মুফতি মুহাম্মদ আমিমুল ইহসান : আমরা রমযান মাসের শেষ দিনগুলোতে কথা বলছি। আপনারা এই মুবারাকের মাসের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করছেন। এ মাসে রোযা রেখেছেন, তারাবিহর নামায আদায় করেছেন, তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট। এই মাসে আল্লাহ জান্নাতের দরজা খুলে দিয়েছেন। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছেন। এই মাসের শুরুতে রহমত, মাঝে মাগফিরাত, শেষে জাহান্নাম থেকে মুক্তি। এই মাসে রোযাদারের মুখের ঘ্রাণ আল্লাহ তায়ালার কাছে মিশকের চেয়ে বেশি সুঘ্রাণ। এই মাসে প্রতি রাতে তিনি এমন এক লক্ষ মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, যাদের উপর জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গিয়েছিল। এই মাস গুনাহগার বান্দার আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক গড়ার মাস।
আল্লাহ তায়ালা চান, প্রত্যেক সৎকর্মের পরে বান্দা যেন তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ তায়ালা হাজীদেরকে হজের আমল শেষ করার পর বলেছেন, “অতপর তোমরা সে স্থান থেকে ফিরে এসো, যেখান থেকে অন্য হজ্ব পালনকারী ব্যক্তিরা ফিরে আসে। আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় ক্ষমা করে দেন, তিনি বড়ই দয়ালু।” সুতরাং এই দিনগুলোতে আপনার জন্য আবশ্যক হলো, মহান আল্লাহর দিকে রুযু হওয়া এবং এই মহিমান্বিত মাসের শেষ সময়গুলো তওবা এস্তেগফারের সাথে কাটানো। যাতে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে মকবুল বান্দাহদের দলে শামিল করে নেন, ক্ষমা প্রাপ্তদের দলে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। কেননা সকল নবি আ. তাদের সৎকাজের পরে আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। হযরত নুহ (আ.) তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, “আমি তাদের বলেছি, তোমরা তোমাদের মালিকের দুয়ারে ক্ষমা প্রার্থনা করো; নিসন্দেহে তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তদুপরি তিনি তোমাদের উপর আকাশ থেকে অঝোর বৃষ্টিধারা বর্ষণ করবেন। এবং ধন সম্পদ ও সন্তান সন্তুতি দিয়ে তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন, তোমাদের জন্য বাগবাগিচা ও উদ্যান স্থাপন করবেন, নদী নালা প্রবাহিত করবেন।” হযরত হুদ (আ.) তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, “তোমরা যেন তোমাদের মালিকের দরবারে ক্ষমা চাইতে পারো, অতপর গুনাহ থেকে তওবা করে তার দিকে ফিরে আসতে পারো। তাহলে তিনি তোমাদের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত উত্তম জীবন সামগ্রী দান করবেন এবং প্রতিটি মর্যাদাবান ব্যক্তিকে তার মর্যাদা অনুযায়ী দেবেন।” হযরত সুলাইমান (আ.) তার রাজত্ব ও সেনাবাহিনী দেখে বলেছিলেন, “হে আমার মালিক ! তুমি আমাকে ক্ষমা করো, এবং তুমি আমাকে এমন এক সম্রাজ্য দান করো, যা আমার পরে আর কেউ কোনদিন পাবে না, নিশ্চয় তুমি মহাদাতা।” হযরত ইবরাহিম (আ.) তার শেষ বয়সে বলেছিলেন, “শেষ বিচারের দিন আমি তার কাছ থেকে এ আশা করবো, তিনি আমার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।”
আল্লাহ তায়ালা এস্তেগফারকারীদের ব্যাপারে ওয়াদা করেছেন যে, তারা যতক্ষন পর্যন্ত এস্তেগফার করতে থাকবে ততক্ষন পর্যন্ত তিনি তাদেরকে দুনিয়ায় আযাব দেবেন না। ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তায়ালা এমন নন যে, তিনি তাদের কোন আযাব দেবেন, অথচ আপনি সশরীরে তাদের মধ্যে বর্তমান রয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা এমনও নন যে, কোন জাতির মানুষদের তিনি শাস্তি দেবেন, অথচ তারা কিছু লোক তখনও তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছে।” সুরা আনফাল:৩৩
