রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ ।। ৫ মাঘ ১৪৩১ ।। ১৯ রজব ১৪৪৬


বদনজর ও জাদু থেকে রক্ষায় করণীয় : শায়খ ড. আবদুর রহমান আস সুদাইস

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| শায়খ ড. আবদুর রহমান আস সুদাইস || 

(১৭-০৭-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ১৭-০১-২০২৫ ঈসায়ি তারিখে বায়তুল্লাহ শরিফে প্রদত্ত জুমার খুতবা)

আজকের পৃথিবীতে সংকট, চ্যালেঞ্জ, বিভ্রান্তি ও অভিযোগের ঢেউ উঠছে। ছোটরা বড় হতে চায়, আর বয়স্করা ছোট হওয়ার কামনা করে। বেকার কাজের আশায় বসে থাকে, আর কর্মজীবীরা ক্লান্ত-শ্রান্ত। পুঁজিপতিদের শান্তি নেই, আবার দরিদ্ররাও কষ্টে আছে। সমাজে জাদু, শয়তানি কৌশল, হিংসা ও মানসিক অসুস্থতা ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্বেগ, অস্থিরতা, হতাশা ও মানসিক চাপ সাধারণ হয়ে উঠেছে। এসব বিষয় মানুষের জীবনে দুঃখ, রোগব্যাধি ও সম্পদের অভাবের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাও বটে।

এই পরীক্ষাগুলো কারো জন্য পাপের কাফফারা, আবার কারো জন্য পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সোপান। মুমিনের জন্য সবকিছুই কল্যাণকর। যদি বিপদ আসে, ধৈর্য ধরতে হয়। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, 'তোমরা যা অপছন্দ কর সম্ভবত তা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর আর যা ভালবাস সম্ভবত তা তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না।' (সূরা বাকারা, আয়াত: ২১৬)

বর্তমান সময়ে মানুষের জন্য আত্মরক্ষা ও সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতা সমাজে গভীরভাবে প্রবেশ করেছে। জ্বিন, জাদু, হিংসা ও মানসিক রোগ থেকে বাঁচতে, কুরআন ও সুন্নাহ হলো সর্বোত্তম প্রতিষেধক। কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে পরিপূর্ণ শিফা। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'তোমাদের মন্ত্রগুলো আমাকে দেখাও। তাতে কোনো ক্ষতি নেই, যদি তাতে শিরক না থাকে।' (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫৬২৫)

অনেক রোগী এমন ছিল যারা মৃত্যুর প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। বড় হাসপাতাল বা দক্ষ ডাক্তাররাও তাদের আরোগ্য দিতে পারেনি। কিন্তু তারা কুরআনের ঝাঁড়ফুক গ্রহণ করে আরোগ্য লাভ করেছে। ইমাম ইবনে কাইয়্যিম রহ. বলেন, 'কুরআন হলো এমন পূর্ণাঙ্গ শেফা যা হৃদয় ও দেহের সব রোগের জন্য কার্যকর। যদি রোগী সঠিকভাবে তা গ্রহণ করে, তবে দুনিয়ার কোনো রোগ আল্লাহর কালামের সামনে টিকতে পারবে না। এমনকি যদি তা পাহাড়ের ওপর অবতীর্ণ হতো, তবে পাহাড় ধ্বংস হয়ে যেত।' আল্লাহু আকবার! এটি মজবুত বিশ্বাস ও দৃঢ় আস্থার প্রমাণ। কবি বলেন, 'ঝাড়ফুঁক যদি জ্বর বা নজর লাগা থেকে মুক্তির জন্য হয় এবং যদি তা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে চয়ন করা হয়, তাহলে এটি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথনির্দেশ ও শরীয়তের অংশ। এ বিষয়ে সুন্নাহর মান্যতার কোনো দ্বিমত নেই।'

প্রিয় মুসলিম জাতি! আপনাদের নিজেদের, সন্তানদের ও ঘরবাড়ি রক্ষা করার জন্য শরীয়তসম্মত আমল, সকাল-সন্ধ্যার দোয়া, ঘরে-বাইরে যাওয়ার দোয়া, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম ও জাগৃতির দোয়া পড়ুন। এগুলো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শেখানো দোয়া, যা আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের রক্ষাকবচ।

অবশ্য দোয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও তাঁর উপর পরিপূর্ণ ভরসা রাখতে হবে। কারণ, আল্লাহর উপর বিশ্বাস সর্বশ্রেষ্ঠ সমাধান। মহান আল্লাহ বলেন, 'আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্যে যথেষ্ট নন? অথচ তারা তোমাকে আল্লাহর পরিবর্তে অপরের ভয় দেখায়। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্যে কোন পথপ্রদর্শক নেই।' (সূরা যুমার: ৩৬) জনৈক কবির ভাষায় ঈমানদার ব্যক্তির বিশ্বাস ও অনুভূতি উঠে এসেছে: 'আমি আমার রবের উপর ভরসা করেছি ও তাঁর হাতে আমার সব কিছু সোপর্দ করেছি। তিনি আমার জন্য যথেষ্ট সহায়। তাই সময়ের বিপদে মন খারাপ করো না, কারণ আল্লাহর প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাসই আমাকে রক্ষা করে।' হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, 'মহানবী‎ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ও হুসাইন রা.-এর জন্য নিম্নোক্ত দুআ পড়ে পানাহ চাইতেন ও বলতেন, তোমাদের পিতা ইবরাহিম আ. ইসমাঈল ও ইসহাক আ.-এর জন্য দোয়া পড়ে পানাহ চাইতেন যে,

أَعُوذُ  بِكَلِمَاتِ  اللَّهِ  التَّامَّةِ  مِنْ  كُلِّ  شَيْطَانٍ  وَهَامَّةٍ،  وَمِنْ  كُلِّ  عَيْنٍ  لاَمَّةٍ

