ফাতিমা বিনতে মানছুর মুনীরা : একটি শিশুর জন্মের পর তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মায়ের কোল। মা পরম যত্ন ও ভালোবাসায় সিক্ত করে, সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যখন সন্তান আধো আধো কথা বলা শুরু করে, মা তখন চারপাশের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। কথা ফোটার সময় থেকেই মা যদি ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলার শিক্ষা শিশুর মগজে গেঁথে দেন, তাহলে আশা করা যায় এই সন্তানটি চরিত্রবান সৎ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে। তাই একথায় কোনো সন্দেহ নেই যে, মা হলেন সন্তানের নৈতিক শিক্ষার প্রধান শিক্ষক।
মায়ের প্রথম কর্তব্য হলো সন্তানকে স্রষ্টার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। একটি শিশু সন্তান এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই অন্যকে অনুকরণ করতে পারে। অর্থাৎ তার ভেতর এ সময় থেকে অনুকরণ করার যোগ্যতা তৈরি হয়। বড়রা যা করে সেও আস্তে আস্তে তা করার চেষ্টা করে। সুতরাং সুযোগ তো মায়ের হাতে। পাঁচ ওয়াক্তে নামাযে মায়ের সাথে উঠবস করার সাথে সাথে একটি সন্তান নামায আদায়ে অভ্যস্ত হতে পারে। মা যদি সূরাগুলো একটু জোরে পড়েন, দেখবেন কিছুদিন পর বাচ্চারা তা বলার চেষ্টা করছে। আর এটা স্বতসিদ্ধ যে, বাচ্চারা শোনা জিনিস দ্রুত মুখস্থ করতে পারে। ২/৩ বছরের বাচ্চাদেরকে খাবার খাওয়াতে বেশ সময় লাগে। তিনবেলা খাবার এবং বিকেলের নাস্তা খাওয়ার সময়সহ মা একটা লম্বা সময় সন্তানকে দেন। আর বর্তমানে বেশির ভাগ মায়েরা বাচ্চাকে খাওয়ানোর সময় গান গায়, ছড়া বলে, গল্প বলে। আর টি.ভি কার্টুন তো খাবার খাওয়ানোর অন্যতম অস্ত্র। অর্থহীন ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাঝে’। অথবা ভীতিকর বাক্য ‘অজগরটি আসছে তেড়ে’ কিংবা হিন্দি গান ইত্যাদি নানান কথা বলে থাকেন। প্রতিদিন যদি এগুলো বাচ্চারা শোনে তাহলে সে এগুলো আয়ত্ব করবে। অথচ মা যদি খাবার খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানোর সময় কুরআনের ছোট ছোট সূরাগুলো তিলাওয়াত করেন, ধর্মীয় গান, কবিতা শোনান তাহলে অল্প বয়সেই বাচ্চারা অনেক ভালো এবং জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় শিখতে পারবে। যা পরবর্তী জীবনে ফরয ইবাদাত ও প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করবে।
দ্বিতীয় কর্তব্য হলো, সত্য কথা বলা শিক্ষা দেয়া। আমরা বালক আব্দুল কাদির জিলানী রহ. এর বিখ্যাত ঘটনা কমবেশি সবাই জানি। মায়ের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তিনি শুধু সত্য কথাই বলেননি, সত্যের শক্তিদ্বারা এক বিরাট পাপী দলকে অনুতাপের আগুনে পুড়িয়ে খাটি মানুষে পরিণত করেছেন।
মায়েরা সৎ মানুষের কাহিনী সন্তানদের প্রতিনিয়ত শোনাবেন। সন্তানদেরকে সত্য বলার, সৎ পথে চলার উৎসাহী করার পাশাপাশি এর দ্বারা সমাজে তার প্রশংসামূলক অবস্থান, আখিরাতের উত্তম পুরস্কারপ্রাপ্তিসহ ইহকালীন ও পরকালীন উপকারিতা তুলে ধরবেন।
