ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান আর নেই। আকাশে বাতাসে বিরহ বাজে। সবখানে বিরহের করুণ ধ্বনি। শোক শোক আবহ। ভেজা ভেজা বাতাস। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি। যেনো এতিমের কান্না-করুণ চাহনি।
তিনি অনেকদিন থেকে শয্যাশায়ী। কথা বলেন আস্তে আস্তে। মাঝে মাঝে বেহুঁশ। এই হাসপাতালে ওই হাসপাতালে ছুটোছুটি। শেষে নিয়ে যাওয়া হলো ল্যাবএইড। এ খবরগুলো কানে আসে আর প্রিয় মহলে অস্বস্তি বাড়ে। অসুস্থতার ছবি চোখ পড়ে আর চোখের কোণে পানি জমে। সেই ভেজা চোখে ভেসে বেড়াতে থাকে ফেলে আসা দিনের কতো স্মৃতি। মদীনাভবনের ওই ছোট্ট অপরিসর কামরাটায়, কতো গিয়েছি। আপন ছেলের মতো সময় দিতেন তিনি। একটুও ব্যস্ততা দেখাতেন না। মনোযোগ দিয়ে কথা শুনতেন আর মিষ্টি হাসির টুকরো মুখে নিয়ে জবাব দিতেন। বিদায়ের সময় বলতেন আপনি আসবেন! আবার আসবেন!
আল্লাহ! তাঁকে সুস্থ করে দাও!
দুই.
কিন্তু তিনি আর সুস্থ হলেন না। প্রিয় রমজানের প্রিয় মুহূর্তে আমাদের এই প্রিয় মানুষটি চলে গেলেন! চলেই গেলেন! দীপ নিভে গেলো। সব যেনো অন্ধকার হয়ে গেলো। কাছের মানুষ কাঁদলো। দূরের মানুষ কাঁদলো। প্রিয়জন কাঁদলো। মদীনা ভবন কাঁদলো। আকাশ কাঁদলো। পরিবেশও কাঁদলো। শোক শোক আবহে সারা ঢাকা, সারা বাংলাদেশ, সারা মুসলিম জাহান ছেয়ে গেলো। সবাই যেনো এতিম। সদ্য বাবাহারা। কাতর চাহনি। ছলছল দৃষ্টি। স্তব্ধ নির্বাক ভঙ্গি। লাশ সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নীরব দৃষ্টিরা যেনো বলছিলো—
আর কথা বলবেন না!
আর স্বপ্ন দেখাবেন না!
মদীনাভবনের ওই ছোট্ট কামরাটায় আর আসতে বলবেন না!
ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দেবে কে এখন আমাদেরকে?
অক্লান্ত?
অবিরক্ত?
মমতাভরা?
স্নেহঝরা?
তিন.
আজ শুক্রবার। আযানের এখনো বাকি। কিন্তু হঠাৎ পাকুন্দিয়ার ছয়চির গ্রামে শোনা গেলো অসময়ের আযানধ্বনি। আযান? কার কণ্ঠে? কার বাড়িতে? উৎসটা এবং কারণটা জানতে কোনো বেগ পেতে হলো না। মাওলানা আনসারুল্লাহ খানের শ্বশুর বাড়ি থেকে একটু আগে ভেসে এসেছিলো আযানের সুমধুর একটা ধ্বনি। অন্যরকম কণ্ঠ। যেনো আনন্দ ঝরে ঝরে পড়ছিলো। কারণ আছে আনন্দের। বাবা আনসারুল্লাহ খানের স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে! এইমাত্র জন্ম নিয়েছে মায়ের কোল আলোকিত করা এক শিশু। ছেলে। মুহিউদ্দীন। খান।
মানুষ ছুটে আসছে দুআ দিতে। অভিনন্দন জানাতে। মুবারকবাদ বলতে। সবাই বলছে, সুন্দর নাম তো! বাবার হাস্যোজ্জ্বল জবাব, ছেলে আমার আল্লাহর দীনকে জিন্দাহ করবে, ইনশা আল্লাহ!
চার.
তাই হলো। ছোট্ট মুহিউদ্দীন ছোট্ট থেকেই আলাদা হয়ে বড় হতে লাগলো। পড়াশুনায় বেশ মন। তরতর করে বাড়তে লাগলো সামনে। কিছুদিন নানার বাড়ি। মন টেকে না। তারপর বাবা’র কাছে। পাঁচবাগে। জামিয়া ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসায়। দেখতে দেখতে এসে গেলো আলিম। ১৯৫১ সালে। তারপর খুব তাড়াতাড়ি এসে গেলো ফাযিল। ১৯৫৩ সালে। কৃতি ছাত্র মুহিউদ্দীন। অনেক নাম্বার পেয়ে পাস করলো।
তারপর ঢাকায়। নামকরা আলিয়া মাদরাসায়। এখানে কতো বড় বড় শিক্ষক। তাঁদের সামনে দরসে বসতে কী মজা! কানে যেনো মধু ঝরে। শুধু ভালো লাগে। কিশোর যুবক মুহিউদ্দীনের মন আনন্দে নেচে উঠলো। চলতে লাগলো ইলম অর্জনের সাধনা। রাতে দিনে। সব অবকাশে। নিরবচ্ছিন্ন সাধনা। আলাদা দ্যুতিতে বিভাময়। এভাবে চলে এলো কামিল। হাদীসে একবার। ফিকহে একবার। আহা, ডাবল কামিল। সময়টা ছিলো ১৯৫৬ সাল।
পাঁচ.
কিন্তু এ পর্যন্ত আসতে তাকে অনেক সাধনা করতে হয়েছে। কাঁদতেও হয়েছে সেই ছোট্টবেলা থেকেই। আহারে, এ কান্নার যেনো শেষ নেই। মাত্র ১২ বছরে তিনি স্নেহময়ী মাকে হারিয়েছিলেন! ছোট্ট মুহিউদ্দীনকে রেখে তিনি চলে গেলেন আখেরাতের অনন্ত সফরে। শোকে শোকে বোবা হয়ে গেলো মুহিউদ্দীন। চোখের মাঝে অশ্রু যেনো বান ডেকে গেলো। কান্না থামে না। থামেই না। বার বার তার মনে পড়ে মায়ের একটি উক্তি— বাবা মুহিউদ্দীন! আল্লাহ যেনো তোমাকে মাসিক নেয়ামতের মতো একটা পত্রিকা বের করার তাওফিক দেন!
লেখাটি মাওলানা ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী এর ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া
/আরআর