মাওলানা আবদুল্লাহ আল ফারুক : শিশুদের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা ছিলো অগাধ ও অসীম। রহমতের নবীর প্রীতিময় সোহাগের প্রতিটি বিন্দু অবারিত ছিলো তাদের জন্যে। এমনিতেই তো নবীজির ভালোবাসার উপচে পড়া সিন্ধু ছোট-বড় প্রত্যেকের জন্যে উম্মুক্ত ছিলো। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে সেই ভালোবাসার প্রাবল্য যেনো আরো বেশি হয়ে ওঠতো। সীরাতের বইগুলোতে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা সমুজ্জ্বল হয়ে আছে আপন বিভায়। সংখ্যা গুণে নয়, সেখান থেকে মনে ধরেছে, এমন কয়েকটি সুচয়িত গল্প আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
আমরা আমাদের যাপিত জীবনে দেখতে পাই, অনেক বাবাই তার সন্তানের জন্যে মুখিয়ে থাকেন না। শিশুর পাশ দিয়ে অনেক বড়কে দেখা যায় হেঁটে যাচ্ছেন নির্বিকার চিত্তে। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলবৎ এমন ছিলেন না। কোনো শিশুকে দেখলে তিনি প্রাণবন্ত উচ্ছল না হয়ে পারতেন না। স্নেহের আঁচল ছড়িয়ে কাছে টেনে নিতেন। বুকের মমতায় সিক্ত করতেন। ভালোবাসার প্রীতিময় বাহুডোরে জড়িয়ে রাখতেন।...
নবীজির প্রতি মদীনার শিশুদের ভালোবাসাও ছিলো অন্য রকম। পথের মোড়ে, বাড়ির ধারে নবীজির প্রতি দৃষ্টি পড়লেই তারা ছুটে আসতো। কোলে ওঠার বায়না ধরতো। কতোরকম দুষ্টুমিতে মেতে ওঠতো।...
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়িতে এসে হাসান ও হুসাইনের সঙ্গে খেলা করতেন। প্রিয় নানাজানকে ওরাও খেলায় শরিক করে নিতো। সেজদারত নবীজির পিঠে দু’ভাই এসে বসে যেতো। অশ্ব বানিয়ে দাপিয়ে বেড়াতো। নামাযরত নবীজি অপেক্ষা করতেন, সংযম প্রদর্শন করতেন। তাদের নিজ ইচ্ছায় পিঠ থেকে নেমে যাওয়ার অপেক্ষায় থেমে থাকতেন।...
নামায শেষে নবীজিও তাদের সঙ্গে শিশুসুলভ খেলায় মেতে ওঠতেন। বালখিল্যতা করতেন। তাদের এই দুষ্টুমির জন্যে কখনো তিনি চোখ বড় করেননি। রুক্ষ শব্দ বলেননি। বরং তাদের প্রতিটি আচরণ উপভোগ করতেন।
হয়তো কেউ ভাবছো, আদরের কন্যা ফাতেমার সন্তান হওয়ার কারণে তাদেরকে তিনি ভালোবাসতেন। যেমনটি দেখা যায়, প্রত্যেক দাদা-দাদী, নানা-নানী নিজ দৌহিত্রদের সঙ্গে খুন-সুটি করে থাকেন। এমনটি আদৌ নয়। নবীজির ভালোবাসা কোনো আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধা পড়তো না। রক্ত ও আত্মীয়তার ব্যবধান ডিঙিয়ে তাঁর ভালোবাসা ছিলো প্রতিটি কোমলমতী শিশুর জন্যে। সব শিশুকেই তিনি সমান স্নেহের চোখে দেখতেন। আর ছেলেশিশু কি মেয়েশিশু― এ পার্থক্যের তো প্রশ্নই ওঠে না।...
