নোমান বিন আরমান : কাজটা ভালো, সন্দেহ নেই। প্রশ্নমুক্ত কি? না। সমালোচনার সদর দরোজাটি খোলা রাখা হয়েছে। মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের বিচক্ষণ চোখ কী করে তা এড়িয়ে গেল, বিস্ময় সেটাই ।
প্রশ্নগুলো বিশেষ সংস্থার- এমন অভিযোগকে দৃঢ়কণ্ঠে না করে দিয়েছেন মাওলানা মাসঊদ। জোর দিয়েই তিনি বলছেন, ফতোয়ার প্রশ্নগুলো তাঁদের তৈরি। বাইর থেকে সাপ্লাই করা না। আমরা এই বক্তব্যকে সূত্রধরে আগাবো। প্রতিটি সতর্ক চোখই দেখবে, প্রশ্নগুলো আন্তর্জাতিক এজেন্ডাকেই বাস্তবায়ন করছে। এমনভাবে বাক্য ও শব্দচয়ন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে আদতে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে, ‘মুসলিম’ মানেই টেরোরিস্ট, জঙ্গি- এই ধারণা বাস্তবসম্মত! এরপর উহ্যবাক্য হলো, ইসলামিক টেরোরিস্টদের দমাতে ফতোয়া-দাওয়াই তাই শেষ পথ্য।
এটা স্বীকৃত সত্য, মুসলিমদের টেরোরিস্ট হিসেবে চিত্রিত করতে বিশ্বশক্তি একাট্টা। ওয়াসিংটন থেকে লন্ডন, বার্লিন থেকে প্যারিস, মস্কো থেকে বেইজিং, তেলআবিব থেকে দিল্লি। এই পয়েন্টে সবশক্তিই এক সুতোয় গাঁথা। সন্ত্রাস আর জঙ্গির মানে তাদের কাছে আলাদা। মুসলিমনামযুক্ত ছোটবড় সব রক্তপাতকেই তারা ‘ইসলামিক সন্ত্রাস’ বা জঙ্গিবাদ নামে চিত্রিত করে। এই রোলের ব্যতয় ঘটে না কোথাও- হোক সেটা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরাক, আফগান বা সিরিয়া।
বাংলাদেশের অজপাড়ায় একজন গোমেজ যদি ‘দুর্বৃত্তের’ আঘাতে নিহত হন, তাহলে ঘণ্টার মধ্যেই বার্তা আসে ওয়াসিংটন থেকে। এমন দৃশ্য অতীতে খুব একটা দেখা যায়নি। সম্প্রতি এটা বেড়েছে। ঘনঘন বার্তা আসছে সেখান থেকে। এটা খুবই স্পর্শকাতর। এর ভবিতব্য ভালো হবার কথা না। বারবার বিশ^মিডিয়ায় আলোচিত এই বার্তা আর একেকটা খুন, বিশ্বমানসে বাংলাদেশের কোন ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে করা হচ্ছে, তা দুর্বোধ্য নয়। শুধু যে দেশের ইমেজকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে, এমন না। এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের, নির্দিষ্ট করে বললে, মুসলমানকে ‘আন্তর্জাতিক খেলোড়েদের’ এজেন্ডার আয়নায় তুলে দেওয়া হচ্ছে। সিরিয়া, ইরাক, আফগানেই শুধু না- ‘বাংলাদেশেও জঙ্গি বীরদর্পে অবস্থান করছে, অমুসলিমদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে, তাদের প্রতীক ও উপাসনাস্থলের অস্থিত্বকে বিপন্ন করে তুলছে’- এ ‘সত্য’ই প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। কাহিনিগুলো এমনভাবে ঘটছে, প্রতিদিন আশঙ্কাকে বাস্তবতায় রূপ দিচ্ছে। দিনদিন এর পেছনের প্ল্যানই আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসছে। স্পষ্ট হচ্ছে, ইরাক-আফগান, সিরিয়ার প্রেক্ষিত রচনার শেষ ট্রায়ালে বাংলাদেশ!
