মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান আলেম। জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া সিনিয়র মুহাদ্দিস। তাওযিহুল কুরআনসহ অসংখ্য শক্তিশালী অনুবাদ আছে তার। সম্প্রতি ঢাকার বাসাবোতে অবস্থিত মাদরাসাতুস সুফ্ফার স্মারকগ্রন্থ পুস্পকাননে প্রকাশিত সাক্ষাতকারটি আওয়ার ইসলামের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : আমাদের তালিবুল ইলম ভাইদের মধ্যে মৌলিক তিনটা প্রকার দেখা যায়। এক প্রকার হলো যারা বেশ মেধাবী এবং সহজে কিতাব বুঝতে পারে। আরেক পর্যায়ের থাকে যারা মধ্যম মেধার। দরসের পরে তাকরারের মধ্যে অন্যরা যখন খোলামেলা ভাবে বুঝিয়ে দেন তখন বুঝতে পারেন। আরেক পর্যায়ের হলেন যারা মেধায় ও বুঝ শক্তিতে আরেকটু সাধারণ। এই তিন পর্যায়ের তালিবুল ইলমদের মধ্যে কে কিভাবে কিতাব ও ফনের উপর যোগ্যতা অর্জন করতে পারে?
উত্তর : আসলে এ ব্যাপারে একটা গোড়ার কথা আছে। আমাদের এই দরস ও তাদরীস, তালীম ও তাআল্লুমের মূল মাকসাদ হচ্ছে দাওয়াত। দাওয়াত বলতে খুব হালকা আন্দাযে নয়। বাসীরাত ও অন্তর্দৃষ্টির সাথে দাওয়াত দেয়া। নবী (সা) এবং সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের মূল কাজ ছিলো দাওয়াত ইলাল্লাহ।
কাজেই ওয়ারিসে নবী হিসেবে আমাদের কাজ তো ওটাই হবে। এখন দাঈ হওয়ার জন্যে আমাদের কী গুণাবলী ও যোগ্যতা দরকার এটা আগে নির্ণয় করা জরুরী। এই যোগ্যতাগুলোকে সামনে রেখে নেসাব তৈরি হওয়া দরকার। এবং সে অনুযায়ী কিতাব নির্বাচন দরকার।
অতএব প্রশ্ন অনুযায়ী তিন ধরণের ছাত্রের জন্য তিন স্তরের নেসাব করা যেতে পারে। অর্থাৎ দাওয়াতের ক্ষেত্রে আমরা কোন স্তরকে দিয়ে কী কাজ নেব সেটা বিবেচনা করে স্তরভিত্তিক নেসাব তৈরি করা জরুরী। দাওয়াতের কাজ তো বিশাল। কিছু কাজ এমন যা আঞ্জাম দেয়ার জন্য উঁচু মানের যোগ্যতা দরকার। আর কিছু কাজ আছে যা মধ্যমানের লোক দ্বারাও সম্ভব। আবার কিছু বুনিয়াদী কাজ আছে যা অপেক্ষাকৃত কম মেধা ও যোগ্যতার লোকদের দিয়েই করানো যায়।
যামানার চাহিদা সামনে রেখে মানুষের সবরকম সমস্যার সমাধান দেয়া, যুগ জিজ্ঞাসার জবাব দেয়া একটু কঠিন কাজ। এর জন্য উচ্চস্তরের যোগ্যতা দরকার। দিন দিন মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর ফলে মানুষের জিজ্ঞাসাও দিন দিন গভীর হচ্ছে এবং বিস্তার লাভ করছে। এমন এমন দ্বীনি বিষয়ে জিজ্ঞেস করছে আগে যা মানুষের মাথায় আসতো না। এই জাতীয় মানুষের কাছে দাওয়াত নিয়ে যাওয়ার জন্যে খুব ভালো যোগ্যতা দরকার। কাজেই ঐ রকম কিছু দাঈ তৈরির জন্য ভিন্ন নেসাব প্রয়োজন।
তবে অধিকাংশ লোক হলো মধ্যমানের। তাদের জন্য সেই মানের ছেলেদের প্রস্তুত করা দরকার। আর মেধায় জ্ঞানে যেসব তালিবে ইলম প্রাথমিক স্তরের তাদের জন্য প্রাথমিক স্তরের কাজ দরকার।
