এম ওমর ফারুক আজাদ : আজ ১৮ জুন। ইসলামি সংস্কৃতির কিংবদন্তী, বিপ্লবী মহাপুরুষ শহীদ আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ এর ৭ম শাহাদাত বার্ষিকী। ২০১০ সালের এই দিনে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় শাহাদাত বরণ করেন ইসলামী সংস্কৃতির কিংবদন্তী মাওলানা আইনুদ্দিন আল আজাদ।
২০১০ সালের ১৮ জুন শুক্রবার একটি মাহফিল সেরে পরবর্তী দিনের খুলনায় ইসলামি সংগীতানুষ্টানে যোগ দিতে যাওয়ার প্রতিমধ্যে নাটোরের লালপুরে বিপরিতপগামী ট্রাকের ধাক্কায় দুমড়ে মুছড়ে পড়ে তার গাড়ি। ঘটনাস্থলে ড্রাইভার মৃত্যু বরণ করলেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে আল্লাহ আল্লাহ জিকির করতে করতে প্রেমাস্পদের সাথে আলিংগন করেন এই মহা মনীষী।
তার জন্ম ১৯৭৭ সালের ০১ মার্চ ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ থানার হাজরা তলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। পিতা জনাব মুহাম্মদ শমসের আলী ও মাতা নবীরুন নেসা। ৮ ভাই, ৪ বোনের মধ্যে তিনি হলেন পঞ্চম। বৈবাহিক জীবনে তিনি দুই সন্তানের পিতা। বড় মেয়ে তুহফা আজাদ রুহি ও ছেলে আসাদুল্লাহ গালিব। ইন্তেকালের সময় যাদের বয়স ছিল যথাক্রমে ৮ ও ৫ বছর। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন গ্রামের এক বিদ্যালয়ে। পরে ইসলামি শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহে ১৯৯১ সালে ঝিনাইদহ উত্তর কাষ্টসাগর দাখিল মাদরাসায় ভর্তি হয়ে একি বছর দাখিল। ১৯৯৩ সালে ছারছিনা দারুস সুন্নাহ আলিয়া মাদরাসা থেকে আলিম। ১৯৯৫ সালে ঝিনাইদহ সরকারী কে সি কলেজ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে বাংলা সাহিত্যে অনার্স। ১৯৯৬ সালে মাগুরা সিদ্দিকিয়া সিনিয়র মাদরাসা থেকে ফাজিল ও ২০১২ সালে ঢাকা সরকারী মাদরাসা-ই আলিয়া থেকে কামিল সম্পন্ন করেন।
অন্য দশজন বিদ্যার্থীর মত এভাবে ইতি টানা যেত তার শিক্ষা জীবন নিয়েও। কিন্তু তিনি ছিলেন জাতির জন্য মহান রবের পক্ষ থেকে এক ত্রাণকর্তা। যার মিশন ছিল সদীর্ঘ। যার জীবনালেক্ষ জাতির জন্য প্রেরণা। এমন একজন মনীষীর জীবনীকে সংক্ষেপ করা হবে জাতির জন্য কার্পণ্যতা।বিভিন্ন মনীষী তাদের কর্মের মাধ্যমে জগতের মাঝে অমর হয়ে থাকেন। কেউ ধর্মে, কেউ কর্মে, কেউ আবিস্কারে, কেউ বিপ্লবে, কেউ সমাজ বিনির্মানের কারিগর হয়ে।
অনুরুপ আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ. জগতের কাছে অমর হয়ে আছেন এমন এক বিপ্লবের জন্যে যা ছিল জাহিলি এই সমাজে দুঃসাধ্য ও কন্টকাকীর্ণ।তিনি সব সময় একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। এক সময় আমাদের দেশে ইসলামি গানের তেমন প্রচলন ছিল না এবং ইসলামি গানের শিল্পী ও পৃষ্টপোষকতাও ছিল না বলতে গেলে। কিন্তু আশির দশকের পর থেকে এর সামান্য পরিসরে চর্চা শুরু হলেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা, বিরোধিতা আর অসহযোগিতার কারণে তা প্রচলিত অপসংস্কৃতির মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু হঠাত এই সংস্কৃতিকে বিপ্লবের রূপদানের জন্য ত্রাণকর্তার ভুমিকায় আবির্ভুত হলেন আইনুদ্দীন আল আজাদ।
