শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬


হামাস অর্থ কি? হামাসের পরিচয় ও ইতিহাস


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ফাইল ছবি

।।মুফতি রেজাউল করিম।।

হামাস অর্থ কি?

হামাস (আরবি: حماس) শব্দের অর্থ আশা, বা উদ্দীপনা। এটি মূলত حركة المقاومة الاسلامية হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া, “ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন” এর একটি আদ্যক্ষর।

ইজ্জদ্দীন আল কাসাম নামে হামাসের একটি সামরিক শাখাও রয়েছে। গাজা এবং পশ্চিম তীরে ইসলামি এই প্রতিরোধ আন্দোলন এর প্রকাশ্য আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৮৭ সালে, প্রথম ইন্তিফাদা’র মাধ্যমে।

হামাস এর প্রতিষ্ঠাতা কে?

হামাস এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন শেখ আহমেদ ইয়াসিন, যিনি মূলত ছিলেন তৎকালীন ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ফিলিস্তিন শাখার নেতা। ইয়াসিন ছিলেন পঙ্গু কিন্তু তবুও যুবক বয়স থেকেই তিনি ছিলেন গাজার নেতা। ১৯৭৮ সালে ৪৯ বছর বয়সী শেখ আহমেদ ইয়াসিন ফিলিস্তিনিদের সাহায্যের জন্য আল মুজাম্মা আল ইসলামি নামে একটি ইসলামি সংগঠন গড়ে তুলতে অধিকৃত ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন৷

ইসরায়েল তা মন্জুর করে, কেননা ইজরাইলের লক্ষ্য ছিল গাজায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা পিএলও এর গুরুত্ব হ্রাস করা। কিন্তু ইজরাইলের সেই প্রচেষ্টা বুমেরাং হয়ে যায় । খুব সহসাই তারা বুঝতে পারে শেখ আহমেদ ইয়াসিন বিচক্ষণ এবং পাক্কা মুসলমান। ইজরায়েলের মাথায় তাল রেখে কায়দা মত ঠিকই হামাসকে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। ১৯৮৮ সালে গৃহীত হয় “হামাস চার্টার” যার লক্ষ্য হলো অধিকৃত ফিলিস্তিন থেকে দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো

সংগঠন হিসাবে হামাস-

সংগঠন হিসেবে হামাস মূলত তিনটি শাখার সমষ্টি: রাজনৈতিক শাখা, সমাজকল্যাণমূলক শাখা এবং সামরিক শাখা। মজলিশে শূরা হামাসের প্রতিনিধিদের মিলনস্থল, যার মাধ্যমে হামাস সমগ্র ফিলিস্তিনে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তবে হামাসের নীতিনির্ধারণী পরিষদ হলো পনেরো সদস্যের “পলিটিক্যাল ব্যুরো”। 

বর্তমানে হামাসের প্রধান কে?

বর্তমানে গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসের প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইয়াহিয়া আল-সিনওয়ার। ২০২১ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে পুনর্নির্বাচিত হন তিনি।

২০১৭ সাল থেকে ইয়াহিয়া সিনওয়ার গাজায় হামাসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে ২০১১ সালে ২০ বছরের বেশি সময় ইসরায়েলের কারাগারে বন্দিজীবন কাটিয়ে মুক্ত হন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি গুপ্তচর হত্যাসহ কয়েকটি অভিযোগ ছিল।
২০১১ সালে অপহৃত ইসরায়েলি সৈনিক গিলাদ শালিতের সাথে বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসাবে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির ঘোর বিরোধী ইয়াহিয়া সিনওয়ার। এরপরও গাজা সীমান্তে শান্তি বজায় রাখতে তাঁর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে মিসরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে সদা উচ্চকণ্ঠ সিনওয়ার।

শিক্ষা:

টানা আট বছর অবরোধ এবং নানা ঝড়ঝাপটা সহ্য করেও গাজা উপত্যকায় শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে হামাস।

২০১২ সালের হিসাব মতে, গাজা উপত্যকায় শিক্ষার হার প্রায় ৯৯%। সেখানে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া প্রায় চার লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রীর জন্য ৬৮৩ টি স্কুল রয়েছে যার মধ্যে ৩৮৩ টি স্কুল সরকার অর্থাৎ হামাস পরিচালনা করে।স্বাস্থ্য সেবাঃস্বাস্থ্যসেবায় হামাস নিজেকে নিয়ে গিয়েছে এক অনন্য অবস্থানে। অব্যাহত অবরোধে থাকবার কারণে খাদ্যের মান কমে যাওয়ায় গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শৈশবকালীন অপুষ্টির হার মারাত্নক হারে বেশি। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েলি আগ্রাসনে আহত মানুষজনের চিকিৎসা প্রয়োজন তো রয়েছেই। হামাস পরিচালিত হাসপাতালে কম খরচে বা বিনা খরচে সুচিকিৎসা দেয়া হয়। মৃত্যু উপত্যকা গাজায় বর্তমান জন্মহার প্রায় ৪%। 