কিছু প্রাথমিক কাজ আছে যা সবার জন্যই দরকার। যেমন কুরআনে কারীমের তালীম, দ্বীনের বুনিয়াদী তালীম এগুলো সবারই দরকার। এই বুনিয়াদী কাজের জন্যে খুব বেশি যোগ্যতার দরকার পড়ে না। যারা সহী করে কুরআনে কারীম তেলাওয়াত করতে জানে এবং শিক্ষাদানের যোগ্যতাটুকু আছে, এমনিভাবে দ্বীনের বুনিয়াদী বিষয়ের জ্ঞান আছে Ñএই জাতীয় লোকদের দ্বারা প্রাথমিক স্তরের এসব কাজ নেয়া যায়। খোলাসা কথা এই, আমি মনে করি নেসাব তিন রকমের দরকার। যারা প্রাথমিক যোগ্যতার তাদেরকে দ্বীনের বুনিয়াদী বিষয় শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেয়া উচিৎ। এদেরকে দ্বিতীয় বা সর্বোচ্চ স্তরে নেয়ার দরকার নেই। কারণ এদেরকে নিলে সময় নষ্ট হবে। ঐ কাজ তো তাদেরকে দিয়ে নেয়া হবে না।
কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। গণহারে সবাইকে তাখাসসুসের উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একজন মেধাবী যেই সনদ পাচ্ছে সেও একই সনদ পাচ্ছে। মেধাবীকে মাওলানা মুফতি বলা হচ্ছে তাকেও বলা হচ্ছে। মানুষ মনে করছে দুইজনেই মাওলানা দুইজনেই সমান মুফতি। এরপর অমেধাবী বা কম যোগ্য লোককেও ফতোয়া জিজ্ঞেস করছে। ঐ বেচারা বাধ্য হয়ে জেনে না জেনে ফতোয়া দিয়ে দিচ্ছে। যার ফলে মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ছে। এই জাতীয় কিছু ঘটনা আমার জানা আছে। সেকথা এখন নাই-ই বলি।
প্রশ্ন : দাওরায়ে হাদীসের নেসাব এক বছরের। মাওলানা আবুল হাসান আব্দুল্লাহ সাহেবসহ অনেকেরই বক্তব্য হলো এটা আরো দীর্ঘ হোক। এক বছরে এত দ্রুততার সাথে এতগুলো হাদীসের কিতাব পড়িয়ে দেয়া এটা হাদীসের শানের খেলাফ, তাছাড়া ছাত্র ভাইয়েরাও বুঝে উঠতে পারেন না। সূতরাং দাওরার নেসাবকে দুই বা তিন বছর করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন?
উত্তর : আমি তিন স্তরের যে নেসাবের কথা ভাবছি ওটা যদি হয় তাহলে দাওরার নেসাব এমনিতেই লম্বা হয়ে যাবে। কম মেধার ছেলেরা আগেই ফারেগ হয়ে যাবে। আর মেধাবীরা আরো লম্বা সময় ধরে পড়বে। একথা তো বাস্তবই, এক বছরে দাওরা পড়ে পুঁজি বেশি কিছু হয় না। যে দাওরা পড়েই পড়া শেষ করে দেয় সে এটা উপলব্ধি করে না। এটা বুঝতে পারে সে, যে দাওরার পরে আরো বিস্তর লেখাপড়া করেছে। সে বুঝতে পারে আগে আমি কোথায় ছিলাম আর এখন কোথায় আছি।
পক্ষান্তরে দাওরার নেসাব যদি দুই বা তিন বছরের হত তাহলে পরে আরো পড়–ক আর না পড়–ক ওতেই তার মৌলিক একটা পুঁজি জমা হয়ে যেত। বিষয়টা নিয়ে আসলেই ভাবা উচিৎ।
প্রশ্ন : এ বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করে জানতে চাই যে, তিন স্তরের যদি নেসাব হয় তাহলে তার রূপরেখা কী হতে পারে? অর্থাৎ কতটুকু পর্যন্ত সবাই একসাথে পড়বে, এবং কোথায় গিয়ে বিভাজনটা হবে?
