|| সুহাইল আবদুল কাইয়ূম ||
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রতিটি বস্তু সৃষ্টি করে তাতে এমন জিনিস দান করেছেন, যা তার অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেই সাথে নির্দেশ দিয়েছেন সামঞ্জস্যপূর্ণ কল্যাণটি যথানিয়মে গ্রহণ করার। সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে অর্জন হবে না সেই কল্যাণ। আল্লাহ তাআলা দিনরাত সৃষ্টি করে মানুষকে তাঁর মানশা জানিয়ে দিয়েছেন। রাতকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে মানুষ তাতে ঘুমিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি ও শ্রান্তি দূর করে মস্তিষ্ক ঠান্ডা ও শান্ত করে। আর দিনকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে মানুষ তাতে সজাগ থেকে দুনিয়া ও আখিরাতের কাজে কর্মময় ব্যস্ত সময় পার করে। স্রষ্টার মাশ অনুযায়ী চলার মধ্যেই বান্দার কল্যাণ ও মঙ্গল নিহিত রয়েছে।
আলّাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- ‘আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য রাত সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাতে প্রশান্তি লাভ করতে পারো এবং দিনকে করেছেন আলোকময়। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি বড়ই অনুগ্রহশীল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।’ -সূরাতুল মুমিন : ৬১।
তিনি আরো বলেছেন- তিনিই তোমাদের জন্য রাতকে করেছেন আবরণ ও নিদ্রাকে করেছেন আরামপ্রদ এবং দিনকে করেছেন জাগ্রত থাকার সময়। -সুরা ফুরকান : ৪৭।
এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সা. ইশার পর না ঘুমিয়ে আলাপচারিতায় লিপ্ত হওয়াকে খুব অপছন্দ করতেন। -বুখারী : হাদীস নং- ৫৩৭।
সে জন্যেই আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা. ও এই বিষয়ে খুবই গুরুত্ব আরোপ করতেন। যাতে মানুষ অধিক রাত সজাগ থেকে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য তিনি ইশার পর কাউকে অযথা আলাপচারিতায় লিপ্ত দেখলে তাকে প্রহার করতেন, আর বলতেন- হে রাতের প্রথমাংশে গল্পগুজবে পাগলপারা আর শেষ রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে দিশেহারার দল! তোমাদের আমলের হিসাবরক্ষক ফিরেশতাদেরকে আরাম করার সুযোগ দাও।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. সম্পর্কে বর্ণিত আছে, যারা ইশার পর না ঘুমিয়ে অনর্থক কথা বা কাজে লিপ্ত হয়, তাদের ব্যাপারে তিনি কঠিন বাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি কবিতা রচনাকারীদের সম্পর্কে বলেছেন, যে ব্যক্তি ইশার পর কবিতার একটি চরণও রচনা করবে, সকাল পর্যন্ত তার কোনো নামায কবুল হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইশার নামায পড়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে, সে যেনো তার গুনাহের ক্ষমা পেয়ে প্রশান্তমনে নিদ্রা গেলো।
তবে কেউ যদি কোন ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকে কিংবা ইলমে দীন অর্জনের জন্য সজাগ থাকে অথবা নিজ স্ত্রীর সাথে আনন্দফূর্তি করে বা মেহমানের সাথে কথাবার্তা বলে ও তাঁর খোঁজ-খবর নেয় তাতে কোন সমস্যা নেই। বরং এতে সাওয়াব রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, তা যেনো প্রতি-দিনের অভ্যাসে পরিণত না হয়। বরং সকলের সব আয়োজন ও প্রয়োজন দিনেই সেরে নেওয়া উচিত। যেনো রাতে যথাসময়ে নিদ্রা গ্রহণ করে শেষ রাতের বরকতময় সময়ে আল্লাহ পাকের ইবাদত করা যায়। তাহলেই সৌভাগ্য ও কামিয়াবি আমাদের পদচুম্বন করবে ইনশাআল্লাহ।
রাতে ঘুমের উপকারিতা-
রাতে ঘুমের উপকারিতা অপরিসীম। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যারা রাতে আগে আগে ঘুমিয়ে যায় তারা থাকে পূর্ণ সুস্থ। তাদের গোটা দেহে বিরাজ করে শান্তি। মস্তিষ্ক থাকে ঠাণ্ডা। তাদের শিরা-উপশিরা থাকে সচল। তাদের কিডনী, হৃদপিণ্ড ও ফুসফুস থাকে সুস্থ। সর্বোপুরি তাদের শারীরিক, আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তি থাকে। শারীরিকভাবে সুস্থ ও সকল রোগব্যধি থেকে মুক্ত থাকতে রাতের ঘুমের বিকল্প নেই। এতে আল্লাহ তাআলার রয়েছে কুদরত ও রহস্য, যা তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। পুরো বিশ্ব চরাচরকে করে দিয়েছেন মানব জাতির অনুকূল ও অনুগামী। মানুষ যখন ঘুমায়, পুরো জগত তখন ঘুমায়। ইঁদুর ও বাদুর ছাড়া প্রায় সব প্রাণীই রাত আগমনের সাথে সাথে নিজেদের ব্যস্ততা থেকে অবসর হয়ে আপন ঘরে ও নীড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। কীট-পতঙ্গ, পশুপাখী, সরীসৃপ ইত্যাদি এমনকি মাছও সাঁতার কাটা বন্ধ করে দেয়। বড় বড় উদ্ভিদের লতা-পাতাগুলোও মনে হয় ঘুমিয়ে যায়। অতঃপর যখন দিন হয় তখন পুনরায় সবাই জীবিকার অন্বেষণ ও কর্মব্যস্ততায় মগ্ন হয়। এসব আল্লাহর অগাধ প্রজ্ঞারই প্রমাণ বহন করে।
