শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
‘প্রকৃতপক্ষে ভুল হলে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত আ.লীগ’ সিইসিসহ নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনাররা শপথ নেবেন রোববার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য হলেন মুন্সিগঞ্জের নিরব ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু বাজারে এলো ইনফিনিক্সের সবচেয়ে স্লিম স্মার্টফোন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন: বেঁচে ফেরার আশা করেনি সানিয়া মুসলিম কমিউনিটি কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার কমিটি গঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন: অর্থের অভাবে অনেক আহতের হচ্ছে না চিকিৎসা কোটি টাকার সহায়তা নিয়ে ফিলিস্তিনিদের পাশে হাফেজ্জী চ্যারিটেবল সোসাইটি ফরিদপুরে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ‘কুরআন সবক অনুষ্ঠান’র উদ্বোধন

প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা, তৎপর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

2012-12-06-16-46-57-50c0cc014e4bf-6পুলিশি শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির অলিখিত সন্ধির কারণে প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা করছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। তাই মাঠপর্যায়ে পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি চিঠি এবং এর সঙ্গে পাঠানো এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পুলিশের বেলায় দেখা যায়, অনেকে রাজনৈতিক ও অবৈধ টাকার জোরে অতিরিক্ত এসপি থেকে পদোন্নতি পেয়ে জেলার এসপি হিসেবে পদায়ন পায়। আর এসব এসপি জেলায় পদায়ন পেয়েই ধরাকে সরা জ্ঞান করেন এবং তাদের অনেকের মূল লক্ষ্য থাকে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে অর্থ উপার্জন। ফলে সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা রকম হয়রানির শিকার হয়।’ একইভাবে উপজেলা পর্যায়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওসি) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) অনেক ক্ষেত্রে পাশ কাটিয়ে যান বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
মাঠ প্রশাসনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারের (এসপি) মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, মন্ত্রিপরিষদ, জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্রসচিবকে এই চিঠি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। চিঠির সঙ্গে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের মধ্যে বৈরী সম্পর্কের কারণে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরিচালনায় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জনসাধারণের ওপর। এতে সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে।
প্রতিবেদনে পুলিশ ও প্রশাসনের দ্বন্দ্বের কারণে মাঠপর্যায়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির উদাহরণ, বিশ্লেষণ ও সুপারিশ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের চিঠি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকারকে চিঠি দিচ্ছে। একইভাবে জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সংশ্লিষ্টদের চিঠি পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের প্রতিবেদনে ডিসি-এসপিদের উদ্দেশে বলা হয়, ‘বিচ্ছিন্নভাবে আমরা কেউ না, বরং প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পরিপূরক’ এমন মানসিকতার অভাব রয়েছে ডিসি ও এসপিদের মধ্যে। তাই মাঠ প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, রুলস অব বিজনেসে ডিসি ও এসপির কাজ ও দায়িত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার নির্দেশনা দেওয়া আছে এবং প্রত্যেকের কাজেরই জবাবদিহির বিধান রয়েছে। তাই ডিসি-এসপির মধ্যে প্রশাসনিক কাজের অবনতি হলে সেটা হবে আইনের বরখেলাপ।
জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ স্বরাষ্ট্রসচিব মোজাম্মেল হক খান প্রথম আলোকে এ প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেদনে চেইন অব কমান্ড ভেঙে যাওয়ার যে আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে সুপারিশ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। সারা দেশে এ অবস্থা সৃষ্টি না হলেও নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, জামালপুর ও নবাবগঞ্জের ঘটনাগুলোর কথা সবাই জানেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ে পরিস্থিতির যাতে কোনোভাবেই অবনতি না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমরা সংশ্লিষ্টদের দু-এক দিনের মধ্যে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