অর্থাৎ, 'আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালিমার দ্বারা প্রত্যেক শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী ও প্রত্যেক কুদৃষ্টির অনিষ্ট হতে পানাহ চাচ্ছি।' (সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৩৭১) অন্য আরেকটি হাদীসে এসেছে, হযরত উমামা রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'সুরা বাকারা পড়ো। এটি গ্রহণ করা বরকতময়, আর ছেড়ে দেওয়া আফসোসের কারণ। জাদুকররা এর মোকাবিলা করতে পারে না।' (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৫৯) হযরত আবু হুরাইরা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবর বানিয়ো না। যে ঘরে সুরা বাকারা তিলাওয়াত করা হয়, শয়তান সেই ঘর থেকে পালিয়ে যায়।' (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭০৯)

বিশেষ করে আয়াতুল কুরসি, সুরা বাকারার শেষের আয়াতসমূহ, সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়া অত্যন্ত কার্যকর। এগুলো নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথনির্দেশনা, যা সমস্ত ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট।

অনেক মুসলমান নিজেদের, সন্তানদের ও ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য আত্মরক্ষামূলক দোয়া পড়া ও আমল করা থেকে উদাসীন থাকে। তাদের ঈমান ও বিশ্বাসের দুর্বলতার সুযোগে শয়তান তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে আক্রমণ করে, কেউ বদনজর বা হিংসার শিকার হয়। এই অবস্থায় অনেকেই ছুটে যায় জাদুকর, তান্ত্রিক, ভণ্ডপীর বা অন্ধ বিশ্বাসের দিকে। এদের কেউ দোয়া-দরুদ ও কুরআনের নামে অজানা লেখাজোখা বা অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে প্রতারিত করে, আবার কেউ কথার জাদু দেখিয়ে ভুল বোঝায়। কেউ চিহ্নিত করে দেয় যে রোগের কারণ বদনজর, আর নজরদাতা হলো আপনজন। কেউ আবার কঠোর পিটুনি বা শারীরিক নির্যাতনের পদ্ধতি গ্রহণ করে। এই ভণ্ডদের বেশিরভাগই নিজেদের ধার্মিক ও প্রজ্ঞাবান হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু এরা আসলে ধূর্ত প্রতারক, যারা মানুষের সম্পদ কৌশলে আত্মসাৎ করে। তারা মিথ্যে প্রতিশ্রুতি ও কল্পনার আশ্বাস দিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে। আধুনিক যুগে এসব প্রতারণা আরও বিস্তৃত হয়েছে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি মোবাইল অ্যাপসেও এই ভ্রান্ত ধারণাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে।

সম্মানিত মুমিনগণ! আত্মরক্ষার জন্য আপনাকে এই ভণ্ডদের আশ্রয় নিতে হবে না। বরং এটি সহজ ও সঠিকভাবে করা যায়। আপনি নিজে, আপনার পরিবার ও ঘরের সদস্যদের সুরক্ষার জন্য শরীয়তের দোয়া ও আমল করুন। এটি কেবল আপনাকে সুরক্ষিত করবে না, বরং আপনার পরিবার, সমাজ ও গোটা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যও কল্যাণ বয়ে আনবে। আল্লাহর প্রতি দৃঢ় আস্থা ও ভরসা রাখুন। প্রতিটি সংকটের পর সহজতা আসে। কবি বলেছেন, 'হে চিন্তিত ব্যক্তি, চিন্তা দূর হবে। শুভ বার্তা গ্রহণ কর, কারণ মুক্তি দাতা আল্লাহ। আল্লাহ প্রতিটি কঠিন পরিস্থিতির পর সহজতা নিয়ে আসেন। তাই হতাশ হবেন না, কারণ আল্লাহই আপনার অভিভাবক। যদি বিপদে পড়েন, তবে আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন ও সন্তুষ্ট থাকুন। যিনি বিপদ দূর করেন, তিনি আল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া আপনার আর কেউ নেই। তাঁর প্রতি ভরসা রাখুন, কারণ তিনিই যথেষ্ট।'

সমাজে যে চ্যালেঞ্জ ও সংকট এসেছে, তা কারও অজানা নয়। ফিতনা ও পরীক্ষার ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে, পরিবার ও সমাজে অশান্তি বেড়েছে। এই কঠিন সময়ে আমাদের মূল দায়িত্ব হলো নতুন প্রজন্ম ও যুবকদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মানসিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে সুরক্ষিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দায়িত্ব আলেম, দায়ি, পিতা-মাতা, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও গণমাধ্যমকর্মীদের। যুবসমাজকে সঠিকভাবে পথ দেখানো, বিভ্রান্তিকর ফতোয়া ও ভ্রান্ত চিন্তা থেকে সতর্ক করা ও শয়তানের প্ররোচনা থেকে বাঁচতে সচেতন করতে হবে।

আজকের সমাজে শারীরিক ও মানসিক চাহিদা ও বিভ্রান্তিকর ধারণা মানুষকে বিপথগামী করে তুলেছে। এই ফিতনা শুধু ব্যক্তিকে নয়, পুরো পরিবার ও সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শত্রুরা আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়। তাদের পরিকল্পনা বুঝতে হবে ও তা প্রতিহত করতে হবে।

মহান আল্লাহ আমাদের যুবসমাজ, সমাজ ও দেশকে সকল অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন। আমাদের ঈমান, নিরাপত্তা ও শান্তি অক্ষুণ্ন রাখুন।

অনুবাদ: আবদুল কাইয়ুম শেখ
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, পোস্তা, চকবাজার, ঢাকা-১২১১।

হাআমা/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