উত্তর : এটা বলা কঠিন একারণে যে, আমাদের সবগুলোই তো এখন একসাথে পড়া হচ্ছে। স্কুল-কলেজের মত বিভাজন তো নেই। কাজেই আগে মাধ্যমিক একটা সুচিন্তিত স্তর তৈরী করতে হবে যেই পর্যন্ত সবাই একসাথে পড়বে।
কিন্তু আমি যদি বলি কাফিয়া পর্যন্ত একসাথে পড়বে তাহলে হবে না। যদি বলি মেশকাত পর্যন্ত তাহলেও হবে না। কারণ আমাদের পুরো নেসাবটাকেই সাজানো হয়েছে সবাইকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্যে। এজন্য পুরো নেসাবকে নতুনভাবে সাজাতে হবে।
প্রশ্ন : প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে নেসাবের সংস্কারের বিষয়টি সামনে চলে আসে। আমাদের দেওবন্দী আকাবিরগণ সেই বৃটিশ আমলের প্রেক্ষাপটে যেই নেসাব তৈরি করেছেন যুগের এত পরিবর্তন সত্ত্বেও হুবহু নেসাবকে অপরিবর্তনীয় ও অলংঘনীয় মনে করার উদ্দেশ্যে কী?
উত্তর : এই বিষয়ে কথা বলা আমার জন্য একটু কঠিন। তথাপি বলতে হয়। এক্ষেত্রে একটা গোঁড়ামী কাজ করছে। নেসাব তো একটা মাধ্যম মাত্র। আমাদেরকে কুরআন মাজীদ পড়তে হবে, বুঝতে হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই। হাদীস পড়তে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কুরআন হাদীসের বিকল্প নেই। কিন্তু কুরআন হাদীস বুঝার জন্য মাধ্যম হিসেবে যেসব কিতাব আমাদের নেসাবে আছে প্রয়োজনের ভিত্তিতে সেগুলোর মধ্যে কোনটার বিকল্প আমরা ভাবতেই পরি। ওটাকে অন্ধের মত আঁকড়ে থাকা তো কাম্য না।
উদাহরণ স্বরূপ আমরা কৃষি বিদ্যার কথা বলতে পারি। কৃষি কাজ শেখা হলো মাকসাদ। তো সেই কৃষি বিদ্যার মধ্যে গবেষণা করে উত্তরোত্তর উন্নতি ও সংস্কার সাধন করা হয়েছে। যার ফলে কৃষি বিদ্যা আরো যুগোপযোগী হয়েছে। অতএব কুরআন হাদীস শেখার ক্ষেত্রে আমরাও তো ভাবতে পারি। মাধ্যমটা আরো কিভাবে উন্নত করা যায়, কিভাবে আরো সহজ করা যায়, আরো ফলপ্রসূ করা যায় এবং কি করে শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়ানো যায় এটা আমরাও ভাবতে পারি।
প্রশ্ন : ব্যক্তিগতভাবে নেসাব সংস্কারের বিষয়টা নিয়ে অনেকেই চিন্তাভাবনা করছেন। কিন্তু জনসম্মুখে মুখ খুলছেন না। বিষয়টা কি এমন?
উত্তর : ঠিক এমনই। চিন্তা অনেকেই করছেন। এবং একেক জন একেক মত ও পথ অবলম্বন করছেনও। একটা পরিবর্তন বা সংস্কার কিন্তু আপনা আপনি হয়ে যাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ। যদি সবাই মিলে সমন্বয়ের সাথে করত তবে আরো ভালো হত। আমরা আশা করতেই পারি। একটা সময় আসবে যখন এই নেসাবে ব্যাপক সংস্কার সাধিত হবে এবং আরো যুগোপযোগী ও মুফীদ হবে।
প্রশ্ন : ভবিষ্যতে বিশেষ ময়দানে কাজ করবে এমন চিন্তা ভাবনা থেকে মৌলিক পড়ালেখার পাশাপাশি কেউ যদি বক্তৃতা লেখালেখি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যোগ্যতা অর্জন করতে চায় তাহলে সেটা কোন পর্যায়ে কতটুকু হওয়া উচিৎ?