যারা গুনাহ হওয়ার সাথে সাথে ক্ষমা প্রার্থনা করে, অপরাধ করার সাথে সাথে তওবা করে তাদের প্রশংসা করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, (ভালো মানুষ হচ্ছে তারা) যারা যখন কোন অশ্লীল কাজ করে ফেলে কিংবা নিজেদের উপর নিজেরা যুলুম করে ফেলে, সাথে সাথেই তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কে আছে যে গুনাহ ক্ষমা করতে পারে? তদুপরি এরা জেনে বুঝে এদের গুনাহর উপর অটল হয়ে বসে থাকে না।
এই মানুষগুলোর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের প্রতিদান হবে, আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করে দেবেন, আর তাদের এমন এক জান্নাত দেবেন যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা বইতে থাকবে। সেখানে অনন্তকাল ধরে অবস্থান করবে। সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের জন্য কত সুন্দর প্রতিদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।”Ñ সুরা আলে ইমরান:১৩৫-১৩৬
মহান আল্লাহর অনেক বড় গুণ হলো তিনি অনেক বড় দয়ালু এবং তওবা কবুলকারী। “তিনি আল্লাহ যিনি তার বান্দাহদের তওবা কবুল করেন। এবং তাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। তোমরা যা কিছু করো সে সম্পর্কেও তিনি জানেন।” সুরা শুরা: ২৫
মহান আল্লাহ বনী ইসরাইলকে বলেন, “তারা কি আল্লাহর কাছে তওবা করবে না, তারা কি তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? আল্লাহ তায়ালা বড়ই ক্ষমাশীল, দয়াময়।” সুরা মায়েদা: ৭৪
যে সব বান্দাহরা কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে, তিনি তাদের সগীরা গুনাহ করে দেন। সে সম্পর্কে তিনি বলেন, “যদি তোমরা সে সমস্ত বড়ো বড়ো গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো, যা থেকে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে, তাহলে তোমাদের ছোটখাটো গুনাহ আমি তোমাদের থেকে মুছে দেবো এবং অত্যন্ত সম্মানজনক স্থানে আমি তোমাদের প্রবেশ করাবো।” সুরা নিসা:৩১ আরো বলেন “যখনি তারা নিজেদের উপর কোন যুুলুম করবে, তখনি তারা আপনার কাছে ছুটে আসবে এবং নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। এবং রাসুলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইবে। এমতবস্থায় তারা অবশ্যই আল্লাহ তায়ালাকে পরম ক্ষমাশীল ও অতীব দয়ালু হিসেবে দেখতে পাবে।” সুরা নিসা:৬৪ আরো বলেন, যে ব্যক্তি গুনাহ করে অথবা নিজের উপর যুলুম করে। অতপর সে আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন অবশ্যই সে আল্লাহ তায়ালাকে পরম ক্ষমাশীল ও অতীব দয়ালু হিসেবে পাবে।” সুরা নিসা:১১০ মহিমান্বিত সেই সত্তা যিনি পশ্চিমাকাশে সূর্য উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত রাতের বেলায় হাত বাড়িয়ে দেন, যাতে দিনের অপরাধী তওবা করে। দিনের বেলা হাত বাড়িয়ে দেন, যাতে রাতের অপরাধী তওবা করে। এই হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “ওহে আমার বান্দারা! তোমরা রাতে দিনে সব সময় গুনাহ করো; আমি সব গুনাহ মাফ করি। তোমরা আমার কাছে ক্ষমা চাও আমি তোমাদের মাফ করবো। মুসলিম:২৫৭৭
যে রমযান মাসে তওবা করে না, সে আর কবে তওবা করবে? যে রমযান মাসে দয়াময় আল্লাহর দিকে রুজু হয় না, সে আর কবে হবে? যে রমযান মাসে আল্লাহ তায়ালার সাথে নিজের গুনাহর হিসবা চুকায় না, সে আর কবে চুকাবে? রমযান মাস চলে যাচ্ছে; আপনার গুনাহ এখনো মেটে নি, রমযান মাস চলে যাচ্ছে; আপনি এখনো জাহান্নাম থেকে মুক্তির পরওয়ানা পান নি এর চেয়ে বড় লজ্জা, এর চেয়ে বড় আফসোসের বিষয় আর কী হতে পারে?
