আতাউর রহমান খসরু, অতিথি লেখক : সন্তান জীবনের সৌন্দর্য ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের অনুপ্রেরণা। সু-সন্তান পরকালীন জীবনের জন্য বড় সম্পদ, চির কল্যাণের প্রবাহ। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, যখন মানুষ মারা যায়, তখন তার তিনটি বিষয় ছাড়া সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। এক. সাদাকায়ে জারিয়া, দুই. এমন ইলম (জ্ঞান) যারা দ্বারা উপকার পাওয়া যায়, তিন. সু-সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। [সহি মুসলিম : ১৬৩১]
সন্তানকে সু-সন্তান হিসেবে গড়ে তোলার সুন্দর সুযোগ পবিত্র রমজান। কেননা আল্লাহ তায়ালা রমজানকে তাকওয়া তথা খোদাভীতি অর্জনের মাস ঘোষণা করেছেন। এ মাসে আল্লাহ রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করেন এবং পাপ কাজের প্রতি প্রলুব্ধকারী শয়তানকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘রমজান- বরকতময় মাস তোমাদের দুয়ারে উপস্থিত হয়েছে। পুরো মাস রোজা পালন আল্লাহ তোমাদের জন্য ফরজ করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। দুষ্টু শয়তানদের এ মাসে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে আল্লাহ কর্তৃক একটি রাত প্রদত্ত হয়েছে, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে বঞ্চিত হলো (মহা কল্যাণ হতে)।’ [সুনানে তিরমিজি : ৬৮৩]
রমজানে পরিবারের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো, সন্তানকে রমজানের গুরুত্ব ও মর্যাদা সংক্রান্ত কুরআনের আয়াত ও হাদিস সম্পর্কে অবহিত করা। রমজান মাসে যে, আল্লাহ তার রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করেন, প্রতি পুণ্যের প্রতিদান বাড়িয়ে দেন, বান্দার প্রার্থনা কবুল করেন, পাপ মোচন করেন, শয়তানকে অবরুদ্ধ করেন এবং রমজান মাস যে, বছরের বাকি সময়ের জন্য রসদ অর্জনের সময় তা তাদের বুঝিয়ে বলা। যেনো তার ভেতর পুণ্যের প্রতি আগ্রহ ও পাপ কাজের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়।
রোজা একটি শারীরিক ফরজ ইবাদত। রোজা পালনে মানুষের মাঝে ধৈর্য্য, সংযম, সহিষ্ণুতা ও ইচ্ছার দৃঢ়তার মতো মহৎ গুণাবলী সৃষ্টি করে। সুতরাং সন্তানকে রোজা রাখার প্রতি উৎসাহিত করুন। আর রোজা একটি কষ্টসাধ্য ইবাদত। ছোট থেকে অভ্যস্ত না হলে বড় হয়ে রোজা রাখা কঠিন হয়ে যায়। তাই শৈশব থেকেই সন্তানকে রোজা রাখার প্রতি উৎসাহিত করুন। সন্তানকে উৎসাহিত করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো নিজে রোজা রাখা এবং রোজার আমলগুলোতে সন্তানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। বিশেষত পরিবারের এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে শিশুরা রোজাসহ অন্যান্য আমলের প্রতি উৎসাহিত হয়। যেমন, ইফতার, সাহরি, তেলাওয়াত, দোয়া ও মোনাজাতে তাদেরকে সাথে রাখা। যেনো সে আমলগুলোর সাথে পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়। আমলের গুরুত্ব ও মর্যাদা তার অন্তরে গ্রথিত হয়।
শিশুর অন্তরে রমজানের গুরুত্ব ও মর্যাদা জাগ্রত করতে এবং তার ভেতর উত্তম চরিত্র ও গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে তাকে কয়েকটি বিশেষ আমলের অনুশীলন করানো যেতে পারে। বিশেষত যে আমলগুলোর প্রতি রাসুলুল্লাহ সা. রমজান মাসে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। যেমন,