উত্তর : আমি মনে করি যদি মেধা অনুযায়ী শিক্ষার স্তর বিন্যাস হত তাহলে ঐ যোগ্যতা আপনাআপনি এসে যেত। একদল ছেলেকে দিয়ে উচ্চস্তরের কাজ নেয়া হবে। তো তাদেরকে বহুমুখী যোগ্যতায় গড়ে তোলার জন্য বক্তৃতা লেখালেখিও শেখানো হবে। এটা নেসাবেরই অর্ন্তভুক্ত থাকবে। প্রশ্নটা হয়ত এসেছে এজন্য যে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে ঐ ছেলে যেন বৈষয়িক সমস্যায় না পড়ে। ওরকম স্তর বিন্যাস হলে বৈষয়িক সমস্যায় পড়ত না।
প্রশ্ন : লেখালেখি বিশেষত অনুবাদের কাজে আমরা হুজুরকে বেশ ব্যস্ত ও তৎপর দেখতে পাই। লেখালেখির যোগ্যতা কি করে অর্জন করা যায়?
উত্তর : আমাদের দরসগুলো যদি সেভাবে চলত তাহলে এইসব যোগ্যতা অর্জনের জন্য আলাদা ফিকির লাগতো না। স্কুল কলেজের পাঠ শেষে উচ্চ পর্যায়ে যারা লেখাপড়া করে তাদের লেখার মৌলিক যোগ্যতা এমনিতেই অর্জিত হয়ে যায়। কারণ তাদের লেখার অনেক কাজ থাকে। বিস্তর লেখতে হয়।
আমাদের মাদরাসাগুলোতে লেখার বিষয়ে শিথিলতা আছে। শুরু থেকেই লেখার দিকে নজর রাখা উচিৎ ছিলো। যেখানে লেখার কাজ আছে সেখানে লেখার কাজটা যথার্থ হচ্ছে না। আরবী সাহিত্যের অনুবাদ আমরা নামকাওয়াস্তে করি। তখনই যদি ছাত্রদেরকে আদর্শ অনুবাদের পদ্ধতি ও কলাকৌশল শিখিয়ে দেয়া হয় এবং পরবর্তী অনুশীলনীগুলোতে সেভাবে চর্চা করানো হয় তাহলে সহজেই অনেক আদর্শ অনুবাদক বেরিয়ে আসবে। একইভাবে যেখানে রচনা লেখার অনুশীলনী আসে সেখানে রচনার ওপর যদি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয় তাহলে ধীরে ধীরে আমরা অনেক নতুন নতুন সৃজনশীল প্রবন্ধকার ও কলামিষ্ট খুজে পাব। অবশ্য এর জন্য ছাত্রের মধ্যে ঐ মৌলিক যোগ্যতা বা প্রতিভা কম বেশি থাকা জরুরী।
আমাদের ছাত্র জীবনে এমন কোন নেগরানী আমরা পাইনি। কিতাবে তরজমা এসেছে। উস্তাদ কাজ দিয়েছেন। পরের দিন এসে তরজমা শুনিয়ে দিয়েছি। কিন্তু লেখার ব্যাপারে কোন নিদের্শনা পাইনি। মুতানাব্বীর একটা কবিতা আসলো। কখনো আমাদেরকে বলা হয়নি এই কবিতার ভাব সম্প্রসারণ করে নিয়ে আসো। কখনো বলা হয়নি পদ্যকে গদ্যে রূপান্তর করো। এখন তোমাদের বেলায় করা হয় কিনা জানি না।
তো এখন যদি সেভাবে লেখার দিকেও নজর দেয়া হয় তাহলে মনে হয় লেখার যোগ্যতা ছেলেদের তৈরি হবে। এরপর যার আগ্রহ আছে সে উস্তাদ ও মুরুব্বীদের নেগরানীতে আরো অনুশীলন করতে পারে।
প্রশ্ন : কওমী শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ এখন সরকারী পরীক্ষা দেয়। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
