বিএনপি এবার সরকার হটানোর একদফা দাবিতে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে নামতে যাচ্ছে । অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হবে সেই আন্দোলন। এরই মধ্যে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। এর পরই রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে শুরু হবে লাগাতার আন্দোলন। তখন ঢাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগ দেবেন সারা দেশের দলের কর্মী-সমর্থকরা। ঢাকা নগরীকে ঘিরে ফেলাই এবার বিএনপির মূল লক্ষ্য। মধ্য অক্টোবরে আন্দোলন সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার চিন্তা তাদের। আর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে চায় দলটি। অতীত আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, চূড়ান্ত সফলতার জন্য ঢাকায় আন্দোলন করতে হবে।
বিএনপির ‘একদফা দাবিতে ঢাকাসহ দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলছে। সরকার দাবি না মানলে আন্দোলন ক্রমেই বেগবান হবে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, চূড়ান্ত পর্যায়ে ঢাকা ঘিরেই নেওয়া হবে সব কর্মসূচি। সেই লক্ষ্যেই ইতোমধ্যে ঘোষিত ১৫ দিনের কর্মসূচিতে ঢাকা ও ঢাকার উপকণ্ঠে রাখা হয়েছে ১২টি সমাবেশ। এসব সমাবেশের মধ্য দিয়ে ঢাকাকেন্দ্রিক চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনের প্রস্তুতি ও জনসংযোগ সেরে নিতে চাইছে দলটির হাইকমান্ড। এর আগে ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচির ‘ব্যর্থতা’ মূল্যায়ন করে আগামীতে কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে কোনো সমন্বয়হীনতা থাকলে এর মধ্য দিয়ে সেটিও কাটিয়ে উঠতে চান। চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে আর কোনো ধরনের ভুল করতে চায় না বিএনপি।
দলটির নেতারা বলছেন, এ আন্দোলনে কোনোভাবেই পরাজিত হতে চান না তারা। আন্দোলন সফল না হলে আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরতে থাকা নেতাকর্মীদের চূড়ান্ত ঠিকানা হবে জেলখানা। কারণ ‘মিথ্যা’ মামলায় তখন অনেকের সাজা হয়ে যেতে পারে।
বিএনপিপন্থি বিশ্লেষকদের মতে, দলটি পরিকল্পনামাফিক কর্মসূচি দিয়ে একদফার আন্দোলন এগিয়ে নিচ্ছে। সর্বশেষ ঘোষিত ১৫ দিনের কর্মসূচিতে ঢাকা ও ঢাকার উপকণ্ঠে একাধিক সমাবেশ রাখা হয়েছে। দলটির চূড়ান্ত আন্দোলনের লক্ষ্য রাজধানী ঢাকা, সেটা এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে। আবার এই বিষয়টি থেকে সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টি ঘোরাতে ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায়েও পাঁচটি রোডমার্চের কর্মসূচি রাখা হয়েছে।
দশ দফা দাবির ভিত্তিতে গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এই আন্দোলনে প্রায় অর্ধশত দল সম্পৃক্ত হয়েছে। দাবি আদায়ে প্রায় এক বছর ধরে ঢাকা ও তৃণমূলে ঘুরে-ফিরে নানা কর্মসূচি পালন করেছে তারা। এরপর ১২ জুলাই থেকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে একদফার আন্দোলন শুরু করে বিএনপি ও এর শরিকরা। ঢাকায় মহাসমাবেশ, রাজধানীর চার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি এবং একাধিকবার পদযাত্রাসহ গণমিছিল করেছে তারা।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এই সরকারের পতন ঘটবে। সে লক্ষ্যে আমরা আমাদের সাংগঠনিক পরিকল্পনা মতো কাজ করছি।’
একদফার চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম ধাপে এবার ১৫ দিনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। গত মঙ্গলবার ঢাকার জিনজিরা এবং গাজীপুরের টঙ্গীতে সমাবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এই ধাপের আন্দোলন। আগামীকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগরের যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় পরবর্তী সমাবেশ হবে। ২৫ সেপ্টেম্বর সমাবেশের কর্মসূচি পালিত হবে ঢাকা মহানগরের নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে। এরপর ঢাকায় পেশাজীবী কনভেনশন হবে ২৬ সেপ্টেম্বর। ঢাকা মহানগরের গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় ২৭ সেপ্টেম্বর হবে জনসমাবেশ। ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় হবে মহিলা সমাবেশ। এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে শ্রমজীবী কনভেনশন। আর ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশের মধ্য দিয়ে ঢাকায় আন্দোলনের এই ধাপ সমাপ্ত হবে। এ ছাড়া প্রথম ধাপের এই চূড়ান্ত আন্দোলনে সিলেট, বরিশাল, খুলনা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাঁচটি রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে। সর্বোচ্চ লোকসমাগম ঘটিয়ে প্রতিটি কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি।
এদিকে ঢাকায় বিএনপির জোন ভিত্তিক সমাবেশ সফল করতে দফায় দফায় প্রস্তুতি সভা করছে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি। এ ছাড়া পেশাজীবী ও শ্রমজীবী কনভেনশন এবং মহিলা ও কৃষক সমাবেশ সফল করতেও ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে সংগঠনগুলো। গঠন করা হয়েছে একাধিক কমিটি। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দফায় দফায় প্রস্তুতি সভা করছেন। কেন্দ্রের পাশাপাশি বিভাগভিত্তিক প্রস্তুতি সভাও চলছে। এসব কর্মসূচিতে সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীদের ঢাকায় আনার লক্ষ্য তাদের।