১. রোজা পালন : সন্তানকে শৈশব থেকেই রোজা রাখতে অভ্যস্ত করুন। সন্তান যখন বুঝমান হয়ে উঠবে তখন থেকে তাকে সাহরিতে ডাকুন। হয়তো সে রোজা পূর্ণ করতে পারবে না; অথবা তাকে পূর্ণ করতে দেয়া উচিৎ হবে না, তবুও সে রোজার একটি আমলে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। এবং ধীরে ধীরে রোজা সম্পন্ন করার সামর্থ্য লাভ করবে। একইভাবে তাকে ইফতারের দস্তরখানে ডাকুন। তাকে ইফতারে দোয়া ও সুন্নাতসমূহ শিক্ষা দিন। ইফতারের সময় দোয়া করুন এবং তাকে দিয়ে দোয়া করান। এতে রোজার প্রতি তার আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। অন্তত সাহরি ও ইফতারের বরকত সে লাভ করবে। রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘সাহরির খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তায়ালা ও তার ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন।’ [মুসনাদ আহমাদ : ১১১০১]
২. কুরআন তেলাওয়াত : আধুনিক শিক্ষা কারিকুলামে কুরআন শিক্ষার উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই অনেক শিশুর সাথে আরবি বর্ণমালারই কোনো পরিচয় নেই। আবার অনেক শিশুই পারিবারিক উদ্যোগে কুরআন তেলাওয়াত শিখলেও তাদের তেলাওয়াত শুদ্ধ নয়। হাজারে দুয়েক জনের তেলাওয়াত শুদ্ধ হলেও তারা সারা বছর কুরআনমুখী হয় না। তাই কুরআন নাজিলের মাস রমজানে সন্তানের কুরআন তেলাওয়াত বিশুদ্ধকরণ এবং তেলাওয়াতে তাকে অভ্যস্ত করে তুলুন। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা. রমজান মাসে বেশি বেশি তিলাওয়াত করতেন। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রমজান ব্যতীত অন্য কোনো রাত্রিতে আমি রাসুলুল্লাহ সা. কে পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করতে, কিংবা ভোর অবধি সালাতে কাটিয়ে দিতে অথবা পূর্ণ মাস রোজা পালন করে কাটিয়ে দিতে দেখি নি।’ [সহি মুসলিম : ১৭৭৩]
৩. জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় : আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে নিজের পরিবার তথা সন্তান-সন্তুতি ও অধীনস্তদেরকে নামাজের নির্দেশ দিতে বলেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনার পরিবারকে নামাজের নির্দেশ দিন এবং তার উপর আপনি অবিচল থাকুন।’ [সুরা ত্বহা : ১৩২]
নামাজে অবহেলা করলে সন্তানকে শাসন করার নির্দেশনাও ইসলামি শরিয়তে রয়েছে। রমজান মাসে আমরা মসজিদে যেয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করি। মসজিদে যাওয়ার সময় বুঝমান শিশুকেও মসজিদে নিন। এতে তারা জামাতে নামাজ আদায়ে অভ্যস্ত হবে। বিশেষত তারাবির জামাতে কিশোর সন্তানকে সাথে রাখুন। দীর্ঘ সময়ব্যাপী এ নামাজে শৈশব থেকে অভ্যস্ত না হলে তারা বড় হয়ে ক্লান্তি অনুভব করবে। নবী কারিম সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব অর্জনের আশায় রমজানে কিয়ামু রমজান (সালাতুত তারাবিহ) আদায় করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ [সহি বুখারি : ২০০৯]
৪. পুণ্যের কাজে উৎসাহ প্রদান : সহি হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি পুণ্যের প্রতিদান বৃদ্ধি করেন। সুতরাং সন্তানকে বেশি পরিমাণ পুণ্যের কাজ করতে উৎসাহিত করুন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। নবী সা. বলেছেন, ‘এ মাসের প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে আহ্বান করতে থাকে যে, হে কল্যাণের অনুসন্ধানকারী তুমি আরো অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের পথিক, তোমরা অন্যায় পথে চলা বন্ধ কর। (তুমি কি জানো?) এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তায়ালা কতো লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন? [সুনানে তিরমিজি : ৬৮৪]
৫. মন্দ কাজ পরিহারের নির্দেশ : পবিত্র রমজানে কুমন্ত্রণাদানকারী শয়তান অবরুদ্ধ থাকে। সুতরাং এ মাসে যে কোনো মন্দ কাজ ও স্বভাব পরিহার করা অন্য মাসের তুলনায় সহজ। তাই আপনার সন্তানকে মন্দ স্বভাব ও কাজসমূহ পরিহারের নির্দেশ দিন। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রোজা রাখে, সে যেনো তখন অশ্লীল কাজ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। রোজা রাখা অবস্থায় কেউ যদি তার সাথে গালাগালি ও মারামারি করতে আসে সে যেনো বলে, আমি রোজাদার।’ [সহি মুসলিম : ১১৫১]
৬. সন্তানকে উপহার দিন; তাকে দানে অভ্যস্ত করুন : রমজান মাসের আগমন উপলক্ষ্যে শিশু সন্তানকে উপহার দিন। কেননা হাদিসে পরিবার ও সন্তানের জন্য খরচ করাকে সর্বোত্তম দান বলা হয়েছে। রমজান উপলক্ষ্যে সন্তানকে উপহার দিলে তার কাছে রমজান কল্যাণের বাহক মনে হবে। রমজানে অধিক পরিমাণ দানের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং নিজে দান করুন এবং সন্তানের হাতে দান করান। এতে সে উৎসাহ লাভ করবে এবং মনে প্রশস্ততা সৃষ্টি হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ সা. ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমজানে তার এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেতো।’ [সহি বুখারি : ১৯০২]
৭. সন্তানকে নিয়ে মুনাজাত করুন : দোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। রমজান মাসে একাধিক সময়ে দোয়া কবুল হওয়ার কথা হাদিসে এসেছে। যেমনÑ শেষ রাতে, সাহরি ও ইফতারের সময়। এসব সময়গুলোতে সন্তানকে সাথে নিয়ে আল্লাহর দরবারে বেশি বেশি দোয়া করুন। আল্লাহর নিকট বেশি বেশি কান্নাকাটি করুন। তাতে সন্তানের হৃদয় ঈমান ও ইসলামের জন্য সজীব ও সতেজ হবে। ইনশাআল্লা! হাদিসে এসেছে, ‘ইফতারের মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালা বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। মুক্তির এ প্রক্রিয়াটি রমজানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে।’ [জামিউস সগির : ৩৯৩৩]
৮. ধর্মীয় বই-পুস্তক পাঠে উৎসাহ দান : সন্তানকে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দেয়া পিতা-মাতার দায়িত্ব। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার জন্য অনেক সময় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই সন্তানকে রমজান মাসে ধর্মীয় জ্ঞানার্জনে উৎসাহিত করুন। বিশেষত ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস, শিক্ষা ও বিধানাবলী যেনো শিখতে পারে এমন পঠনসামগ্রী তাকে কিনে দিন। কেননা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ।
এখানে মাত্র কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো। বাকিটা আপনার বিবেচনাধীন। আপনি সন্তানের জন্য যা যা করণীয় ও কল্যাণকর মনে করবেন, তাই করবেন। বস্তুত পবিত্র রমজানে সন্তানকে এমন জীবনযাপনে অভ্যস্ত করুন যেমনটি তাকে আপনি সারা বছর দেখতে চান। এমনভাবে পরিচালিত করুন যেনো সে তাকওয়াপূর্ণ আদর্শ জীবনের সাথে পরিচিত হয়। ঈমান ও ইসলামের সাথে তার সখ্য হয় এবং সে পরকালে আপনার মুক্তি ও কল্যাণের অবলম্বন হয়। আপনার এই চেষ্টাটুকু তার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্বল হয়ে থাকবে। সন্তানকে উত্তম জীবনাদর্শ শিক্ষা দেয়াই তার প্রতি পিতা-মাতার শ্রেষ্ঠ সওগাত। রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন পিতা-মাতা সন্তানকে ভালো আদব কায়দা ও স্বভাব-চরিত্র শিক্ষাদান অপেক্ষা উত্তম কোনো দান করতে পারে না। [সুনানে তিরমিজি : ১৯৫২]
তাই আসুন! পবিত্র রমজানে আমরা এমন আদর্শ জীবনযাপন করি যা দেখে সন্তান নিজেই অনুপ্রাণিত হয়। তাকে এমন শিক্ষা উপহার দেই যেনো সুন্দর জীবন ও ভবিষ্যত লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে রমজানের সমূহ কল্যাণ দান করুন। আমিন।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম / আরআর