ভাইয়া, সালাফি আকিদার বেশ কিছু লোক প্রচার করছে। বে নামাজি কাফের , নামাজ ছেড়ে দিলে কাফের তাহলে কি ১৫০ কোটি মুসলিমের মধ্যে যারা নামাজ পড়ে না ; তারা কাফের হয়ে যাবে ? আজ পড়ে না হয়ত কাল পড়বে ।কিন্তু তারা কি করে কাফের বলছে ? ইবনে বায সাহেব নাকি ফতোয়া দিয়েছে ।
তাদের হাদিস গুলো – ঈমান ও কুফরের পার্থক্য হচ্ছে নামাজ ( মুসলিম ) – তাই বেনামাজি কাফের ?
২য় – যে নামাজ ছেড়ে দিল সে কুফরি করলো !! এই সম্পর্কে একটু গবেষণা মূলক বিস্তারিত ফেলে খুবি খুশি হবো ভাইয়া ।
উত্তর : ইসলামী শরীয়তের মাসায়েল সম্পর্কে তাহকীক করে বিধান বলার অধিকার আল্লাহ তাআলা সবাইকে দেননি। দিয়েছেন। দুই ব্যক্তিকে। একজন হলেন নবীজী সাঃ। তিনি না থাকা অবস্থায় মুজতাহিদকে।
এ দায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পরিস্কার ইরশাদ করেছেন- আর যখন তাদের কছে পৌঁছে কোন সংবাদ শান্তি-সংক্রান্ত কিংবা ভয়ের, তখন তারা সেগুলোকে রটিয়ে দেয়। আর যদি সেগুলো পৌঁছে দিত রসূল পর্যন্ত কিংবা তাদের জ্ঞানী[ শরীয়ত বিশেষজ্ঞ মুজতাহিদ] পর্যন্ত,তখন তাদের মাঝে যাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা রয়েছে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখতেন। বস্তুতঃ আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা যদি তোমাদের উপর বিদ্যমান না থাকত তবে তোমাদের অল্প কতিপয় লোক ব্যতীত সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে শুরু করত! [সূরা নিসা-৮৩]
আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে একটি দু’টি হাদীস দেখেই পন্ডিতি করতে শুরু করে দেই। এ বিষয়ক হাদীসের পূর্ণ ভান্ডার তালাশ করে দেখি না। গায়রে মুকাল্লিদ মতবাদ ভ্রান্ত হবার মূল কারণও এটা। এক দু’টি হাদীস দেখেই লাফাতে শুরু করে দেয়। এ বিষয়ক হাদীসের ভান্ডার তালাশ করে দেখে না। দেখে না রাসূল সাঃ এর উক্ত ইরশাদ দিয়ে উদ্দেশ্য কি? মূলত এসব কম ইলম এবং গবেষণার অপরিপক্কতার কারণেই এসব লোক সমাজে হাদীসের নামে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে থাকে। এ বিষয়টি বুঝতে হলে প্রথমে আমরা পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত ও তারপর কয়েকটি হাদীস দেখে নেই- নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না,যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া যাকে ইচ্ছা,ক্ষমা করেন। যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়। [সূরা নিসা-১১৬]
* হযরত সালামা বিন নুআইম রাঃ বলেন, রাসূল সাঃ এর একদল সাহাবা রাঃ বলেন, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় মিলিত হয় [মৃত্যুবরণ করে] যে সে শিরক করেনি, তাহলে সে ব্যক্তি জান্নাতী হবে। যদিও সে যিনা এবং চুরি করে থাকে। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৮২৮৪, ২১৪৩৪, বুখারী, হাদীস নং-১২৩৭]
* হযরত আবু জর গিফারী রাঃ থেকে একটি দীর্ঘ হাদীসে এসেছে। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি বলে আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তারপর সে উক্ত হালাতে ইন্তেকাল করে তাহলে সে জান্নাতী হবে। আমি বললাম, যদি সে যিনা করে এবং চুরি করে তাহলেও? রাসূল সাঃ ইরশাদ করলেন, যদিও সে যিনা করে বা চুরি করে। আমি আবার বললাম- যদি সে যিনা করে এবং চুরি করে তাহলেও? রাসূল সাঃ ইরশাদ করলেন, যদিও সে যিনা করে বা চুরি করে। এভাবে তিনবার বললাম, তখন চতুর্থবারের সময় রাসূল সাঃ বললেন, যদিও আবু জরের নাক কুঞ্চিত হয় তবু। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২১৪৬৬]
* হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, কোন যিনাকারী যিনা করার সময় মুসলমান থাকে না, কোন মদ পানকারী মদ পান করার সময় মুসলমান থাকে না, কোন চুরিকারী ব্যক্তি চুরি করার সময় মুসলমান থাকে না। [বুখারী, হাদীস নং-২৪৭৫, ২৩৪৩]
* অনুবাদ- হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যে গোলাম মনীবের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করে তাহলে সে জিনাকারী। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২০৭৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৪২১২, সুনানে দারামী, হাদীস নং-২২৭৯, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-১১১১, তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-২৭০৫} এবার দেখুন নামায তরককারী সম্পর্কে হাদীস-
* হযরত আবু বুরাইদা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূ সাঃ ইরশাদ করেছেন, আমাদের ও [মুনাফিকদের মাঝে] অঙ্গিকার রয়েছে তাহল নামায। সুতরাং যে নামায ছেড়ে দিল সে কাফের হয়ে গেল। [ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১০৭৯]
* সারকথা উপরোক্ত আয়াতে কারীমা এবং হাদীসগুলো সামনে রাখলে আমরা দেখতে পাই- কুরআনের আয়াত বলছে শিরক ছাড়া আল্লাহ তাআলা যেকোন অপরাধ ক্ষমা করে দিতে পারেন। মানে শিরক ছাড়া এমন কোন অপরাধ নেই যা কাফেরদের মত চিরস্থায়ী জাহান্নামী বানায়।
* নাম্বারে উদ্ধৃত হাদীসটি বলছে যিনা বা চুরি করলে ব্যক্তি মুসলমান থাকে না, কিন্তু ১ ও ২ নং হাদীস বলছে যিনা বা চুরি করলেও ব্যক্তি জান্নাতী হবে। মানে এসব অপরাধের কারণে ব্যক্তি কাফের হয় না। কারণ কাফের চিরস্থায় জাহান্নামী। অথচ হাদীস বলছে যিনা বা চুরি করলেও ব্যক্তি জান্নাতী হবে।
আর চার নং হাদীসটি প্রমাণ করছে মনিবের অনুমতি ছাড়া বিয়েকারী যিনাকারী। কিন্তু উক্ত ব্যক্তির উপর যিনার শরয়ী শাস্তি প্রয়োগ হবে একথা কেউ বলেন না। কারণ এখানে আসলে যিনাকারী সাব্যস্ত করা উদ্দেশ্য নয়, বরং একাজটি গর্হিত অন্যায় এটি বুঝানো উদ্দেশ্য। উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলো সামনে রাখলে আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। আসলে নামায ছেড়ে দেয়া মারাত্মক গোনাহের কাজ। এটি কাফেরদের মত কাজ। কিন্তু ব্যক্তি এতে করে কাফের হয়ে যায় না।
যেমন চার নং হাদীসে গোলামটিকে যিনাকারী বলা হলেও তার উপর যিনার শাস্তি আসে না। মানে সে আসলে যিনাকারী হয় না। বরং ধমকের জন্য এটি বলা হয়েছে।
সুতরাং নামায ছেড়ে দিলেই ব্যক্তি কাফের হবে না। বরং কাফেরদের মত কাজ হয়। যদি কাফের হয়ে যেত তাহলে তার জন্য জান্নাতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত হাদীস আসতো। অথচ নামায ছেড়ে দিলে চিরস্থায় জাহান্নামী হবার কোন হাদীস বা আয়াত বর্ণিত হয়নি। বরং আল্লাহ তাআলা এবং রাসূল সাঃ পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছেন শিরক ছাড়া আর যত গোনাহই হোক না কেন, আল্লাহ তাআলা তা মাফ করে দিতে পারেন।
তবে হ্যাঁ, যদি কেউ নামায পড়া ফরজ নয় মনে করে নামায ছেড়ে দেয়, তাহলে উক্ত ব্যক্তি কাফের। এতে কোন সন্দেহ নেই। কিংবা নামাযকে তাচ্ছিল্য করে নামায পড়া ছেড়ে দেয় তাহলেও উক্ত ব্যক্তি কাফের। কিন্তু অলসতাবশত নামায ছেড়ে দিলে ব্যক্তি কাফের হয়ে যায় বলাটা কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহ তাআলা এসব গবেষকদের হাত থেকে উম্মতী মুসলিমাকে হিফাযত করুন। আমীন।
এম আই/