উত্তর : এমনিতে আমাদের মাদরাসায় (জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া) স্কুলে পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা আছে ক্লাস টেন পর্যন্ত। তবে সার্টিফিকেট অর্জন মূল উদ্দেশ্য না। মুখ্য উদ্দেশ্য হলো আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে ছাত্রদেরকে পরিচিত করা। আমি আগেই বলেছি আমরা চাই ছাত্রদেরকে দাঈ বানাতে। আর দাঈ হতে হলে যমানা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। যুগের সাথে পরিচিত হতে হয়। এই বিষয়টি চিন্তা করে আমরা আধুনিক শিক্ষাটাকেও রেখেছি। এর ফলে ছেলেরা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে পারছে। ইংরেজী শিখতে পারছে। ভবিষ্যতে এর ওপর ভিত্তি করে আরো এগুতে পারবে।
তাছাড়া আধুনিক জ্ঞান থাকার ফলে ঐ শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের সাথে তারা কোন প্রকার অস্বস্তি ছাড়াই কথা বলতে পারবে। যদিও আধুনিক পড়া পড়তে গিয়ে সার্টিফিকেটও অর্জিত হয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা ছাত্রদের উৎসাহ দেই না যে, তোমরা সার্টিফিকেটকে কাজে লাগাও। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের ছাত্ররা ঐদিকে বেশি যায়ও না। এর বিপরীতে আলিয়ার পরীক্ষাকে আমি বেশি উপযোগী মনে করি না। কারণ আলিয়ার পরীক্ষায় অংশ নেয়ার উদ্দেশ্য সার্টিফিকেট ছাড়া আর কিছু না। অথচ আমরা সার্টিফিকেটের উৎসাহদাতা না। বরং স্কুলে পরীক্ষা দেয়ার মাকসাদ তো একটু আগেই বলে আসলাম আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে ছাত্রদেরকে পরিচিত করা।
প্রশ্ন : তাহলে পরীক্ষা দেয়ার কী দরকার, স্কুলের বইগুলো পড়িয়ে দিলেই তো হয়?
উত্তর : কেবল পড়ালেই ঐ ফায়দা অর্জিত হয় না যা পরীক্ষা দিলে হয়.... (হাসি)।
প্রশ্ন : এটা তো আপনাদের ওখানে আছে। কিন্তু সিংহভাগ মাদরাসায় নেই। সেখানকার ছাত্ররা সরকারী পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, অনেকেই আর ফিরে আসছে না?
উত্তর : এটা ভাবা উচিৎ তাদের। এর দ্বারা আরো ক্ষতি হচ্ছে। মাদরাসার ভেতরের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মেধাবী ছেলেগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। কাজেই মাদরাসার চিন্তা করা উচিৎ কিভাবে এদেরকে ফেরানো যায়। যদি মাদরাসাগুলো নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে আধুনিক শিক্ষাকে সিলেবাসভুক্ত করে অথবা পড়ার ঐচ্ছিক ব্যবস্থা রাখে তাহলে এই স্রোত হয়ত ঠেকানো যাবে। তোমাদের নজরে পড়েছে কিনা জানি না হযরত মাদানী (রহ) একটা নেসাব তৈরি করেছিলেন। সেখানে আধুনিক বিষয়ও ছিলো। হযরত থানবী (রহ)-ও অনুরূপ নেসাব তৈরি করেছিলেন। কালের আবর্তে সেগুলো হারিয়ে গেছে। আমার জানামতে পাকিস্তানের মাদরাসাগুলোতে এই ব্যবস্থা আছে। দারুল উলুম করাচীতে খুব সম্ভব মেট্রিক পর্যন্ত পড়ার এবং পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ আছে। অতএব আমাদের এই বিষয়ে ভাবার সময় অনেক আগেই হয়ে গেছে। আমরা উদ্যোগ নিতে দেরি করছি।
প্রশ্ন : আমাদের অনেক ছেলেই আলিয়াতে কেবল এ কারণে পরীক্ষা দেয় যে ওখানে পাস করা সহজ। এরপর সেই সনদ নিয়ে তারা আরবের ভার্সিটিগুলোতে পড়তে যায়। যে কেউ মনে চাইলেই কি এভাবে যাওয়া উচিৎ?
