মঙ্গলবার, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ।। ২১ মাঘ ১৪৩১ ।। ৫ শাবান ১৪৪৬

শিরোনাম :
সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ রাখার পক্ষে যে যুক্তি দিলেন আলী রীয়াজ    ইনভেস্টর্স অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ ও IFAC-এর মধ্যে চুক্তি সম্পাদন জেসিআই বাংলাদেশ সিনেট সভা অনুষ্ঠিত চবিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) কে নিয়ে কটুক্তি, বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে কুরআন বিতরণ ইজতেমার দ্বিতীয় ধাপে যৌতুকবিহীন ২৩ যুগলের বিয়ে বিয়ের বয়স কত হওয়া উচিত? কী বলে ইসলাম আন্দোলনে সমর্থনের কারণে কারা নির্যাতিত প্রবাসীদের পুনর্বাসনের আহ্বান জমিয়তের এই জাতির অস্তিত্ব পাওয়ার লড়াই শুরু করতে হবে: জামায়াত আমির নূরানী শিক্ষক নিচ্ছে কুমিল্লার তিতাস থানার দারুস সুন্নাহ ইসলামিয়া মাদরাসা

গবেষণা করে হাদিস পড়ান এমন মুহাদ্দিস পাওয়া মুশকিল


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে যে কয়জন আলেম মেধা ও শ্রম দিয়ে গ্রহণযোগ্য অবস্থানে পৌঁছেছেন, মাওলানা লিয়াকত আলী তাদের অন্যতম। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি মিরপুরের মাদ্রাসা দারুর রাশাদের শিক্ষা সচিব ও জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়ার শায়খুল হাদিস। সম্পাদনা করেছেন কওমি মাদ্রাসার নেসাব ও নেজাম বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক গ্রন্থ ও স্মারক। তিনি দেশ রূপান্তরের মুখোমুখি হয়ে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিচালনাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিযানুর রহমান জামীল


দেশ রূপান্তর : কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি হয়েছে, কিন্তু কার্যকর হয়নি। কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে সনদের কার্যকারিতা বাড়ানো কি দরকার?

মাওলানা লিয়াকত আলী : হ্যাঁ, বাড়ানো দরকার। জাতীয় সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, এটা বড় একটা অর্জন। এই স্বীকৃতি যেমন ব্যতিক্রমী, তেমনি এর কার্যকারিতা এখনো সীমিত পর্যায়ে। সবপর্যায়ে এই স্বীকৃতি কার্যকর ও প্রয়োগের জন্য বেশকিছু ধাপ অতিক্রম করা এখনো বাকি। প্রথমত দাওরায়ে হাদিসের আগের স্তরগুলোর ধারাবাহিক স্বীকৃতি না থাকলে শুধু দাওরার সনদ গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের সনদও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আওতায় আনা প্রয়োজন।

এসব স্তরের পাঠদান ও কেন্দ্রীয় পরীক্ষাসমূহের তদারকি নিয়মতান্ত্রিক করার বিকল্প নেই। দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতি ও দরসে নেজামির স্বকীয়তা অক্ষুন্ন রেখে দেশীয় ও সমকালীন প্রয়োজনীয় বিষয়াদির সমন্বয়ে নতুন পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা প্রয়োজন। নইলে কওমি পড়ুয়ারা রাষ্ট্র ও সমাজের আর্থ-সামাজিক ক্রিয়াকলাপ ও বৈষয়িক পেশাগত জীবনধারায় আত্মনিয়োগ করতে পারবে না। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড একটা নতুন সিলেবাস করবে বলে শুনেছি। কওমি মাদ্রাসাগুলোর ছয় বোর্ড ও সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘আল হাইয়াতুল উলইয়া’ নতুন পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলে তা অনেক সহজ হবে।

তবে পাঠ্যক্রম পুনর্বিন্যাসের সময় এ কথা কিছুতেই ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, দেওবন্দের ধারায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান লক্ষ্য দীনের তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ তৈরি করা। তাই একটি পর্যায় পর্যন্ত দীনের সাধারণ ও মৌলিক বিষয় সম্পন্ন করার পরই যেন শিক্ষার্থীরা কর্মমুখী শিক্ষায় যায়, তা নিশ্চিত করে অগ্রসর হতে হবে। প্রস্তাব হিসেবে ‘শরহে বেকায়া’ পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে সম্মিলিত রাখার পর মেধাবী ও পরিশ্রমীদের বাছাই করে দীনী বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রেখে অন্যদের কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে।

তাছাড়া ‘হাইয়াতুল উলইয়া’ কর্র্তৃপক্ষ সনদের স্বীকৃতির প্রয়োগক্ষেত্র সম্প্রসারণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে আলোচনা ও যোগাযোগ করতে পারে। যেমন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল ও সরকারি মাদ্রাসার শিক্ষকতায় কওমি সনদের গ্রহণযোগ্যতা থাকলে এসব পদে কওমি পড়ুয়ারা প্রতিযোগিতা করতে পারবেন। এতে কওমি পড়ুয়াদের বিচরণক্ষেত্র বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি ইসলামি শিক্ষা চর্চায় নিয়োজিত ও নিবেদিত দুটি পক্ষের সম্মিলন ঘটবে। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে এই সংহতি প্রয়োজন ও ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করি।

দেশ রূপান্তর : কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা ও বেতন কাঠামো নির্ধারণ করাকে জরুরি মনে করেন কী?