ইশার পর অবিলম্বে শুয়ে গেলে তাহাজ্জুদ পড়া সহজ হয়। তাহাজ্জুদের মাধ্যমে একজন গুনাহগার বান্দা তার মাওলার সাথে বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক জুড়া লাগাতে পারে। যাদের পূর্ব থেকে মাওলানার সাথে সম্পর্ক আছে, তাঁরা এর মাধ্যমে তাঁদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে পারে। এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই অপরিসীম গুরুত্ব ও ফযীলত অনুধাবন করেই রাসূলুল্লাহ সা. এতো বেশী পরিমাণ তাহাজ্জুদ পড়তেন যে, তাঁর পা মুবারক ফুলে যেতো। তিনি নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও নামাযে এতো বেশী কান্না করতেন যে, তাঁর বুক ভিজে যেতো। রাসূলে কারীম সা. এর অনুসরণ করে হযরত সাহাবায়ে কিরাম ও বুযুর্গানে দীনও ইবাদত-বন্দেগী ও কান্নাকাটিতে সারা রাত কাটিয়ে দিতেন। অথচ তাকওয়া ও পরহেযগারী, সততা ও দীনদারী শতভাগ উপস্থিত ছিলো তাদের মাঝে।
আর আমরা গুনাহের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত গুনাহে ভরপুর। এমন কোনো গুনাহ নেই, যা আমরা করি না। তবুও কৃত গুনাহের কথা স্মরণ করে আলّাহর কাছে রোনাজারি করি না। শেষরাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ি না। ফেসবুক, ইন্টারনেট, ইউটিউব দেখে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিচ্ছি। গভীর রাত পর্যন্ত বন্ধুর সাথে চ্যাট করে অতিবাহিত করছি। অশ্লীল ও পরনারীর ছবি দেখে রাত পার করছি। এটা যে মারাত্মক গুনাহ, এই অনুভুতিটুকুও আমাদের মধ্যে জাগ্রত হচ্ছে না।
ধিক, শত ধিক! আমাদের নফসের প্রতি। কেনো তাতে পরকালের চিন্তা উদ্রেগ হয় না। আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ভয় তাতে জন্ম নেয় না। এখনো সময় আছে, আসুন, দীর্ঘরাত পর্যন্ত রাতজাগা পরিহার করি। আগে আগে ঘুমিয়ে যাই। সকাল সকাল উঠি। নিজেদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করি।
শরীআতের দৃষ্টিতে রাতজাগার ক্ষতি-
যারা রাতে দেরিতে ঘুমায় তাদের অনেকের ফজরের জামাআত ছুটে যায়। অনেকের তো স্বয়ং নামাযই কাযা হয়ে যায়। ইমাম মালিক রহ. তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন, একবার উমর রা. সুলাইমান ইবনে আবু হাসমাকে ফজরের জামাআতে না পেয়ে তার মা ‘হযরত শিফা রা.’ এর নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? সুলাইমানকে আজ ফজরের নামাযে দেখলাম না। উত্তরে মা বললেন, সুলাইমান আজ সারা রাত নফল নামায পড়ার কারণে তার চোখে ঘুমের প্রচণ্ড চাপ ছিলো। ফলে ফজরের নামায জামাতে পড়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। উমর রা.-এর নিকট ব্যাপারটি খুবই দুঃখজনক মনে হলো। কারণ সারারাত নফল ইবাদত না করে ফজরের নামায জামাআতে পড়া তাঁর নিকট অধিক উত্তম। -মুআত্তা মালিক : ১/১৩১।
আমাদের একটু ভেবে দেখা দরকার, আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা. ফজরের জামাতে অনুপস্থিত থাকার ব্যাপারে সেই ব্যক্তির সারা রাত নামাযে কাটানোকেই উযর হিসাবে গ্রহণ করেননি। তাহলে সেই ব্যক্তির ওযর কি গ্রহণ হবে, যার সারা রাত ফেইসবুক, ইন্টারনেট ও বেহুদা কাজে ব্যয় করে, যেখানে দীন-দুনিয়ার কোনো কল্যাণ নেই।
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন-
যে ব্যক্তি ফজরের নামায যথাসময়ে আদায় করে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর যিকির-আযকার করবে তার জন্য জান্নাত অবধারিত। -মুসনাদে আবী ইয়ালা আলমুসিলী : হাদীস নং-১৪৮৭।
