। এ গ্রুপটি বিশ্বের যেকোন স্থানে তাদের মিশন চালাতে পারে বলে তাদের ওপর নজর রাখছেন পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ইসলামিক স্টেট এখন হামলা চালাচ্ছে বেসামরিক টার্গেটে। তারা এর আগে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। তা থেকে তাদের কর্মকাণ্ড পরিবর্তিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনীর বলেছেন, সার্বিক হুমকিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে আমাদেরকে। এ বিষয়ে সতর্কবার্তা ছিল, লক্ষণ ছিল, সবকিছুই ছিল। কিন্তু এত ব্যাপক আকারে এই নৃশংসতা ঘটবে এমনটা আমরা আন্দাজ করতে পারি নি।
হামলার আগে রেস্তরাঁর ভেতরে তখন অলস সময় ছিল। ১৮ জনকে ভেতরে চেয়ারে বসানো হলো। ব্রেড ও পেস্তা পরিবেশন করা হলো। একটি টেবিলে একসঙ্গে বসলেন ইতালির ৭ জন বন্ধু। দ্বিতীয় আরেকটিতে বসলেন তিন বা চারজন। তারা আর্জেন্টিনার শেফ ডিয়েগো রোসিনিকে ডাকলেন। কেউ একজন ইতালিয়ান পেস্তা ডিশের নির্দেশ দিলেন। রোসিনি কিচেনে ঢুকলেন। তিনি এতগুলো মানুষের জন্য খাবার তৈরি করা শুরু করলেন। হতে পারে তখন রাত প্রায় ৯টা ৩০ মিনিট।
কিন্তু রাত ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে অর্ধ ডজন যুবক ভেতরে প্রবেশ করে। তাদের ব্যাগে ভারী অস্ত্র। এর মধ্যে ছিল গ্রেনেড ও লম্বা সব রাইফেল। তা দেখে রোসিনি পালিয়ে গিয়ে ছাদে আশ্রয় নিলেন। তিনি আর্তনাদ ও ‘আল্লাহু আকবর’ চিৎকার শুনতে পেলেন।
রোসিনি আর্জেন্টিনার ক্যাবল নিউজ স্টেশন চ্যানেল ৫ নোটিসিয়াসকে বলেছেন, ভেতরে অনেক বিদেশি ছিলেন। হামলাকারীরা মূলত তাদেরকেই খুঁজছিল। তারা বিদেশিদের হত্যা করলেও রেস্তরাঁর কর্মকর্তা- কর্মচারী ও বাংলাদেশি অন্যদের প্রতি ভদ্রতা ও বিনয় প্রদর্শন করেছে। এ কথা বলেছেন বাড়ৈ।
রেস্তরাঁর স্টাফদের তারা আস্থায় নিয়েছিল। তবে বিদেশিদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ছিল যে, তারা স্বল্প পোশাক পরে ও মদ পান করে। এটা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ। একজন হামলাকারী বলেছিল, বিদেশিদের লাইফস্টাইল একই কাজ করতে স্থানীয় মানুষদের উৎসাহিত করছে।
এক পর্যায়ে হামলাকারীরা রেস্তরাঁর স্টাফদের কফি ও চা বানাতে বলে। বাকি জিম্মিদের তা পরিবেশন করতে বলে। রাত ৩টা ৩০ মিনিটের সময় মুসলিমরা যখন সেহরি খান তখন হামলাকারীরা কিচেনের স্টাফদের নির্দেশ দেয় বিভিন্ন রকম মাছ ও চিংড়ির ডিশ তৈরি করে তা পরিবেশন করতে। হামলাকারীরা ভালো বাংলা ও কিছু ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে থাকে বিদেশিদের সঙ্গে।
সুমীর বাড়ৈ বলেছেন, হামলাকারীরা সবাই ছিল স্মার্ট ও হ্যান্ডসাম। যদি আপনি তাদের দিকে তাকান তাহলে কেউই বিশ্বাস করতে পারবে না যে, তারা এ কাজ করতে পারে। ভোরের আগে আগে হামলাকারীরা ধর্মীয় বক্তব্য দিতে থাকে জিম্মিদের উদ্দেশে। কিচেনের স্টাফদের এ সময় তারা নিয়মিত নামাজ ও পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের নির্দেশনা দেয়।
একেবারে ভোরে অস্ত্রধারীরা হিজাব পরা একদল নারীকে মুক্তি দেয়। ফারাজ হোসেন নামে এক বাংলাদেশি যুবককেও চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এ কথা বলেছেন, ফারাজ হোসেনের ভাতিজা হিশাম হোসেন। ফারাজ হোসেন এমোরি ইউনিভার্সিটির ছাত্র। তার সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমা পোশাক পরা দুজন নারী। এক পর্যায়ে অস্ত্রধারীরা ওই দু’নারীকে জিজ্ঞেস করে তারা কোথা থেকে এসেছেন। জবাবে তারা জানান, একজন ভারত ও একজন যুক্তরাষ্ট্রের। ফারাজ হোসেনের আত্মীয়রা বলেছেন, অস্ত্রধারীরা যখন ওই দু’নারীকে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানায় তখন ফারাজ হোসেনও তাদেরকে ভেতরে রেখে বেরিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। শনিবার সকালে যাদের মৃতদেহ পাওয়া যায় তার মধ্যে ছিল ফারাজের দেহ।