সন্ত্রাস বিশ্বশান্তির নিত্যদুশমন। শান্তির যেমন ধর্ম নেই, মানবতায় বিশ্বাস নেই অশান্তির বীজ বপনকারীদের। সবার রক্তই লাল। প্রতিটি রক্তপাতই নীল বেদনার। সাদা-কালো-বাদামি-গেরো সবার চোখের জলই এক। সহায়-স্বজন, প্রিয়জন-সুজন হারানোতে বুক বিদীর্ণ হয় সকলের। ইরাক-সিরিয়া-ফিলিস্তিন-আফগানে বোমায় জাজরা হয়ে যাওয়া শিশুর লাশ কোলে নিয়ে যে আর্তনাদ ওঠে পিতার বুকে, আসমান ভাঙে জননীর, সমান দুঃখ হয় নাইটক্লাবে হামলায় নিহতদের স্বজনদেরও। আনুপাতিক হিসেবে টাওয়ার, স্টেশন, নাইটক্লাবে হামলায় নিহতদের সংখ্যা নিতান্তই গৌণ। বছরে-ছমাসে সেখানে অনাকাক্সিক্ষত রক্ত ঝরে। কিন্তু মুসলিম জনপদে, মসজিদে, তাদের হাসপাতালে, শিক্ষাকেন্দ্রে ও বাজারে রোজ বোমা-বুলেটে নিহত হয় শত শতজন। এরপরও নিপীড়িতরাই ইসলামিক টেরোরিস্ট। জঙ্গি। রাষ্ট্রীয় মাফিয়াদের শেখানো বুলিই বিশ^ব্যাপী আওড়ানো হচ্ছে। ফল স্বরূপ পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় নামসর্বস্ব মুসলমানকেও।
শান্তিরক্ষার জন্যে, মানবতার কল্যাণে ফতোয়া- নিশ্চয় একটি কল্যাণকর উদ্যোগ। ফতোয়ায় কী হবে- এমন হতাশচিন্তা যারা করছেন, তারা আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভীর ভারতবর্ষে ব্রিটিশরাজবিরোধী ঐতিহাসিক ফতোয়ার কথা স্মরণ করতে পারেন। সেই এক ফতোয়াই ভারতের স্বাধীনসংগ্রামে প্রাণসঞ্চার করেছিলো। ব্রিটিশদের রাজকীয় আত্যাচার-নিপীড়ন থেকে মুক্ত করেছিলো গোটা ভারতের মানুষকে। মুসলিম স্কলারের ফতোয়ায় মুক্তি মিলেছিলো অমুসলিমদেরও। ফতোয়া, দণ্ডপ্রদানকারী নয়, জীবনসঞ্চারি। ফতোয়া, এখন এবং আগামিতেও একইভাবে মানবমুক্তি ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে পারে। এই দিক থেকে লক্ষাধিক ‘মুফতি, উলামা ও আ-ইম্মা’র স্বাক্ষরসম্বলিত ফতোয়া নান্দনিক ও কর্তব্যসচেতন উদ্যোগ। মাওলানা মাসঊদের ফতোয়া প্রচারের এই প্রদক্ষেপকে পুুষ্পিত অভিনন্দন।
॥দুই॥
রাষ্ট্রীয় মাফিয়াদের চাল সম্পর্কে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ অসচেতন নন। তাদের ফাঁদে তাঁর পা দেবারও কথা নয়। এছাড়া একজন শীর্ষ আলেম হিসেবে উম্মাহচিন্তা, মুসলিমদের নিরাপত্তা-প্রতিরক্ষার বিষয়টি তাঁর কর্মসূচিতে, ভাবনা-বিবেচনায় থাকার কথা। কিন্তু বিগ প্রকল্পের ফতোয়ায়, যাদের কুরান-কেতাব থেকে ফতোয়া, তাদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাবিধানে কোনো পথনির্দেশ নেই! ফতোয়ার প্রশ্নগুলো যদি তাঁদের তৈরি করা হয়, তাহলে এর দায় তাঁদের ওপরই বর্তাবে। তখন প্রশ্ন আসে, কেন একপেশে প্রশ্ন, পরতে পরতে কেন আন্তর্জাতিক এজেন্ডার প্রতিফলন।
গুরুত্ব ও প্রসঙ্গবিবেচনায় আলোচিত ফতোয়ার ১১টি প্রশ্ন এখানে জুড়ে নিচ্ছি। ১. ইসলাম কি সন্ত্রাস ও জঙ্গি কর্মকা-কে সমর্থন করে? ২. নবী ও রাসূল বিশেষ করে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসলাম কায়েম করার পথ কি হিংস্রতা ও বর্বর নির্মমতার অবস্থান ছিল? ৩. ইসলামে জিহাদ ও সন্ত্রাস কি একই বিষয়? ৪. জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের পথ কি বেহেশতের পথ না জাহান্নামের পথ? ৫. আত্মঘাতী মৃত্যু কি শহিদি মৃত্যু বলে গণ্য হবে? ৬. আত্মহত্যা ও আত্মঘাতের বিষয়ে ইসলামের মত কী? ৭. গণহত্যা কি ইসলামে বৈধ? ৮. শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিচারে হত্যা কি ইসলাম সমর্থন করে? ৯. ইবাদত-রত মানুষ হত্যা করা কি ধরনের অপরাধ। ১০. এই ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইসলামের দৃষ্টিতে কর্তব্য কি না? ১১. গির্জা, মন্দির, প্যাগোডা ইত্যাদি অমুসলিম উপাসনালয়ে হামলা জায়েজ কি না?
