|| হামিদ মীর ||
এটি ছিল ৯ মে রাত। সেই রাতে ১২টার পর একাধিক ভারতীয় টিভি চ্যানেল ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে প্রচার করতে শুরু করল যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী নাকি আজাদ কাশ্মীর দখল করে নিয়েছে। এরপর বিষয়টি আরও বাড়তে থাকে এবং ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো করাচি ও লাহোর দখলের খবরও ছড়িয়ে দেয়। রাত দেড়টার পর কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিক আমাকে ফোন করতে থাকেন, কিন্তু আমি তাদের কল উপেক্ষা করি। পরে ‘ইন্ডিয়া টুডে’র এক সিনিয়র নারী সাংবাদিক আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠালেন। তিনি প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত এবং আমার সঙ্গে সম্পর্কটা একজন সম্পাদক ও কলাম লেখকের মতো। আমি দীর্ঘদিন ধরে তার পত্রিকায় কলাম লিখছি, কারণ একজন পেশাদার সম্পাদক হিসেবে তিনি আমার লেখার সেন্সর বা বিকৃতি করেন না।
তিনি শুধু জানতে চাইলেন, ‘আপনি কি ঠিক আছেন?’ আমি তাকে জানালাম, ‘আমি একেবারে ঠিক আছি।’ আমি তখন বুঝে গিয়েছিলাম যে, জি নিউজসহ একাধিক ভারতীয় চ্যানেল এমন প্রচার চালাচ্ছে যে, তারা পাকিস্তানের পাঁচটি শহর পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিয়েছে। এমনকি ইসলামাবাদ দখল করে প্রধানমন্ত্রী হাউসে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফকে নিখোঁজ ঘোষণা করেছে। আমার সেই সম্পাদক, হয়তো এসব বিভ্রান্তিকর খবর যাচাই করতে চেয়েই আমার খোঁজ নিচ্ছিলেন।
তার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল: ‘সব কিছু ঠিক আছে তো?’
আমি জানালাম, ‘কিছুটা উত্তেজনা রয়েছে, তবে ইসলামাবাদে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।’
এরপর আমাদের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হয়। তিনি অর্ণব গোস্বামী যেভাবে আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন, সে বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। আমি আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া যেভাবে মিথ্যার ঝড় তুলেছিল, তা আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে থাকা পাকিস্তানিদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। জি নিউজের এক উপস্থাপক ঘোষণা দেন যে, ‘আজ রাত পাকিস্তানের শেষ রাত, আগামীকাল থেকে পাকিস্তান হবে অখণ্ড ভারতের অংশ।’
‘অখণ্ড ভারত’-এর প্রসঙ্গ ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো বিভিন্নভাবে তুলে ধরছিল। ভোর চারটার দিকে ফজরের নামাজ পড়ে আমি আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু বিশ্বজুড়ে থাকা সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে একের পর এক ফোন আসতে থাকল, তারা জানতে চাইছিল এই ভারতীয় মিডিয়ার দাবিগুলোর সত্যতা। ব্যাখ্যা দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে ফোন বন্ধ করে দিলাম এবং পাঁচটায় ঘুমিয়ে পড়লাম।
আটটায় উঠে দেখি বাংলাদেশের এক সাংবাদিক বন্ধু ফোন করেছেন। ৮ মে আমার কলামের বাংলা অনুবাদ একটি বাংলাদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বন্ধু জানতে চাইলেন: ‘আপনি লিখেছেন যে, পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের অহংকার মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে এবং ভারত আবার আগ্রাসন চালাবে— যদি তা ঘটে, তবে কি পারমাণবিক যুদ্ধ হবে না?’