উত্তর : ছাত্র ইচ্ছা করলো আর চলে গেলো এমন না হয়ে পরিকল্পিত হওয়া উচিৎ। বড়দের সাথে পরামর্শ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ। কেননা মন চাই যাওয়ার দ্বারা লাভের চেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে। এরা গিয়ে নিজেরা বিভ্রান্ত হচ্ছে এরপর ফিরে এসে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
উদ্দেশ্য যদি এটাই হয় যে তারা গিয়ে দাঈ হিসেবে থাকবে, কাজ করবে। দুনিয়াদার বা ঝগড়াটে হয়ে যাবে না Ñতাহলে সেটাও পরিকল্পনা সাপেক্ষ হওয়া উচিৎ। গণহারে সবাইকে ছেড়ে দেয়া উচিৎ না।
প্রশ্ন : একটা শূন্যতা আমরা অনুভব করি। রাজনীতির মাঠে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অভিজ্ঞ কোন লোক নেই আমাদের। আইনী ক্ষেত্রেও লোক নেই....
উত্তর : এখন আলিয়া মাদরাসার সার্টিফিকেট নিয়ে ঐসব ভার্সিটিতে গিয়ে পড়লেই কি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা এডভোকেট হয়ে যাবে? কখনো হবে না। বরং তার জন্য সুচিন্তিতভাবে নেসাব তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রনীতি অর্থনীতি এগুলো নেসাবে থাকা চাই। আমাদের বর্তমান নেসাবে অর্থনীতি নামকাওয়াস্তে আছে। এগুলোর মত কঠিন বিষয়ে হঠাৎ করেই একটা বই পড়ানো হচ্ছে। এর দ্বারা ছাত্র রাজনীতি-অর্থনীতির আগা মাথা কিছুই বোঝে না।
অন্যান্য বিষয়কে যেমন প্রাথমিক মাধ্যমিক স্তর থেকে ক্রমপর্যায়ে পড়িয়ে আনা হয়, রাষ্ট্রনীতি অর্থনীতি সেভাবেই রাখা উচিৎ ছিলো।
প্রশ্ন : রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, আইন ইত্যাদি নেসাবের মধ্যে ঢুকালে সেটা ছাত্রদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠবে না?
উত্তর : চাপ বা বোঝা হয়ে উঠার দুটি কারণ। এক, শর্ট নেসাব। শর্ট বলতে আমি প্রচলিত শর্ট কোর্সকে বুঝাচ্ছি না। বরং শর্টতো আমরাও করেছি। যেমন কাফিয়া-শরহে জামী একসাথে পড়া। এই দুই কিতাবের উভয়টা পড়ার প্রয়োজন না থাকুক, অন্য কিতাবগুলো পড়ার প্রয়োজন আছে। কানযুদ দাকায়েক পড়ার উপযুক্ত না হলে এর বদলে সমকালীন মাসআলার অন্য কোন কিতাব পড়ানো হোক। নেসাবকে সংকুচিত করা উচিৎ হয়নি। হেদায়া জালালাইন একত্র করে ফেলেছে। অথচ আলাদা যখন ছিলো একটু সহজতা ছিলো, সেই ফাঁকে রাষ্ট্রনীতি অর্থনীতি অর্ন্তভুক্ত করা যেত।
দ্বিতীয়ত, কোনটার গুরুত্ব বেশি কোনটার কম সেই বিবেচনা করা হচ্ছে না। পড়ার দরকার তো সবগুলোই। কিন্তু নেসাবের মধ্যেই সবগুলো হজম করিয়ে দেয়া সম্ভব না বিধায় যে বিষয় ও কিতাব বেশি জরুরী সেটাকে সামনে রাখা দরকার। বর্তমানে প্রয়োজন সত্ত্বেও একটা বিষয়কে আমরা অন্তর্ভুক্ত করতে পারছি না এই কারণে যে, কম দরকারি একটা রয়ে গেছে। যার ফলে কিতাবের চাপ ।
অতএব দুটো কাজ করতে হবে। অল্প সময়ে আলেম হওয়ার প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে নেসাবের মধ্যে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
প্রশ্ন : কওমী স্বীকৃতির বিষয়ে আপনার মনোভাব জানতে চাই।
উত্তর : আমি সমর্থন করি না। আমরা দাওরায়ে হাদীসের মান নির্ণয় করব এমএ দ্বারা। এটা তো ইলমে নববীর এক প্রকার অপমান। দুনিয়ার সকল জ্ঞান মিলেও তো একটা হাদীসের সমান হবে না।
আর জাগতিক বিচারেও স্বীকৃতির দাবি যৌক্তিক না। একটা ছেলে যেখানে সতের আঠার বছর পড়ে এমএ পাশ করে সেখানে আমরা সাত বছরেই সমান মান চাই।
প্রশ্ন : তার মানে আপনি বলতে চাইছেন এমএ পাশ করা একটা ছেলে আপন বিষয়ে যতটুকু যোগ্যতা ও গভীর জ্ঞান অর্জন করে, দাওরায়ে হাদীস পাশ করা একটা ছেলে তার নিজের বিষয়ে ততটুকু যোগ্যতা অর্জন করে না?
উত্তর : আলবৎ না। সমর্থন না করার এটাও একটা কারণ। কেউ কেউ যে যোগ্যতা অর্জন করে সেটা তার নিজস্ব মেহনত ও আগ্রহের কারণে, নেসাবের কারণে না।
প্রশ্ন : ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে জানতে চাই।
উত্তর : আমি একদম সমর্থন করি না। ছাত্র রাজনীতি স্কুল-কলেজকে ধ্বংস করেছে। যেসব মাদরাসায় ঢুকেছে সেগুলোও ধ্বংসের পথে। সে তো তালিবে ইলম। তার কাজ ইলম অর্জন করা। ফিল্ডের বা ময়দানের কাজে সে নামবে কেন? ওটা তো ছাত্রসুলভ কাজই না। ওটা তার ছাত্র জীবনের পরের কাজ। বা অন্যদের কাজ।
রাজনীতি মাদরাসা কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। এটা তো উচিৎ না। আমাদের উলামায়ে কেরামের রাজনীতি গণবিচ্ছিন্ন। রাজনীতি করবে জনগণকে নিয়ে। ছাত্রদের ব্যবহার করবে কেন?
প্রশ্ন : সর্বশেষ একটা প্রশ্ন পাবলিক রিলেশন বিষয়ে। আমরা কেমন যেন জনগণ থেকে দূরে দূরে থাকি। জনগণও আমাদের ভিন্ন একটা প্রজাতি মনে করে। দুই সম্প্রদায়ের মাঝে দূরত্ব কাজ করে। কেন? এটা নিরসনের উপায় কী?
উত্তর : এটা তো আমার দীর্ঘ দিনের মনোবেদনা ও যন্ত্রণা। আমরা এক ভিন্ন প্রজাতি হয়ে আছি। আমরা জনগণের অংশ। জনগণকে নিয়েই তো আমাদের জীবন। مـدعـو বিহীন داعـى তো হতে পারে না। مـدعـو দাঈর অংশ। দাওয়াতের বুনিয়াদ হলো খিদমতে খালক। অথচ খিদমতে খালেকের সাথে আমাদের সম্পর্ক নেই। এই বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবা দরকার। আমরা নিজেদেরকে এবং নিজেদের মাদরাসাকে কী করে জনগণের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারি। মাদরাসা হবে জনগণের। জনগণ জানবে এখানে কী হচ্ছে। এজন্য মাদরাসার যেমন ছাত্র গড়ার কর্মসূচী থাকবে তেমনি মহল্লার জনগণের জন্যও তার কর্মসূচী থাকবে। যাতে দ্বীনের সাথে জনগণ সম্পৃক্ত হতে পারে। মাদরাসাকে যেন নিজেদের প্রাণের জিনিস মনে করে। এটা হবে তখনই যখন মাদরাসার সাথে গণমানুষের নিবিড় সম্পর্ক হবে।
এখন জনগণের আছে কেবল পরিচালনা কমিটি। ওটা কেবল সদস্যদের চাঁদা দেয়া এবং পরিচালনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটা আমাদেরই অক্ষমতা। আমাদের গুরুত্ব সহকারে পাবলিক রিলেশনের ব্যাপারে ফিকির করা উচিৎ। আগ্রহ তাওফীক দান করুন।
প্রশ্ন : আমাদের সময় দেয়ার জন্য শুকরিয়া।
উত্তর : তোমাদেরকেও ধন্যবাদ। কষ্ট করে আমার বাসা পর্যন্ত এসেছো। আল্লাহ তোমাদের এই মেহনতকে কবুল করুন।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম / এইচএ