মুফতি মুহাম্মদ আমিমুল ইহসান : আমাদের কাছে এক মহিমান্বিত মাস, মহান অতিথি এসেছে। আসুন আমরা কিছুক্ষণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে কাটাই। দেখি তিনি কিভাবে এই মহান মাসকে বরণ করেছেন, কিভাবে এই মুহতারাম মেহমানের মেহমানদারী করেন। কারণ, তিনি মাসুম... আমাদের পিতা মাতা তার প্রতি কুরবান হোক, তাঁর কথার দ্বারা অন্য কথা মাপা হয়... তাঁর আমল দ্বারা অন্য আমল ওজন করা হয়... তাঁর কাজ দ্বারা সব কাজ দুরস্ত করা হয়... তাইতো আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনের মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে, এমন প্রতিটি ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ তায়ালার সাক্ষাৎ পেতে আগ্রহী এবং আখেরাতের মুক্তির আশা করে, সে বেশি পরিমাণে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করে।’ সুরা আহজাব : ২১
কতই না সফল সে, যে তার আনুগত্য করেছে, তার সুন্নাতের অনুসরণ করেছে, তার সিরাত গ্রহণ করেছে। কত ক্ষতিগ্রস্থ সে, যে তার বাণী উচ্চারণ করেছে সত্য; কিন্তু তার কথা কাজের বিন্দুমাত্র অনুসরণ করেনি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসকে মহা সমারোহে বরণ করতেন। হাদিসে এসেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন রমজানের নতুন চাঁদ দেখতেন তখন বলতেন, ‘হে আল্লাহ তুমি ওই চাঁদকে আমাদের ওপর উদিত কর নিরাপত্তা, ইমান, শান্তি ও ইসলামের সাথে। হে চাঁদ আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ। হেদায়েত ও কল্যাণময় চাঁদ। সুনানে তিরমিজি : ৩৪৫১
আকাশের নতুন চাঁদকে ‘আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ’ বলার মধ্যে তাওহিদের কী দৃপ্ত ঘোষণা, বিশুদ্ধ আকিদার কী চমৎকার অনুশীলন। ওই সময়ের আরব মুশরিকরা আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে চাঁদের ইবাদত করতো। এ জন্যই যেন তিনি চাঁদকে বলছেন, হে চাঁদ, আমি যেমন আল্লাহর সৃষ্টি, তুমিও তেমন আল্লাহর সৃষ্টি। ‘আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ’। তুমি আমার লাভ, ক্ষতি, জীবন, মরণ, রিজিক, দৌলত কোনো কিছুর মালিক নও। ওই সব মানুষ তো মহা ভুলে আছে যারা আল্লাহকে ছেড়ে তোমার ইবাদত করে। আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নতুন মাসের ও রমজান আগমনের সুসংবাদ দিতেন।
রমজান এমন এক মহা সুযোগ যার কোনো বিনিময় হতে পারে না। মুসলিম জীবনে এক মহা নেয়ামত। মহান আল্লাহ প্রতি রাতে জাহান্নাম অবধারিত ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। আর মাসের সর্বশেষ রাতে ওই পরিমাণ পাপীকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যে পরিমাণ সারা মাসে দিয়েছেন।
এই শ্রেষ্টত্বের চেয়ে বড় আর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব থাকতে পারে?
দুনিয়ার বাদশাহদের নিয়ম হলো যখন তাদের গোলাম
গোলামি করতে করতে বৃদ্ধ হয়ে যায়; আযাদ করে দেয়
হে আমার মালিক তুমি তো এর চেয়ে বেশি সম্ভ্রান্ত
আমি তো গোলামিতে বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি; জাহান্নাম থেকে মুক্ত কর আমায়॥
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব লোকের চেয়ে অধিক দানশীল ছিলেন। আর মাহে রমজানে যখন জিব্রাইল আ. তার সাথে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি আরো বেশি বদন্যতা প্রকাশ করতেন। জিব্রাইল আ. মাহে রমজানের প্রত্যেক রাতেই তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তার কাছে কুরআন পুনরাবৃত্তি করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিব্রাইল আ. এর সাথে সাক্ষাতকালে কল্যাণবহ মুক্ত বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হতেন। মুসলিম : ২৩০৮
মুক্তবাতাসকে আপনি ঝড়ো হাওয়াও বলতে পারেন। যার উল্টোটাকে ঝিরিঝিরি বাতাস বলে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসে সবার চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন...