বিএনপি মনে করছে, সরকার এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দাবি মেনে নেবে। তা না হলে এরপর আরও বৃহত্তর কর্মসূচি দেবেন তারা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলনের প্রথম ধাপ শেষে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই আবার টানা কর্মসূচি আসবে; যেটা হবে একদফা আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপ। তখনো ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও কর্মসূচি থাকতে পারে। তবে সেই সময় কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য হবে ঢাকা। তখন কর্মসূচি শুধু শুক্র ও শনিবারে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে। দাবি আদায়ে ঢাকায় তখন নির্বাচন কমিশন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঘেরাওসহ টানা অবস্থান কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। পাশাপাশি রাজপথ, রেলপথ, নৌপথ অবরোধের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে। এসব কর্মসূচি ঘিরে সরকার ও প্রশাসন মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে সর্বশেষ কর্মসূচি হিসেবে হরতালও দিতে পারে বিএনপি। তবে বাধ্য না হলে হরতালের মতো কর্মসূচিতে যেতে চায় না দলটি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই এ আন্দোলনের মাধ্যমে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে চায় বিএনপি।
বিএনপির অনেক নেতার দাবি, রাজধানী ঢাকায় ব্যর্থতার কারণেই ২০১৪ সালে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি। সেই সময় তৃণমূলে জোরদার আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় তা বেগবান করা সম্ভব হয়নি। এ কারণেই ওই আন্দোলন সফল হয়নি। অতীতের সেই অভিজ্ঞতা থেকে এবার একদফার চূড়ান্ত আন্দোলনে ঢাকাকে প্রাধান্য দিচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। সেই লক্ষ্যে চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য ঢাকা মহানগরকে ইতোমধ্যে সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। ঢাকায় প্রতিটি কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ঘটিয়ে সাংগঠনিক শক্তির প্রমাণও দিয়েছে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি। যদিও নেতাকর্মীরা ব্যাপক হারে না নামায় গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি ‘ব্যর্থ’ হয়। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে কিছু সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় হাইকমান্ড। ছাত্রদল সভাপতিকে অব্যাহতিসহ ভেঙে দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর যুবদলের কমিটি। দায়িত্বে অবহেলার কারণে আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত থাকলেও পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে নামার অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে হাইকমান্ড।
তবে সম্প্রতি ঢাকায় সক্রিয় বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার ও সাজার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনে এক ধরনের নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দিয়েছে বলে দলের অনেকে মনে করেন। তাদের অভিমত, এর ফলে ঢাকায় সংগঠনও দুর্বল হয়ে পড়েছে। কারণ ওই নেতাদের ‘আন্দোলন সক্ষমতা’ ইতোমধ্যে দলের কাছে পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। তাই চূড়ান্ত আন্দোলনের ‘শেষ ধাপ’ শুরুর আগে এই বিষয়টি দারুণ ভাবাচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ডকে। বিশেষ করে মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান এবং দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু ও ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনের অনুপস্থিতি নিয়ে চিন্তিত তারা। দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় আমান গত ১০ সেপ্টেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। গত ২০ আগস্ট ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া গত কয়েক মাসে যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্না, বিএনপির বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা-৪ আসনের সাবেক এমপি সালাহ উদ্দিন আহমেদ, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শেখ রবিউল আলম রবি, যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর, আলী আকবর চুন্নু, ইউসুফ বিন জলিল (কালু), বর্তমান যুগ্ম সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহীন, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান মুসাব্বিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘প্রত্যেক নেতারই যোগ্য রিপ্লেসমেন্ট রয়েছে। দলে নেতার কোনো ক্রাইসিস নেই।’
এদিকে আমান কারাগারে যাওয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারকে মহানগর উত্তর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়েছে। আর রবিনের স্থলে মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক লিটন মাহমুদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলন সামনে রেখে তাদের দায়িত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে মহানগরে নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ হবে বলে প্রত্যাশা দল ও নেতাকর্মীদের।
এদিকে একদফার চূড়ান্ত আন্দোলন সামনে রেখে বিএনপির যুগপতের শরিকরাও সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের দাবি, আন্দোলনেই সরকারের পতন ঘটবে।
এম আই/