ছোট থেকে সংগীতের প্রতি দুর্বল ছিলেন। গ্রামের বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় একদিন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এতে তিনি কাজী নজরুল ইসলাম এর ‘ত্রি ভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ’ গানটি গেয়ে পুরুষ্কৃত হন। এটাই ছিল তার জীবনের প্রথন পরিবেশনা । তারপর থেকে তিনি গ্রামের ওয়াজ মাহফিলগুলোতে সংগীত গাইতেন। এভাবে স্বপ্ন বুনতে লাগলেন সংগীত ও সংগীতের আগামী নিয়ে। তিনি সংগীতের মাধ্যমে জাগাতে চেয়েছিলেন জাতির ঘুমন্ত বিবেককে। একটি জাতিকে অতীত ভুলিয়ে গোলামির জিঞ্জিরে বন্ধি করার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হল সংস্কৃতি। তরুণ সমাজকে ভ্রাম্মণ্যবাদি ও পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রজন্মকে মগজহীন খোলসে পরিণত করতে দেখে তার অন্তরাত্মায় এক দরদ নাড়া দিয়েছিল। তাই তিনি ঘুনে ধরা এই সমাজকে সংস্কার করতে সুর ও সংগীতকে মাধ্যম করে নিয়েছেন। এই প্রেরণা থেকে তার মাধ্যমে ইসলামি সংগীত সাংস্কৃতিক বিপ্লবরুপে আত্মপ্রকাশ লাভ করেছিল।
মফস্বল ছেড়ে ১৯৯৩ সালে চলে এলেন ঢাকায়। মসজিদের শহরে এসে সুরের বিলাল হয়ে তিনি গেয়ে উঠলেন নতুন এক বিপ্লবের গান। যেহেতু সাংস্কৃতিক আন্দোলন ইসলামি সমাজ বিপ্লবের অন্যতম শাখা তাই তিনি ইসলামি হুকুমত কায়েমের প্রত্যাশায় ১৯৯২ সালে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন। দীন প্রতিষ্টার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে তিনি তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। পর্যায়ক্রমে ১৯৯৮-৯৯ সেশনে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন এর কেন্দ্রিয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক, ২০০০-২০০১ সেশনে কেন্দ্রিয় সহ-সভাপইতি দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসলামি সমাজ বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় হামলা মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০০০ সালে তৎকালীন সরকারের ইসলাম বিরোধিতার শিকার হয়ে ইশা ছাত্র আন্দোলন এর কেন্দ্রিয় কমটির ১১ জনের মধ্যে তিনিও গ্রেফতার হন।
তিনি তার গানে জাতিকে সব সময় নতুনের স্বপ্ন দেখাতেন। তার গান ছিলো অন্যায় ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে। সমাজের অসংগতি দেখে তার অন্তরাত্মা কেঁদে উঠত। যা তার গান ‘সন্ধানী চোখ দুতি খুঁজে ফেরে বারে বার/ কোথা পাব সে সমাজ যেথা নেই হাঁহাঁকার’ থেকে ফুটে উঠে। রাজনীতি মুখোশ পরে যারা দেশকে পৈতৃক সম্পদের মত ব্যবহার করত তাদের বিরুদ্ধে তিনি বলতেন এভাবে ‘দেশটা নয়তো কারো বাপের ভিটা/ করবে মন চাইলে যখন যেটা’। সমাজের সব পেশার মানুষের ঘুমন্ত বিবেককে জাগাতে তিনি গেয়েছিলেন ‘কি হবে বেঁচে থেকে / অযথা বিদ্যা শিখে/যদি না গড়তে পারি শোষণ বিহীন সমাজটাকে।’
দুর্নীতিবাজদের বিরোদ্ধে সুরের মাধ্যমে তিনি গর্জে উঠেছিলেন এভাবে, ‘দুর্নীতিরই আখড়ায় বসে জাহির করে জ্ঞাণ/কলম দিয়ে কামায় টাকা আবার ধরে সাধুর ভান/ওরা শিক্ষিত শয়তান।’
শাহাদাতের তামান্না নিয়ে তিনি গেয়েছিলেন, বদলে যাবে এই দিন, বিপ্লব মানের জীবন দেয়া, আল কোরানের সৈনিক আমি, পেরিয়ে রক্ত ভেজা পথ, আর কত চাও শহীদ খোদা, শহীদ নামের ঐ, কেউ কি আছো জীবন দিতে খোদার পথে, একটি অনুনয় ইত্যাদি। এভাবে শত শত গানের মাঝে অনন্তকালের জন্য তিনি অমর হয়ে আছেন ষোল কোটি মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায়। তার গানের মোট সাতাশটি অ্যালবাম বের হয়েছিল। সেগুলি হচ্ছে, দুর্নিবার, অবগাহন, কবর পথের যাত্রী, এলো রমজান, খুঁজিওগো তোমায়, শিক্ষিত শয়তান, কি হবে, মানুষ, জনতার আর্তনাদ, বীর মুজাহিদ উসামা, যদি, বুঝে শুনে, বুশের কবর, রক্ত ভেজে পথ, ভোট, তেল, তাইতো, দামামা, বদলে যাবে দিন, যায় যদি যাক প্রাণ, নাংগা তলোয়ার, বন্ধু।