অস্ত্রধারীরা দৃশ্যপটে আসার কয়েক ঘণ্টা পরে কয়েক শ’ পুলিশ কর্মকর্তা ওই রেস্তরাঁর দেয়ালের বাইরে ব্যাপকহারে জমায়েত হন। তারা ঘেরাও করার চেষ্টা করলে গ্রেনেড ছুড়ে তা প্রতিহত করা হয়। এতে দু’জন নিহত হন। আহত হন কমপক্ষে ২০ জন। ওদিকে রেস্তরাঁর ছাদে ছিলেন আর্জেন্টিনার শেফ রোসিনি। তিনি সেখান থেকে সামাজিক মিডিয়ায় তার অবস্থান জানাতে টেক্সট ম্যাসেজ পাঠাতে থাকেন। এতে তার অবস্থান জানান। পরে তিনি বলেছেন, ওই সময় রেস্তরাঁর ভেতরে পুলিশের প্রবেশ ছিল একেবারেই অসম্ভব। রেস্তরাঁটি একটি ছোট দুর্গে পরিণত হয়েছিল। পুলিশ তখন থাকে সেনাবাহিনীর সহায়তার অপেক্ষায়।
সিনিয়র এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, জিম্মিকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় পুলিশ। জিম্মিকারীরা কোনো দাবিই উত্থাপন করেনি।
ওদিকে ওয়াশরুম বা বাথরুমে বেদনা দীর্ঘায়িত হতে থাকে। সেখানে সুমীর বাড়ৈ ও অন্য আটজনকে তখনও তালাবদ্ধ করে রেখেছে অস্ত্রধারীরা। রাত ১টা ৪৪ মিনিটে সুমীর বাড়ৈ তার এক কাজিনকে একটি ম্যাসেজ পাঠান। এ সময় পুলিশ বেষ্টনীর বাইরে তার কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে অবস্থান করছিলেন তার ওই কাজিন।
অভিযানে র্যাব যুক্ত হয়েছে। এ কথা জানিয়ে সুমীর বাড়ৈয়ের কাছে তার কাজিন ম্যাসেজ পাঠান ভেতরের পরিস্থিতি জানতে চেয়ে: রেস্তরাঁয় (বাথরুমের) বাইরের খবর কি এখন? তারা (নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা) এখনও কিছু করছে না। ফলে তোমরা শিকারে পরিণত হবে না।
সুমীর বাড়ৈ তার এক সহকর্মীর নাম জানান, যে কর্তৃপক্ষকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিতে পারবেন। এ নিয়ে যে ম্যাসেজ তিনি পাঠান তাতে লেখেন, আমরা এখানে। যদি সম্ভব হয় তাহলে টয়লেটের দেয়াল ভেঙে আমাদেরকে উদ্ধার করো।
ভোর যতই প্রস্ফুটিত হতে থাকে সুমীর বাড়ৈ ততই শঙ্কিত হয়ে ওঠেন ঘনকের মতো ৪ ফুট বাই চার ফুট পরিমাপের ওই টয়লেটের মানুষগুলোর পরিণতি নিয়ে। তিনি মনে করেন তারা দম বন্ধ হয়ে মারা যাবেন। এ সময় তিনি ম্যাসেজ পাঠান: দয়া করে যত তাড়াতাড়ি পারো টয়লেটে আসো। টয়লেটের ভেতরকার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়।
এরপরই সুমীর বাড়ৈয়ের ওই কাজিন তার মোবাইল ফোনে কল দেন। কিন্তু আর কোনো উত্তর আসে না ভেতর থেকে। এ অবস্থায় রেস্তরাঁর বাইরের দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়েন তিনি। কান্নায় ভেঙে পড়েন।
ওদিকে খুব সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাসভবন থেকে সেনা অভিযানের অনুমতি দেন। তবে এ জন্য একটি কমান্ডো টিম আনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাদেরকে রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দূরের সিলেট থেকে সি-১৩০ এর মাধ্যমে নিয়ে আসার প্রয়োজন দেখা দেয়।
সূর্যোদয়ের অল্প পরেই ওই রেস্তরাঁর বাইরের বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেন নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের সশস্ত্র সদস্যরা। এ সময় সুমীর বাড়ৈ বলেছিলেন, জিম্মি দশার অবসান হচ্ছে এমন একটি ধারণা ছড়িয়ে পড়ে জিম্মিদের মধ্যে। দীর্ঘ সময় রেস্তরাঁর ভেতর থাকা অবস্থায় হামলাকারীরা এটা স্পষ্ট করেছে যে, তারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চায়। সুমীর বাড়ৈই বলেছিলেন, হামলাকারীদের একজন ঠাণ্ডা মাথায় ছিল। সে চারদিকে পড়ে থাকা মৃতদেহ দেখিয়ে বলেছিল, তোমরা দেখতে পাচ্ছো আমরা কি করেছি। এখন একই ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছি আমরা।
সুমীর বাড়ৈ বলেছিলেন, সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের দিকে হামলাকারীরা তাদের বলেছিল, আমরা চলে যাচ্ছি। দেখা হবে বেহেস্তে। তারা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখনই কমান্ডোরা রেস্তরাঁয় অভিযান চালান। সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস, মানবজমিন
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর/ওএস