এছাড়াও শিশুদের জন্য অসংখ্য নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন স্কুল বা মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছে হামাস। যার মাধ্যমে তাদের এক বেলা খাবারও সরবরাহ করা হয়। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা বা দাতা দেশ থেকে আসা সাহায্য ও আর্থিক অনুদান ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট দক্ষতা ও স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছে হামাস; অপরপক্ষে ফাতাহ গোষ্ঠী এই দিকে আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জ। হামাসের এই সামাজিক কার্যক্রমের জনপ্রয়তা শুধু গাজা স্ট্রিপেই নয়, বরং ফাতাহ শাসিত পশ্চিম তীর এমনকি আশেপাশের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতেও অনেক বেশি জনপ্রিয়।

মিডিয়া:

২০০৬ সাল থেকে হামাস চালু করেছে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ‘আল আকসা টিভি’।

হামাসের মিডিয়া গুরু ফাতহি হাম্মাদের মিডিয়া হাউজ ‘আর-রিবাত কমিউনিকেশন্স’ এর নেতৃত্বে আরও রয়েছে নিজস্ব রেডিও স্টেশন ‘ভয়েস অফ আল আকসা’ এবং সংবাদ পত্রিকা ‘দ্য মেসেজ’। অনলাইন জগতে টুইটার এবং ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে রয়েছে হামাসের সরব উপস্থিতি। এছাড়া লন্ডন থেকে আল ফাতিহ নামে শিশু-কিশোরদের জন্যেও একটি পাক্ষিক পত্রিকা নিয়মিত বের করে।

সামরিক শাখা:

হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জদ্দিন আল ক্কাসাম ব্রিগেড যাকে সংক্ষেপে আল ক্কাসাম ব্রিগেড বলা হয়। এটি ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং তখন থেকেই ইসরায়েলকে সামরিকভাবে তটস্থ করে রেখেছে তারা। সীমিত সাধ্যের মধ্যেও লিমিটেড টেকনোলজী আর অর্থায়নে ক্কাসাম রকেট দিয়েই ইসরায়েলি বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের আয়রন ডোম অ্যান্টিমিসাইল সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ইসরায়েলের প্যাট্রিয়ট মিসাইল এবং এফ-১৬ এর মোকাবেলায় ক্কাসাম ব্রিগেডের ব্যবহার করা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে স্বল্প মাত্রার আল বানা, আল বাতার এবং আল ইয়াসিন রকেট, এছাড়াও ট্যাংক বিধ্বংসী গোলাসহ কিছু হালকা যুদ্ধাস্ত্র।

সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরের তলদেশ দিয়ে ইসরায়েলে পৌছে এক দুঃসাহসিক কমান্ডো অভিযানের চেষ্টা চালায় হামাস যোদ্ধারা। ইরানের পর মুসলিম দেশ হিসেবে সাফল্যজনকভাবে ড্রোন তৈরি করতেও সক্ষম হয়েছে হামাস, যা তেলাবিবের আকাশ পর্যন্ত পৌছে গিয়েছে। তবে হামাস যোদ্ধারা গ্রাউন্ড কমব্যাটে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত। প্রবাসী হামাস নেতা খালিদ মিশালকে হত্যার একাধিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং সিনবেথ, তবে হামাসের অপারেটিভদের সাহস এবং দৃঢ়তায় তারা সফল হতে পারে নি।


দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সীমাহীন আত্নত্যাগ, সততা – দক্ষতা ও নিপীড়িত মানুষের মধ্যে থেকে তাদের পাশে দাড়ানোর পাশাপাশি তাদের জন্য আমরণ লড়াইয়ের অদম্য মানসিকতাই হামাসকে দাঁড় করিয়েছে এক অনন্য অবস্থানে; শুধু ফিলিস্তিনিদের হৃদয়ে নয় বরং সারা বিশ্বের মজলুম সংগ্রামী মানুষের মধ্যে। আসুন আমরা ফিলিস্তিনের মর্দে মুজাহিদ হামাসের ভাইদের জন্য আল্লাহর দরবারে দুহাত তুলি।

লেখক: মুহাদ্দিস, আলোচক, গবেষক, সাংবাদিক।

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