রাজনীতির সাথে সাথে এভাবে তিনি নিজেকে পরিপূর্ণভাবে জড়িয়ে নেন ইসলামি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথেও। আর এই আন্দোলনের দেশব্যাপি নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে যোগ্য কর্মীবাহিনী তৈরির লক্ষ্যে তিনি ২০০৩ সালে অভিযান নামের একটি শিল্পীগোষ্টী প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু একই নামে ভিন্ন সংগঠন থাকায় সেটি ভেংগে ২০০৪ সালে প্রতিষ্টা করেন জাতীয় শিশু কিশোর সাংস্কৃতিক সংগঠন কলরব। সংগীতের সাথে সাথে তিনি সুন্নতের এক অপুর্ব মিশেল ঘটান। তিনি তার শিষ্যদের জন্য জুব্বা আর পাগড়ি বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। যা আজ ইসলামি সাংস্কৃতি জগতে আগত সব শিল্পী ও সাংস্কৃতিকর্মীদের কাছে একটি ইউনিফর্ম এর রূপ লাভ করেছে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন আল্লাহর প্রিয় ওলী। তার ব্যপারে লিখতে গিয়ে তার ছোট বোন আয়েশা খাতুন বলেন, ভাইয়া মাথার ব্যথায় বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন। ডাক্তারগণ পরামর্শ দিয়েছিল মাদ্রাজ নিয়ে যেতে কিন্তু ঢাকার এক দীনি হোমিও ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেন পাগড়ি পরিধান করতে। পাগড়ি পরিধান করার পর মাথায় আর কোন সমস্যা হয়নি, এবং ওই দিনের পর হতে মৃত্যু পর্যন্ত কেউ ভাইয়াকে খোলা মাথায় দেখেনি।
তিনি ছিলেন সুন্নতের একজন পুর্ণ অনুসারী তার সহধর্মিনী হাবিবা আজাদ লিখেছেন, আমি তাকে কোনদিন কোন সুন্নত ছেড়ে দিতে দেখিনাই। আমি গ্লাসের যে মুখ দিয়ে পানি পান করতাম তিনি হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বাকি পানিটুকু ওখানে মুখ দিয়েই পান করতেন। আর বলতেন রাসুল সাঃ মা আয়েশার সাথে এমন করতেন, আমি রাসুল সা. এর সুন্নতটা কিভাবে ছাড়ি?
তিনি কত বড় মাপের মনীষী ছিলেন তা তার স্মৃতিস্মারকে দেশের হক্কানি ওলামায়ে কেরাম, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, লেখক, কলামিষ্ট ও সাংবাদিকদের লেখা থেকে বুঝা যায়।তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তার প্রেরণা আর সপ্ন বুকে নিয়ে ইসলামি সাংস্কৃতির বিজয়ের পানে এগিয়ে যাচ্ছে তার হাতে গড়া প্রতিষ্টান কলরব। কলরবের অক্লান্ত পইরিশ্রমের ফলে ইসলামি সংস্কৃতি আজ উন্নতির স্বর্ণ শিখরে। এখন ইসলামি গান অখ্যাত আর কিছু নয়। এক সময় মিডিয়া ইসলামি গানকে অবহেলার চোখে দেখলে সবাই এখন গুরুত্বের সাথে দেখছে। ঘরে ঘরে পৌছে গেছে ইসলামি গানের সুরের মুর্ছনা। কলরব এখন জাতীয় পর্যায়ে ইসলামি সংস্কৃতির মডেল। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আরব আমিরাত, ওমান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশেও সুরের দুরন্ত কাফেলা হিসেবে কলরব এখন পরিচিতি লাভ করেছে। দেশে সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন যায়গায় কলরবের স্টেইজ শো হয়। এ পর্যন্ত তারা ৬০০ এর অধিক স্টেইজ শো করেছে। আর সংগীত এলবাম বের করেছে প্রায় ৪০ টির মত। বেসরকারি প্রায় টিভি চ্যানেল ও এফ এম রেডিওতে নিয়মিত প্রচার হয় তাদের অনুষ্টান।
আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ এর সপ্ন ছিল মিডিয়া প্রতিষ্টা করা। তার এই সপ্নকে বাস্তবায়ন করতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে কলরব এর যোগ্য পরিচালক শেখ রশিদ আহম্মদ ফেরদৌস, কাজী আমিন, আবু সুফিয়ান, সাঈদ আহমাদ, মুহাম্মদ বদরুজ্জামান ও আবু রা্য়হান এর মত স্বপ্নাতুর উত্তরসূরিগণ।
তার আরেকটি স্বপ্ন ছিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমানে তার পিতার নিজস্ব যায়গার উপর তার কবরের পাশে অবস্থিত মাদরাসা আইনুদ্দীন আল আজাদ পরিচালনা করে কলরব। আল্লাহ মরহুমকে জান্নাতুল ফিরদাউসের বাসিন্দা করে দিন।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফের ডটকম /আরআর