আমি তাকে বললাম: ‘ভারতের এখনো এই ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, তারা প্রচলিত অস্ত্রে পাকিস্তানের চেয়ে শক্তিশালী। তাই তারা প্রচলিত অস্ত্রেই পাকিস্তানকে পরাজিত করার চেষ্টা করবে এবং তাদের অপমানের প্রতিশোধ নেবে।’
বাংলাদেশি সাংবাদিক পাকিস্তানের সাফল্য ও নিরাপত্তার জন্য শুভকামনা জানালেন।
১০ মে রাতে ভারত পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে যুদ্ধ শুরু করে। পাকিস্তানও পাল্টা জবাব দেয় এবং তা ছিল আরও কার্যকর। ভারত পাকিস্তানের নয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালায়, যার মধ্যে রাহিমইয়ার খান-এর শেখ জায়েদ বিমানবন্দরও ছিল। পাকিস্তান জবাবে ভারতের ২৬টি স্থাপনায় হামলা চালায়। ভারতের সবচেয়ে বড় ক্ষয়ক্ষতি হয় আদমপুর বিমানঘাঁটিতে, যেখানে রাশিয়া থেকে ২০১৮ সালে দেড় বিলিয়ন ডলারে কেনা এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ধ্বংস হয়ে যায়।
৭ মে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ফরাসি রাফাল যুদ্ধবিমানের ‘গর্ব’কে মাটিতে নামিয়ে দিয়েছিল, আর ১০ মে রুশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও ধ্বংস হয়ে গেল।
পাকিস্তান বিমান বাহিনী শুধু ‘ডগফাইট’-এ ভারতকে পরাস্ত করেনি বরং ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে ভারতের ব্রাহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্রও ধ্বংস করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে।
ভারতের হাতে ছিল ফরাসি যুদ্ধবিমান, রাশিয়ার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং ইসরায়েলি ড্রোন। কিন্তু পাকিস্তানের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ৭৮টিরও বেশি ইসরায়েলি ড্রোন ধ্বংস করে এক নতুন সামরিক ইতিহাস গড়ে তোলে।
স্থলযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় কামান ধ্বংস করে দেয় এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় সেনারা সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণ করতে থাকে।
ভারতের ধারণা ছিল, আমেরিকা, ইউরোপ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশ তাদের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু ইসরায়েল ছাড়া কোনো বড় শক্তি ভারতের পাশে দাঁড়ায়নি। অন্যদিকে চীন, তুরস্ক ও আজারবাইজান প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়। ভারতীয় মিডিয়ায় তখন ইরানের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু হয়।
শেষমেশ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। তখন ভারতীয় মিডিয়া ট্রাম্পের বিরুদ্ধেও সরব হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধবিরতিতে আমেরিকা ছাড়াও ব্রিটেন, সৌদি আরব ও তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
যে ভারত সবসময় তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান করত, এবার আমেরিকাকে মধ্যস্থতা করতে দিয়ে তারা নিজেকে আরও অপমানিত করে ফেলেছে। এই যুদ্ধ ও কূটনৈতিক পরাজয় ভারতের জন্য একটি বড় শিক্ষা হয়ে থাকবে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যতের ওপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
যদিও ভারত যুদ্ধবিরতি স্বীকার করে নিয়েছে, তবুও তারা সিন্ধু পানি চুক্তি পুনঃস্থাপন করেনি। যে পাকিস্তানকে তারা ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ বলে, এখন সেই পাকিস্তানের সঙ্গেই তাদের আলোচনায় বসতে হচ্ছে।
যুদ্ধবিরতির পর ভারতীয় মিডিয়া মিথ্যা অভিযোগ তোলে যে, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে। আমি যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ফলপ্রসূ আলোচনার পক্ষপাতী, কিন্তু নরেন্দ্র মোদির রাজনীতিতে এর কোনো স্থান নেই।
মোদি ২৪ মার্চ ২০১২ সালে আহমেদাবাদে প্রকাশ্যে ‘অখণ্ড ভারত’ সমর্থন করেছিলেন এবং পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি সবসময় বালোচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিয়ে এসেছেন, কিন্তু ‘অখণ্ড ভারত’ ধারণায় স্বাধীন বালুচিস্তান বা স্বায়ত্তশাসিত আফগানিস্তানের কোনো স্থান নেই।
মোদি চান পাকিস্তান, বাংলাদেশ, বার্মা, নেপাল, তিব্বত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভুটান এবং মালদ্বীপ — সবাই মিলে যেন এক ‘অখণ্ড ভারত’ হয়। এজন্যই ভারতীয় পার্লামেন্টে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি ঘটাতে সক্ষম হলেও, ভারতে মোদির রাজনৈতিক পতন শুরু হয়ে গেছে। তিনি নিজের রাজনীতি বাঁচাতে যুদ্ধবিরতির পথ থেকেও সরে যেতে চাইবেন। আমরা ভারতের সঙ্গে শত্রুতা চাই না, তবে যতদিন ভারতীয় পার্লামেন্টে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র ঝুলছে, মোদি সরকারের ওপর বিশ্বাস করা যাবে না।
[হামিদ মীর পাকিস্তানের বিখ্যাত সাংবাদিক। লেখাটি উর্দু দৈনিক জং থেকে অনুবাদ করেছেন: সাইমুম রিদা]
এসএকে/