যাই চাওয়া হতো তিনি ‘না’ বলতেন না... তাশাহহুদ ছাড়া অন্য কোথাও তিনি না বলতেন না, যদি তাশাহহুদ না থাকতো, তাহলে তার ‘না’ টা ‘হ্যাঁ’ হয়ে যেত। এ ছাড়াও রমজানে তিনি আরো বেশি বেশি সৎকাজ করতেন। বেশি বেশি দান করতেন। সাধারণ মুসলমানদের সাথে আগের তুলনায় আরো বেশি হাসি মুখে সাক্ষাৎ করতেন। আত্মীয়দের আরো বেশি খোঁজ খবর নিতেন। তার ন¤্রতা যেন আগের থেকে আরো বেড়ে যেত।
তিনি পবিত্র। তার বাণী পবিত্রতম। তার সাক্ষাত পবিত্র। তার দান পবিত্র। তিনি ভেতর বাহির সব দিক দিয়েই সৎ। প্রকাশ্য গোপন সবখানেই তিনি উত্তম।
তিনি এমন দানশীল যে, তার সাথে দানবীর হাতেম তাঈ এর তুলনাই হতে পারে না...
তিনি এমন বাহাদুর যে, তার সাথে মহাবীর আনতারার তুলনা দেয়ার সাহস হয় না...
তিনি এমন বাগ্মী যে, তার সামনে শ্রেষ্ঠ বক্তা কিস বিন সায়েদার তুলনা করা যায় না...
মহান আল্লাহ তাকে কতই না উত্তম বানিয়েছেন... ‘নিঃসন্দেহে আপনি মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত রয়েছেন।’ সুরা আল কলম : ৪
‘আল্লাহর অসীম দয়ায় আপনি তাদের জন্য ছিলেন কোমল প্রকৃতির মানুষ। এর বিপরীতে যদি আপনি নিষ্ঠুর ও পাষাণ হৃদয়ের মানুষ হতেন, তাহলে এসব লোক আপনার আশ পাশ থেকে সরে যেতো। ‘আল ইমরান : ১৫৯
‘তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসুল এসেছেন, তোমাদের কোনো রকম কষ্ট ভোগ তার উপর দুঃসহ বোঝার মতো, তিনি তোমাদের একান্ত কল্যাণকামী, ইমানদারদের প্রতি তিনি স্নেহপরায়ণ, পরম দয়ালু।’ সুরা তওবাহ : ১২৮
তিনি রমজান মাসকে বিশেষায়িত করতেন কুরআনের জন্য। অনেক ওলামায়ে কেরাম এটা বুঝেই রমজান মাসে ফিকহ, ফতোয়া, দরস, তাদরিস, বাইরের সব যোগাযোগ, সবকিছু ছেড়ে কুরআন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। পরস্পরে কুরআন পাঠ করতেন। অসুস্থততায় কুরআনের ঔষধ দিতেন। ক্ষতস্থানে কুরআনের মলম লাগাতেন। আকাশ জমিনের অধিপতির অপার অনুগ্রহে সব রোগ বালাই দূর হয়ে যেত। কারণ, কুরআন সব রোগের শেফা।
শবে কদরে নাজিল হয়ে কুরআন মানবজাতির কাছে রমজানে এসেছে, সেই মৃত জাতিকে জীবিত করতে যাদের প্রকৃত জীবনকে চিনত না... সেই জাতির দৃষ্টিকে আলোকিত করতে যারা দৃষ্টির আলো, আলোর দৃষ্টি থেকে মাহরুম ছিল... সেই জাতিকে উপরে ওঠাতে যারা ছিল মাটিতে, আরো নিচে... ‘রাসুলের নবুওয়াতের দিনে সকল মাখলূকের প্রতি তাকালেন দয়াময়, তাকিয়ে সবার অবস্থা পরিবর্তন করে দিলেন, বরং যখন সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুকের মধ্যে থেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং নতুন চাঁদকে নির্বাচিত করলেন, তখন মানুষের সম্মান আরো বাড়িয়ে দিলেন।’
(দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন আগামী কাল)
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম / আরআর