এখানে প্রতিটি প্রশ্নের ব্যাপারেই আলাদা আলাদাভাবে কথা বলা যেতে পারে। সেটা বেশ দীর্ঘ হবে। আমরা মোটা দাগে কয়েকটা বিষয়ে নজর দিতে চাই। প্রশ্নগুলো এই বার্তাই দিচ্ছে, একমাত্র মুসলিমরাই সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে। তারাই বিশ্বশান্তি ও মানবতার জন্যে হুমকি। ফতোয়ার সাথে সংশ্লিষ্টরাও কি তাই মনে করেন? এমন একটি প্রশ্নসূচি তৈরির আগে যে ধরনের ভাবনা পরিকল্পনা, ভারসাম্য রক্ষার জন্যে যে ধরনের নিরীক্ষার প্রয়োজন ছিলো, আমাদের মনে হচ্ছে আয়োজকরা সেদিকে নজর দেবার সময় পাননি। খুব যে তাড়াহুড়া ছিলো, এটা ঘোষণাতেও স্পষ্ট। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এই পরিকল্পনার বিষয়ে প্রথম প্রচার করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরুর পর ফেব্রুয়ারিতে তা প্রকাশের ঘোষণা ছিলো আয়োজকদের। দুই মাসে কি এক লাখ প্রকৃত মুফতি, আলেমের স্বাক্ষর নেওয়া সম্ভব? সম্ভব ছিলো না বলেই, ৩১ মে পর্যন্ত তাদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হয়েছে। এরপরও স্বাক্ষরকারীদের ঠিক কতজন স্বীকৃত মুফতি ও আলেম সেটাও বিবেচনার বিষয়। তবে, এটি এতো গুরুতর কিছু নয়। দশ স্বীকৃত মুফতির ঐক্যমতের স্বাক্ষরও অনেক বড় ব্যাপার।
ফতোয়ার প্রশ্নগুলোয় পরিস্থিতি মোকাবেলার পথনির্দেশ কম। উপরন্তু এটাকে পীঠ বাঁচানোর চেষ্টা বলে মনে করবার সুযোগ রয়েছে। সব ক’টি প্রশ্নে মুসলিমদের ঘাড়ে দায় চাপালেও মুসলিমদের নিরাপত্তা ও প্রতিক্ষার কোনো প্রতিবিধান করা হয়নি। পথনির্দেশ করা হয়নি। তবে কি অমুসলিমরই শুধু অরক্ষিত? তাদের উপাসনালয় রক্ষার বিষয়ে ফতোয়া এসেছে। মসজিদে যে হামলা হয়, বোমায় উড়িয়ে দেওয়া হয় ইবাদতখানা-এসব রক্ষায় ফতোয়ায় কোনো আলোকপথ নেই। ফতোয়া বেচাইন, ‘গির্জা, মন্দির, প্যাগোডা’ রক্ষায়। এমন ভারসাম্যহীন ফতোয়াই তবে জাতির প্রাপ্য ছিলো!
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর