মুফতি মুহাম্মদ আমিমুল ইহসান : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেই সর্ব প্রথম রমযানেই সেই কথাটিই বললেন যা মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি সৎকর্ম তার জন্যই; কিন্তু রোজা স্বত্রন্ত, তা আমারই জন্য, আর আমি তার প্রতিদান দেবো।’ সহিহ বুখারি : ১৯০৪
কেননা, রোজা তোমার এবং আল্লাহর মাঝে এবং গোপন রহস্য। তোমার রোজা সম্পর্কে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। তোমার রোজাদার হওয়া আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না। হতে পারে কোন দেয়ালের আড়ালে গিয়ে খেতেও পারো, পানও করতে পার। প্রকাশ্য, গোপন সব জানেন আল্লাহ... গোপনে তোমার খাওয়া, পান করা, যৌন কর্ম সব জানেন আল্লাহ... আল্লাহ আলো, অন্ধকার সব কিছুর প্রভু...
‘যখন তুমি অন্ধকার নির্জনে কোনো পাপের আশংকা কর, আর ঐ অন্ধকারে তোমার রিপু তোমাকে প্রভুর অবাধ্যতার দিকে আহ্বান করে। তুমি তোমার প্রভুর দৃষ্টিকে লজ্জা কর আর ঐ পাপ কাজকে বলো যে, যিনি অন্ধকারকে সৃষ্টি করেছেন তিনি তো আমাকে দেখছেন।’
নামায তো অনেক মানুষের জমায়েতের মধ্যে পড়া হয়। যাকাত মানুষের সামনেই দেয়া হয়। হজ্জ হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে করা হয়। কিন্তু রোজা; তুমি অন্ধকার নির্জনে, একাকী খেতেও পারো, পানও করতে পারো, কেউ বুঝতে পারবে না যে, তুমি রোজাদার নও; কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো জানেন যে, তুমি রোজাদার নও।
রোজা তোমার আর মহান আল্লাহর মাঝের এক গোপন ভেদ। ‘আদম সন্তানের প্রতিটি সৎকর্ম তার জন্যই; কিন্তু রোজা স্বত্রন্ত, তা আমারই জন্য, আর আমি তার প্রতিদান দেবো।’ একবার হাদিসের শব্দগুলোর সুক্ষ্মতার প্রতি খেয়াল করুন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন, ‘সে পানাহার এবং যৌনাচার বর্জন করে একমাত্র আমারই জন্য।’
এরপর ইরশাদ করছেন, ‘নিঃসন্দেহে রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মৃগনাভির সুগন্ধ অপেক্ষা অধিক উৎকৃষ্ট।’ যখন রোজার ঘ্রাণ ছড়ায় তখন অন্যদের হয়তো কষ্ট হয় কিন্তু সেটা সুগন্ধে পরিণত হয় এবং মহাসুগন্ধ হয়ে মহান মালিকের কাছে ভেসে যেতে থাকে। একেবারে খাঁটি মেশক হয়ে... মানুষের সব আমলের প্রতিদান এক গুণ, দশ গুণ, সাতশত গুণ থেকে অসংখ্য গুণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। একটা সীমারেখা আছে। কিন্তু রোজার সওয়াব আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। তিনি জান্নাতে রোজাদারদের জন্য একটি দরজা নির্ধারিত করেছেন। প্রসস্থ দরজা যেটা দিয়ে শুধু রোজাদারই প্রবেশ করতে পারবে। যখন তারা সেই দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। মহান মেজবানের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসবে,
তোমরা যারা দুনিয়ায় আমার ভয়ে ভক্ষণ করোনি, এখন আমার অফুরন্ত জান্নাতি খাবার ভক্ষণ কর।
তোমরা যারা দুনিয়ায় আমার ভয়ে পান করোনি, এখন আমার জান্নাতি শরাব পান করে নাও।
তোমরা যারা দুনিয়ায় আমার ভয়ে নিজের জৈবিক চাহিদা পূরণ করোনি, জান্নাতের নেয়ামত দ্বারা সেই চাহিদা মেটাও। হাদিস শরিফে এসেছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘জান্নাতের মধ্যে এমন একটি দরজা আছে যার নাম হলো রাইয়ান; সেখান দিয়ে কেবল রোজাদারগণই কিয়ামতের দিন প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া আর কেউ সেদিক দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’ বুখারি :১৯৯৬
রোজাদারগণ আল্লাহর অতি প্রিয়পাত্র। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর পথে একদিন রোজা রাখবে, আল্লাহ তায়ালা ঐ একদিন রোজার বিনিময়ে তার চেহারাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বছর পরিমাণ পথ দূরে রাখবেন।’ বুখারি : ২৮৪০
সালাফে সালেহীনগণ এই হাদীসের অর্থ এটাই বুঝেছেন যে, আল্লাহর রাস্তায় থেকে রোজা রাখার অর্থ হলো- আপনি আল্লাহর রাস্তায় ইসলামের শত্রুদের সাথে জিহাদ রত অবস্থায় রোজা রাখবেন। যখন আপনি আপনার প্রিয় প্রাণটি আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় নজরানা হিসেবে পেশ করছেন তখন আপনি রোজা রাখবেন।
প্রখ্যাত জ্ঞানতাপস ইমাম ইবনে কাসীর, ইমাম শামসুদ্দিন যাহাবি রহ. বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাযি. রোজাদার অবস্থায় মুতার যুদ্ধে গমণ করেন। তার পূর্বে হযরত জায়েদ ইবনে হারেছা এবং হযরত জাফর তাইয়ার রা. শহীদ হয়েছেন। এমন সময় তাকে জিহাদের জন্য ডাকা হলো যখন সূর্য প্রায় ডুবছিল। তিনি তো রোজাদার। ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত। তখন তিনি বললেন, খাবার জন্য কিছু নিয়ে আসো; যাতে আমার কিছুটা শক্তি অর্জিত হয়। ময়দানে তীর তলোয়ার ঝংকিত হচ্ছিল। চারপাশ থেকে ভেসে আসছিল আহতের মরণ চিৎকার। এমন সময় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রোজাদার। যখন তিনি তার দ্বীনী ভাইয়েরা জিহাদ জিহাদ করতে করতে শহীদ গিয়েছেন। তিনি বললেন, এক হাড় নিয়ে এসো; খেয়ে একটু শক্তি হাসিল করি। যখন হাড় নিয়ে আসা হলো তিনি বললেন, সূর্য ডুবেছে কি? আমি তো রোজাদার। সঙ্গীরা বললো, না, এখনো সূর্য ডোবেনি।
তিনি কিছুক্ষন অপেক্ষা করে সূর্য ডুবলে হাড়ের টুকরোটি নিলেন খাওয়ার জন্য। কিন্তু খাবারে কোন মজা পেলেন না। পান করার কোন অর্থ খুঁজে পেলেন না। সামান্য সময় খুব বিলম্ব মনে হলো তার কাছে। হাড়ের টুকরোটি জমিনে ফেলে দিলেন। তরবারি কোষমুক্ত করে আসমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে আমার নফস! আমি কসম করেছি, অবশ্যই সেখানে ঝাপিয়ে পড়বো, যদি লোকেরা কসম খেয়ে তুমুল বেগে আক্রমন করে।
আমার কী হলো যে, তুমি জান্নাতকে অপছন্দ করছো, অথচ তুমি চামড়ার থলেতে এক ফোটা নাপাক পানি ছাড়া আর কিছু নও।’ এরপর তিনি রোজাদার অবস্থায় জিহাদে ঝাপিয়ে পড়লেন।
আল্লাহর রাস্তায় থেকে রোজা রাখার অর্থ হলো- আপনি আল্লাহর রাস্তায় ইসলামের শত্রুদের সাথে জিহাদ রত অবস্থায় রোজা রাখবেন। যখন আপনি আপনার প্রিয় প্রাণটি আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় নজরানা হিসেবে পেশ করছেন তখন আপনি রোজা রাখবেন।
দেখুন এই মহাত্মাকে কিভাবে আল্লাহর মত্ত হয়ে ছুটে গেছেন নিজেকে তার প্রেমে বিলীন করার মানসিকতা নিয়ে। আমরা ইসলামের জন্য কি করেছি? না করেছি রাত্রি জাগরণ, না করেছি জিহাদ, না আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করেছি। কিন্তু আমাদের সালাফগণ! তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, রোজা একটি জীবন্ত চিন্তাকেন্দ্র, রেযায়ে এলাহীর সাথে চিরন্তন জীবন। ‘আমি সেই ব্যক্তি যে তরবারি উঠিয়েছে তোমার নাম আকাশের উচু নক্ষত্রের উপর আলোর মিনারা হিসেবে সুউচ্চ করার মানসা নিয়ে। আমরা ছিলাম পাহাড়ের উপরে আরেক পাহাড়হয়ে, আবার কখনো কখনো হয়ে যাই সাগরের ঢেউয়ের উপর আরেক সাগর। হে আমাদের প্রভু! আমাদের প্রাণ আমাদের হাতে নিয়ে আছি তোমার প্রতিদান গনীমত ও সান্নিধ্যের আশায়।’
কালিমার বিশ্বাসে জন্ম নেয়া, কালিমার বিশ্বাসে বেড়ে ওঠা আমার মুসলিম ভাইগন!
মাহে রমযান আপনাদের দোড়গোড়ায় এসেছে। একেবারে কাছে। রমযান মাস যেন আমাদের কেউ বঞ্চিত ও মাহরুম অবস্থায় বিদায় না নেয়। জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়াকে আপনাদের জন্য গনিমত মনে করুন। এটাকে এক অমূল্য সুযোগ মনে করুন। এ তওবার মাস... আল্লাহর পক্ষ থেকে কবুলের মাস... এ মাসে বেশি বেশি তাসবিহ, তাহলিল, যিকির আযকার, তিলাওয়াতে কুরআনে অভ্যস্থ হোন। নিজেদের ঘরকে তিলাওয়াতে কুরআন দ্বারা আবাদ করুন। অশ্লীল, অনর্থক, বেহুদা গান বাদ্য থেকে বেচে থাকুন। এসবের দ্বারা ক্বলব রাব্বুল ক্বলবের থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়াকে আপনাদের জন্য গণীমত মনে করুন। যেদিন মহাপরাক্রমশালী প্রভুর সামনে দাঁড়াবেন সেদিন আপনার চেহারা শুভ্র উজ্জ্বল হয়ে যাবেÑ এই মহা নেয়ামতকে গণীমত মনে করুন। সুসংবাদ সেই সব উদরের জন্য যারা আল্লাহর রাস্তায় ক্ষুধার্ত থাকে। মোবারকবাদি ঐ হৃদয়ের যে সন্তুষ্টির জন্য তৃষিত ছিল। মুবারকবাদি আপনাদের জন্য হে সৌভাগ্যশীল উম্মত! আপনারা এই পূণ্যময় মাস পেয়ে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রোজা রেখেছেন। মহান আল্লাহ আপনাদের এই নেক কাজের উত্তম বদলা দিন। এই মাসে আপনাদের গুনাহ মিটিয়ে নিন। তওবা নবায়ন করুন। হে রমযান! সাদর সম্ভাষন তোমাকে। আল্লাহর ফযলে আমাদের গুনাহরাশীকে মিটিয়ে দাও। আমরা যেন হাউজে কাউসারের পবিত্র পানি পান করে চিরদিনের জন্য আমাদের পিপাসা মিটিয়ে নিতে পারি।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম / আরআর