মাওলানা লিয়াকত আলী : হ্যাঁ, অবশ্যই জরুরি মনে করি। চাকরিবিধির মধ্যে অনেকগুলো বিষয় থাকে, প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানের একটা জনবল কাঠামো থাকে। যেমন এ প্রতিষ্ঠান কোন পর্যায়ের! কোন পদে কয়জন শিক্ষক থাকবে, কোন স্তরে কয়জন থাকবে। এভাবে জনবল কাঠামো থেকে শুরু করে পুরো একটা চাকরিবিধি প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানের থাকা প্রয়োজন। আমি আগেও এ বিষয়ে বলেছি যে, ‘হাইয়াতুল উলইয়া’ এই বিধি তৈরি করে দিতে পারে। যা সব প্রতিষ্ঠান অনুসরণ করল, বর্তমানে চাকরিবিধি না থাকাটা জুলুম হচ্ছে। 

দেশ রূপান্তর : কওমি মাদ্রাসার পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেবেন? প্রায়ই বিভিন্ন মাদ্রাসায় মুহতামিম নিয়োগ নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে, এটা থেকে উত্তরণের পথ কী?

মাওলানা লিয়াকত আলী : আগেই বলেছি, প্রতিষ্ঠানভিত্তিক একটি চাকরিবিধি থাকবে। তাতে নিয়োগবিধি থাকবে। সেখানে এ বিষয়টি উল্লেখ থাকতে পারে যে, মুহতামিম বা পরিচালক কীভাবে নিয়োগ করা হবে! অন্য শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিধি কী হবে, তাদের যোগ্যতা কী হবে ইত্যাদি সব বিষয় সেখানে উল্লেখ থাকবে। এগুলো না থাকার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে মুহতামিম নিয়োগ নিয়ে। মুহতামিম বা শিক্ষক কীভাবে নিয়োগ হবে? কত দিনের জন্য নিয়োগ হবে? ইত্যাদি কোনো বিষয়ই নির্ধারিত থাকে না। এ জন্য বিষয়টি চাকরিবিধির অন্তর্গত হবে। কোনো একটা মডেল সামনে রেখে একটা বিধি তৈরি করা যেতে পারে। চাকরিবিধি তৈরি করা এই জটিলতা থেকে উত্তরণের একটি উপায়।

দেশ রূপান্তর : কওমি শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত নয়, এটাকে কোন দৃষ্টিতে দেখেন?

মাওলানা লিয়াকত আলী : কওমি আলেমদের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত না হওয়ার পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমত সনদের স্বীকৃতি, এটা না থাকার কারণে তাদের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হয় না বা সীমিত থেকে যায়। দ্বিতীয়ত সিলেবাস। আমাদের সিলেবাস দীনমুখী, কর্মমুখী নয়। কর্মমুখী বলতে জীবিকা উপার্জনের কাজ। এ জন্য সিলেবাস সংশোধন করা জরুরি। তৃতীয়ত দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা সাধারণ পেশায় যাব না, মাদ্রাসা-মসজিদে খেদমত করব ইত্যাদি।

এছাড়া কওমি আলেমদের কর্মসংস্থানের যে সীমাবদ্ধতা বিরাজ করছে এবং যা নিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে উদ্বেগের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, নেতৃস্থানীয় আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি কর্মক্ষেত্র সীমিত থাকার পেছনে অন্যতম প্রধান প্রভাবক। তারা দীনি শিক্ষার প্রসারকে কওমি পড়ুয়াদের প্রধান মনোযোগের বিষয় মনে করেন। গুরুজনদের উপদেশ অনুযায়ী কওমি আলেমরা শিক্ষকতাকে প্রাধান্য দেন। এমনকি ইমামতি কিংবা ওয়াজকে দীন প্রচারের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব দিলেও শিক্ষকতাকে প্রধান কর্মক্ষেত্র হিসেবে অক্ষুন্ন রাখতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকেন।