দ্বন্দ্বের কারণ বিশ্লেষণ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মাঠ প্রশাসনে ডিসি ও এসপির মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। কে কার চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান সে প্রতিযোগিতায় ডিসি-এসপিরা এখন মুখোমুখি। হাতে অস্ত্র থাকা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হওয়ার কারণে পুলিশের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সখ্য বেশি। পুলিশি শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির অলিখিত সন্ধির কারণে এসপিরা নিজেদের মতো করে চলার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে জেলা প্রশাসনের প্রধান হিসেবে ডিসিরাও ব্রিটিশ আমলের মানসিকতা থেকে এখনো বের হতে পারছেন না। সে কারণেও উভয় প্রশাসনের মধ্যকার দূরত্ব ক্রমে বাড়ছে। সব মিলিয়ে এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, সিভিল প্রশাসনের যে কর্মকর্তাদের (উপসচিব) ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাঁরা বয়স এবং চাকরি—উভয় ক্ষেত্রে জেলার এসপিদের থেকে জ্যেষ্ঠ। বর্তমানে ডিসির দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা ১০ থেকে ১৩তম বিসিএসের কর্মকর্তা। আর এসপি হিসেবে যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁরা বিসিএস ১৭ থেকে ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা। বয়সে ও চাকরিতে জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও অনেক এসপি জেলা প্রশাসকদের অবজ্ঞা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
রুলস অব বিজনেস না মানার অন্যতম কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতারা, বিশেষ করে স্থানীয় সাংসদ ও অন্যরা পুলিশের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। ফলে অস্ত্রের শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির সখ্য বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের অবজ্ঞা করা প্রবণতা বাড়ছে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন রাজনৈতিক শক্তিকে নিজের শক্তি মনে করছে, তখনই রুলস অব বিজনেস ভঙ্গের ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে পুলিশ প্রশাসনের অভিযোগ, সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তারা সব সময়ই নিজেদের কুলীন মনে করেন এবং তাঁরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা থেকে বের হতে পারছেন না।’
জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, ‘পুলিশ ও প্রশাসনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তা সারা দেশের চিত্র নয়। তবু আমরা এ ধরনের ঘটনাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
দুটি ঘটনা: প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনের আগে গত ৮ জুন নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন এসপি আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। একই দিনে সে সময়কার জেলা প্রশাসকও আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক আহ্বান করেন। এসপির বৈঠক বিষয়ে ডিসি অবগত ছিলেন না। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, জেলার আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে বৈঠক ডিসিরই আহ্বান করার কথা। এ ধরনের বৈঠক বা সভা এসপি ডাকতে পারেন না। এ নিয়ে প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হলে এ বিষয়ে তদন্তের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়। চিঠিতে রুলস অব বিজনেস অমান্য করে এসপি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন তারও জবাব চাওয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে।
সূত্র জানায়, এ ঘটনার পর সেখানকার ডিসি ও এসপিকে প্রত্যাহার করা হয়। বর্তমানে ওই জেলায় ডিসি হিসেবে মো. আনিছুর রহমান মিয়া ও এসপি হিসেবে খোন্দকার মহিদ উদ্দিন দায়িত্ব পালন করছেন।
বর্তমানে সেখানকার পরিস্থিতি কেমন জানতে চাইলে ডিসি ও এসপি দুজনই প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। তাঁরা মিলেমিশেই কাজ করছেন।
প্রতিবেদনে দ্বিতীয় উদাহরণটি ছিল মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার সেই আলোচিত ঘটনা। গত ২২ মার্চ উপজেলা নির্বাচনের দিন মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা এ টি এস মাহবুবুল করিমকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও পিস্তল দেখিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেন লৌহজং থানার এএসআই মো. এমদাদ। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা এবং নির্বাচনী মালামালসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নষ্ট করার অভিযোগও আনা হয়। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছুদিন নির্বাচন কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মধ্যে কয়েক দফা চিঠি চালাচালি চলে। কিন্তু তখনকার এসপি হাবিবুর রহমান কারও কোনো নির্দেশ আমলে নেননি। পরে তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়।
জানতে চাইলে মুন্সিগঞ্জের ডিসি সাইফুল হাসান বলেন, ‘পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে ওসিরা পর্যন্ত ডিসির কথা শুনতে চায়নি। তবে বর্তমান এসপি বিপ্লব বিজয় তালুকদারের সাথে প্রশাসনের সম্পর্ক ভালো। জেলা পরিস্থিতি উন্নয়নে এসপির দৃশ্যমান ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
মুন্সিগঞ্জের বর্তমান এসপি বিপ্লব বিজয় তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আমাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছি। ডিসির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো।’
জানতে চাইলে জনপ্রশাসনসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে আমরা এ ব্যাপারে সচেতন রয়েছি।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, এর বাইরেও অনেক জেলায় এ ধরনের দ্বন্দ্ব আছে বলে উল্লেখ করা হয়।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয় যে, রুলস অব বিজনেসে ডিসি ও এসপিদের কাজ পরিচালনাসংক্রান্ত নীতিমালা সঠিকভাবে অনুসরণ করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কঠোর নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে।
প্রশাসনের এ পরিস্থিতিতে ও করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