তৃতীয়ত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হওয়ার আরেকটি বৈশিষ্ট হলো পরোপকার। একজন মা তার সন্তানকে শিশু বয়স থেকেই পরোপকারের গুরুত্ব বুঝাবেন। বিশেষ করে পরোপকারের ফলে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার ব্যাপারটা কত সুখের তা সন্তানের মাঝে জাগ্রত করতে হবে। যেমন- কেউ অসুস্থ হলো, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া, ওষুধ মুখে তুলে দেয়া। অন্ধ/বৃদ্ধদের রাস্তা পার করানোর কাজ। মা কাজগুলো করলে সন্তান শিখবে। গৃহপরিচারিকার সাথের আচরণটাও ছোট বাচ্চার মনে দাগ কাটে। পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন অথবা পাড়া প্রতিবেশীর যে কোনো সমস্যায় মাকে যদি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখে তবে সন্তান ও পরোপকারী হিসেবে বড় হবে।
চতুর্থ সন্তানদেরকে দান করার প্রতি উৎসাহী করতে হবে। হাদীসের বাণী সন্তানকে শিখাতে হবে ‘নিচের হাতের চেয়ে উপরের হাত উত্তম’। দান, সেটা অল্প কিছু হোক। আর দান বলতে যে নগদ টাকা-পয়সাই সব সময় হতে হবে তা নয়। যেমন- মা তার বাচ্চাকে শিখাতে পারেন তোমার ক্লাসের কেউ টিফিন না আনলে তুমি মাঝে মাঝে দিয়ে খেয়ো। কলম যদি দুইটা থাকে, তবে যে না আনবে অথবা তোমার কাছে চাইবে তাকে একটি দিয়ো। পোশাকের ক্ষেত্রে দান শেখানো যায়। শীতবস্ত্র বিতরণ ছাড়াও বছরের যে কোনো সময় বস্ত্রহীনকে যদি মা দান করেন, তবে দেখবেন আপনার সন্তানটিও তার একটি পোশাক নিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়াবে।
পঞ্চমত বড়দের সম্মান করা। শিশুরা খেয়াল করে, তার দাদা-দাদি, নানা-নানির সাথে বাবা-মায়ের ব্যবহার। বয়োজেষ্ঠ্যদের প্রতি বাবা-মাকে যা করতে দেখে বাচ্চারাও তাই শিখে। বড়দের প্রতি গুরুজনদের প্রতি পিতা-মাতার সম্মান প্রদর্শন সন্তানকেও উজ্জীবিত করে। এই বাচ্চারাই বড় হয়ে তাদের পিতা-মাতার প্রতিও পূর্ণ আনুগত্য ও ভালোবাসা প্রকাশ করবে। যে পিতা-মাতা তাদের জনক জননীর হক আদায় করে না, সে অল্পকিছু দিন পর নিজ সন্তান থেকে প্রাপ্য সম্মান বঞ্চিত হবে। ঈশপের বিখ্যাত গল্পটির কথা তো কারো অজানা নয়। ছেলে যখন বৃদ্ধ বাবাকে ঝুড়িতে করে ফেলতে যাচ্ছে, তখন বৃদ্ধের নাতি বলেছিলো- বাবা ঝুড়িটি নিয়ে এসো কেননা, তুমি বুড়ো হলে আমিও তোমাকে এটাতে করে ফেলে দিব। সুতরাং সাবধান থাকতে হবে বাবা মায়েদের। যেহেতু মা থাকেন সন্তানকে ঘিরে দিনের অনেকটা সময়। তাই মায়ের দায়িত্ব বাবার তুলনায় অনেক বেশি। অবশ্য বাবা তো নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মায়ের পাশাপাশি ভূমিকা রাখবেনই।
আবারো বিশেষ করে নবীন বাবা-মায়েদের অনুরোধ করছি- সন্তানের বিশেষ যতœ নিতে, কারণ মাটি শক্ত হলে তা ইচ্ছা মতো আকৃতি গড়া যায় না। ছোট শিশুরা কাদা মাটির মতো নরম। তাকে যা শিখাবেন তাই শিখবে। যা দেখবে তাই তার কচি মনে ছবির মতো ভাসবে।
তাই আল্লাহর সাহায্য কামনার পাশাপাশি প্রতিটি মায়ের অবশ্য কর্তব্য সন্তানের নৈতিক শিক্ষার প্রতি খেয়াল রাখা। নৈতিক শিক্ষার বীজ যদি যথাসময়ে সন্তানের মনে রোপন করতে পারি, তবেই ভবিষ্যতে আল্লাহভীরু, চরিত্রবান ও দেশদরদী নাগরিক তৈরি হবে। আল্লাহ আমাদের প্রতি রহম করুন।
আওয়ার ইসলাম টোযেন্টিফোর /ডব্লিউএস