এত বড় ফযীলতের কথা শুনেও যদি আমরা দূর্ভাগ্যবশত ঘুমাতে ঘুমাতে ফজরের নামায ছেড়ে দেই, তাহলে এই অলসতা ও উদাসিনতার দরুণ যেকোনো সময় আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আমাদের উপর কঠিন শাস্তি নেমে আসতে পারে। বিশেষ করে যখন তা কারো বদ অভ্যাসে পরিণত হবে। ইমাম বুখারী (রহ.) সহীহ বুখারীতে একটি সুদীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর স্বপ্নে দেখা একটি ভয়ানক ঘটনার বিবরণ রয়েছে। আর নবীগণের স্বপ্নও যে ওহী তা আমাদের সকলেরই জানা। উক্ত হাদীসটিতে আছে-
‘রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি এবং দুইজন ফিরেশতা একজন শায়িত ব্যক্তির নিকট গেলাম। তার পাশে একজন ব্যক্তি হাতে পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি শায়িত ব্যক্তির মাথায় সজোরে পাথর নিক্ষেপ করছেন। ফলে তার মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং পাথরটি গড়িয়ে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে, ঐ ব্যক্তি গিয়ে পাথরটি তুলে আনছে, তার নিকট ফিরে আসার পূর্বেই মাথা পূর্বের ন্যায় সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। পুনরায় পাথর নিক্ষেপ করছে। ফলে এমন পরিণতি হচ্ছে, যেমন পরিণতি প্রথমবার হয়েছিলো।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি ফেরেশতাদ্বয়কে জিজ্ঞাসা করলাম, সুবহানাল্লাহ! এই দুই ব্যক্তি কে? তাঁরা উত্তরে আমাকে বললেন, প্রথম যার নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, যার মাথা পাথরের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছিলো সে কুরআন শরীফ শিক্ষা করে ছেড়ে দিয়েছে (তিলাওয়াতও করতো না, আমলও করতো না)। আর ফজরের নামায না পড়ে ঘুমিয়ে থাকতো। -সহীহ বুখারী : হাদীস নং-৭০৪৭।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রাতজাগার ক্ষতি-
রাতজাগা যখন আমাদের বদঅভ্যাসে পরিণত হয়েছে তখন এর ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা সময়ের অপরিহার্য দাবী হয়ে পড়েছে। কেননা, রাত জাগলে দেহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাপক ধ্বস নামে। অপূরণীয় ক্ষতি হয় দেহের। যুক্তরাজ্যের গবেষকরা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমন তথ্যই দিয়েছেন। গবেষকরা জানিয়েছেন, মানুষের শরীরে একটি দেহঘড়ি রয়েছে, যার ছন্দ হচ্ছে রাতে ঘুম আর দিনে কাজ। রাতজাগার অভ্যাস শুধু একটি সমস্যা নয়, অসংখ্য সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু। এসব সমস্যা ও ক্ষতির একটি তালিকা সংক্ষিপ্তভাবে নিচে পেশ করা হলো-
১. মানসিক রোগ দেখা দেয়। ২. স্মৃতিশক্তি কমে যায়। ৩. সতর্ক থাকার ক্ষমতা কমে যায়। ৪. সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে। ৫. মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ৬. ভুল স্মৃতি তৈরী হয়। ৭. আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ৮. হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। ৯. ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ১০. ওজন বেড়ে যায়। ১১. দেহের বৃদ্ধি কমে যেতে পারে। ১২. স্তন ও ডিম্বাশয়ে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ১৩. পেটের নানাবিধ সমস্যা তৈরী হতে পারে। ১৪. ঋতুস্রাব অনিয়মিত হওয়া ও বন্ধ্যা হয়ে যাওয়াসহ মহিলাদের অসংখ্য সমস্যা হতে পারে। ১৫. যৌনাকাঙ্ক্ষা কমে যেতে পারে। ১৬. শরীরে ব্যথা ও ম্যাজম্যাজ ভাব তৈরী করে। ১৭. শরীরে ক্লান্তিবোধ তৈরী করে। ১৮. বদহজম হতে পারে। ১৯. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। ২০. রক্তে প্রদাহ বৃদ্ধি পায়। ২১. মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায়। ২২. মাথা ব্যথা সৃষ্টি করে। ২৩. ত্বকের ক্ষতি সাধন করে। ২৪. চোখের চারপাশে কালো দাগ হতে পারে। ২৫. চোখের পাতায় তেলেঙ্গা হতে পারে। ২৬. দেহের ছন্দ রক্ষাকারী জিন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ২৭. নৈতিকতার বিচারবোধ কমে যায়। ২৮. পেশীর ক্ষয় রোগ দেখা দেয়।
অতএব আসুন! আমরা আল্লাহ তাআলার মানশা অনুযায়ী রাতে ঘুমিয়ে দিনকে কর্মমুখর করে তুলি। আল্লাহ পাক আমাদের সহায় হোন। আমীন।
লেখক: শিক্ষাসচিব ও নায়েবে মুফতী, জামিআ ইসলামিয়া ঢাকা কাজলা ব্রীজ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা
কেএল/