এক্ষেত্রে আমাদের এই মনোভাব লালন করা উচিত যে, শিক্ষকতা, ইমামতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে আলেমদের আত্মনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা কখনোই কমবে না। এসব ময়দানে খেদমতের যোগ্য ও উপযুক্ত আলেম তৈরির কর্মসূচি কিছুতেই দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না, তবে জীবিকা উপার্জন ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে বৈচিত্র্য ও বিস্তার শুধু নিজেদের জীপনোপকরণ সংগ্রহের জন্য নয়; বরং দীনের স্বার্থেই অপরিহার্য দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। লেনদেন, কায়কারবার ও আর্থ-সামাজিক অঙ্গনগুলোতে শরয়ি জ্ঞান ও শিক্ষার অধিকারী, দীনদারদের অনুপস্থিতির বিরূপ প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রের সবক্ষেত্র ও স্তরে দৃশ্যমান। তাই দীনি খেদমতগুলোর জন্য মেধাবী ও ইলমসাধক একটি নির্বাচিত অংশকে রেখে দিতে হবে। যেন পরিবর্তনশীল বিশ্বপরিস্থিতিতে ইসলামি বিশ্বাস, বিধিবিধান ও আখলাকের প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় তারা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন।

দেশ রূপান্তর : আমাদের দেশের মুহাদ্দিসরা যেভাবে কয়েক মাদ্রাসায় হাদিস পড়ানোকে গুরুত্ব দেন, সেভাবে গবেষণাকর্মে মনোযোগ দেন না, আপনার কী মনে হয়। এতে কি খেয়ানত হয় না?

মাওলানা লিয়াকত আলী : একেকজন মুহাদ্দিসের বিভিন্ন জায়গায় পড়ান এটা আমাদের ইলমি অধঃপতনের একটা আলামত। আল হাইয়াতুল উলইয়ার গ্যাজেট অনুসারে দেশে দাওরায়ে হাদিস মাদ্রাসা এক হাজারের বেশি। দেশে এত সংখ্যক শায়খুল হাদিস ও মুহাদ্দিস নেই বলেই একেকজনকে একাধিক মাদ্রাসায় পড়াতে হয়।

আরেকটা বিষয় হলো, এই যে আমরা বিভিন্ন জায়গায় পড়াই আমি সত্যিকার অর্থে বুকে হাত দিয়ে বলি আমি মুহাদ্দিস হওয়ার যোগ্য না। শতকরা ৯৫ জনই একথা স্বীকার করবেন যে, আমি মুহাদ্দিস হওয়ার যোগ্য নই; শূন্যতা পূরণ করছি। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় পড়ানোর কারণে আসলেই তারা গবেষণার সময় পান না এটাও সত্য। আর খেয়ানতের প্রশ্নে প্রত্যেকে নিজেই বলতে পারেন, তিনি খেয়ানত কতটুকু করছেন বা হক আদায় করতে পারছেন কি না।

আরেকটা কথা, এত দাওরায়ে হাদিস মাদ্রাসা খোলার কী দরকার? দাওরা খুলতে হবে বাছাই করা কিছু মাদ্রাসায়। সরকারি মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজে ওপরের শ্রেণি খোলার অনুমতির জন্য ন্যূনতম ছাত্র দেখাতে হয়। আরও অনেক শর্ত রয়েছে। আমাদেরও এটা হওয়া দরকার, দাওরা খোলার জন্য একটা নীতিমালা থাকবে, কমপক্ষে এতজন ছাত্র থাকতে হবে; না হলে সেখানে দাওরা খোলার অনুমতি দেওয়া যাবে না।

দ্বিতীয়ত দাওরায়ে হাদিস মানসম্পন্ন হওয়া। ঘরে ঘরে দাওরা হাদিস খুলে দিয়েছি, তাই মান রক্ষা করতে পারি না। ফলে একই মুহাদ্দিসকে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। মাদ্রাসা বেশি হওয়ার কারণে একজন সত্যিকারের মুহাদ্দিসকে যে পরিমাণ গবেষণা করা দরকার, সেই পরিমাণ কিছুই পাচ্ছি না। গবেষণা করে হাদিস পড়ান এরকম মুহাদ্দিস খুঁজে পাওয়া মুশকিল, এটা আমাদের অনেক বড় ঘাটতি।

দেশ রূপান্তর : নবীন আলেমদের জন্য আপনার বিশেষ কোনো পরামর্শ?

মাওলানা লিয়াকত আলী : নবীন আলেমদের কোনো পরামর্শ দিচ্ছি না, কিছু বিষয় তুলে ধরছি। প্রথমত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। তাদের কর্মক্ষেত্র মাদ্রাসা-মসজিদে সীমাবদ্ধ থাকবে না। দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি বলব, কর্মক্ষেত্র মসজিদ-মাদ্রাসার বাইরে হলে তাদের আমলের যে অবনতি ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখা আবশ্যক। তৃতীয়ত, মাদ্রাসা-মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা। দেখা যায়, মাদ্রাসা-মসজিদের বাইরে গেলে ইলমচর্চা ও অধ্যয়নের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক থাকে না। মসজিদ-মাদ্রাসার বাইরে গেলেও দীনদারি রক্ষা করা, আমল-আখলাক সহিহ রাখার পাশাপাশি ইলম চর্চা করা ও হেফাজত রাখা।

(লেখাটি দৈনিক দেশ রুপান্তর থেকে নেওয়া )

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