আসুন! এই রাতগুলোতে নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর ফিকির করুন। বেশি বেশি দরুদ পাঠ, তওবা এস্তেগফার কে গণীমত মনে করুন। কে জানে? হয়তো আপনি অনেক বড় গুনাহ করেছেন এই রাতেই আপনাকে মাফ করা হবে। আসুন! নিজেকে বাঁচান জাহান্নাম থেকে। দু হাত তুলুন প্রভুর দরবারে। আপনার কি জানা আছে যে, রমযান আপনার জীবনে আবার আসবে? বিদায় হে সিয়াম, কিয়ামের মাস, বিদায় হে পবিত্রতম দিন!
জানিনা আমাদের সামান্য যিকির তেলাওয়াত কবুল করা হবে কি না? তাহলে হয়তো খুশি, আনন্দ আর কবুলিয়াতের তৃপ্তি নিয়ে ঈদগাহে যেতে পারবো না কি আমাদের আমলগুলো ময়লা কাপড়ের মতো পেচিয়ে আমাদের মুখে নিক্ষেপ করা হবে? তাহলে লজ্জা, আক্ষেপ আর প্রত্যাখ্যানের কষ্ট নিয়ে ঈদগাহে যাবো। প্রকৃত সৌভাগ্যশীল তো সেই যাকে আল্লাহ সৌভাগ্যশীল বানান, আর প্রকৃত অভাগা সেই যাকে আল্লাহ অভাগা বানান। তাই আসুন! আমরা এখনই তওবায়ে নাসুহা করে নিই। এই রাতগুলোতে বেশি বেশি এস্তেগফার পড়ি। দুহাত তুলে দয়াময় আল্লাহর কাছে মিনতি জানাইÑ হয়তো তিনি আমাদের মাফ করবেন। আমাদের এমন কোন আমল নেই, যা আমরা আল্লাহর সামনে পেশ করতে পারি। সামান্য আমল যা করি সব ভুলে ভরা। আমরা দরিদ্র, সহায় সম্বলহীন। আমাদের আমলগুলো রিয়ায় ভরা। কেউ কি কিছু সময় নামায পড়ে, কিছু তেলাওয়াত করে, কিছু যিকির আযকার করে মনে করে যে, বাহ! অনেক আমল করে ফেলেছি তো। এই কিছু সময়ের ইবাদত কি ঘুমের সময়ের চেয়ে বেশি, খানাপিনার সময়ের চেয়ে বেশি? খেলা ধুলার সময়ের চেয়ে বেশি?
আমরা যারা আল্লাহ তায়ালাকে রব হিসেবে মানি, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে নবি হিসেবে মানি কে জানে যে এই রাতগুলোতে আমাদের ভাগ্যে কী লেখা হবে। এই রাতে আমরা কি সৌভাগ্যশীলদের জামায়াতে শামিল হবো, না অভাগাদের দলে জুটে যাবো? ‘সকল আমল শেষ পরিাণামের উপর নির্ভর করে’ সুতরাং কোন গুনাহকেই ছোট মনে করো না। যার কাছে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত সবচেয়ে প্রিয় মনে হয়, আল্লাহ তার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার পাত্র হবে।আশা ও ভয়ের মাঝে তুমি অবস্থান করো, নিরাশ হয়োনা কখনো। আর নফসের সাথে তাড়াতাড়ি জিহাদ শুরু করো। যদি তুমি কোন গুনাহর কাজ করে ফেলো, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও,তওবা করো তাড়াতাড়ি তোমায় মাফ করে দেয়া হবে। জান কবজের সময় আসার আগেই দ্রুত তওবায়ে নাসুহা করো। তোমার সামনে যা আছে তুমি যদি সেটা জানতে, তাহলে তুমি না হেসে বেশি বেশি কাঁদতে। জান্নাত কষ্টকর জিনিস দ্বারা আচ্ছাদিত করা হয়েছে, আর জাহান্নামের কামনার জিনিস দিয়ে।
মহিমান্বিত সত্তা যিনি ন্যায়পরায়নদের জন্য ন্যায় বিচারের পাল্লা স্থাপন করেছেন। মাকবুল বান্দাহদের জন্য কবুলিয়াতের দরজা খুলেছেন। তওবাকারীদের জন্য তওবার দুয়ার উন্মুক্ত করেছেন। অন্তরের চাবিকাঠি যার হাতে তার দরবারে আমরা দোয়া করি তিনি যেন আমাদের সবাইকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। আমাদের সিয়াম,কিয়াম, যিকির, তেলাওয়াত সবকিছু কবুল করে নেন।
আওয়ার ইসলাম ২৪ ডটকম / এফএফ