তাই তো দেখতে পাই, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন নামায শেষে উপস্থিত লোকদের বলছেন― ‘আমি অনেক সময় ছোট্ট শিশুর কান্নার কারণে নামায সংক্ষিপ্ত করে ফেলি’।
কারণ, শিশুর কান্না নবীজির প্রাণে বিঁধতো। আল্লাহঅন্ত মন নিয়ে নামাযে দাঁড়ানো সত্ত্বেও শিশুর কান্না শোনতেই অস্থির হয়ে ওঠতেন। কখন নামায শেষ করবেন, কখন শিশুটিকে জড়িয়ে ধরবেন, কখন তাঁর চোখের লোনা অশ্রুর মুক্তোসদৃশ্য দানাগুলো মুছে দেবেন... সেই ব্যাকুলতায় প্রিয় নামাযকেও সংক্ষিপ্ত করে ফেলতেন।
হয়তো তোমাদের কেউ ভাবছে, নবীজি বুঝি শুধু কান্নারত শিশুর জন্যেই হৃদয়ের তারল্য অনুভব করতেন। এমনটি আদৌ নয়। বরং নবীজি ছোট্ট শিশুকেও প্রাপ্য সম্মান জানাতে ভুলতেন না। হযরত আনাস বিন মালিক রাদি. বলেন― নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে সালাম জানাতেন।
তিনি বলেন― নবীজিকে আমি সবসময় শিশুদেরকে সালাম দিতে দেখেছি। কোনো দিন তার এ আচরণে ব্যত্যয় ঘটতে দেখিনি। তিনি তাদের সম্ভাষণ জানাতেন। এগিয়ে এসে জড়িয়ে নিতেন। তাদের ভালোবাসতেন। প্রাপ্য সম্মানটুকু জানাতে কোনো দিন কার্পণ্য করতে দেখিনি।...
শিশুদের প্রতি নবীজির অসাধারণ মমত্ববোধের কথা সাহাবায়ে কেরাম জানতেন। এ কারণে নবীজি যখন কোনো যুদ্ধ বা সফর শেষে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করতেন, তখন তারা নবীজিকে অভ্যর্থনা জানাতে শিশুদের পাঠিয়ে দিতেন।...
বাড়ি ছেড়ে এতো দূর চলে আসা শিশুদের দেখে নবীজি স্থির থাকতে পারতেন না। নিজে বাহন থেকে নেমে আগত শিশুকে কোলে তুলে নিতেন। এরপর তাকে পেছনে বসিয়ে মদীনার দিকে যাত্রা করতেন। সৌভাগ্যের বাতাবরণে এভাবে তিনি তাদের জড়িয়ে রাখতেন।
মনে পড়ে, মককা থেকে হিজরত করে নবীজি মদীনার প্রান্তসীমায় চলে এসেছেন। নবীজির অভ্যর্থনায় গোটা মদীনা ভেঙে পড়েছে। শিশুরা একসঙ্গে গেয়ে ওঠেছে―
ত্বলা‘আলা বাদরু আলাইনা
মিন সানিয়্যাতিল ওয়াদা‘....
ওয়াজাবাশ শুকরু আলাইনা
মাদা‘আ লিল্লাহি দা‘....
অভ্যর্থনারত শিশুদের দেখে নবীজির কোমল প্রাণ চঞ্চল হয়ে ওঠেছিলো। তিনি হৃদয় ভরে তাদেরকে দু’আ দিয়েছিলেন। এই শিশুরাই তো পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের একেকজন মহানায়ক। তাদের হাত ধরেই তো সম্পন্ন হয়েছিলো মককা বিজয়।... তাদের মাধ্যমেই তো পতপত করে গোটা দুনিয়াতে উড্ডীন হয়েছিলো ইসলামের বিজয়কেতন।...
শিশুদের প্রতি নবীজির ভালোবাসার একগুচ্ছ গল্প বললাম। যেখানে নবীজি তাদেরকে ভালোবেসেছেন। সম্মান দিয়েছেন। হৃদয়ের কোমলতায় জড়িয়ে নিয়েছেন। নিজের বাহনে তুলে নিয়েছেন। গায়ের ধুলো-বালি ঝেড়ে দিয়েছেন। খেলা করেছেন।...
তাদেরকে তিনি সাত বছর বয়সে নামায পড়তে শিখিয়েছেন। ঈমানের আলোয় দীক্ষিত করেছেন। আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হতে শিখিয়েছেন। রহমতের নবী মানবতার ছবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ভালোবাসাই তো তাঁকে করে তুলেছে মহান। যেই শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ায় দ্বিতীয় কেউ নেই।