বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫ ।। ১৭ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ২ জিলকদ ১৪৪৬


ভারতীয় মুসলিমদের কেন বারবার দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে হবে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নাজমুদ্দিন ফারুকি

পেহেলগামের সাম্প্রতিক ট্র্যাজেডি আমাকে গভীরভাবে মর্মাহত করেছে। শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি আমার সমবেদনা ও প্রার্থনা রইল, আর আমি এই নৃশংস ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই—কোনো রাখঢাক না রেখেই।

তবে, প্রতিবার যখন এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা ঘটে, তখন একটা নির্দিষ্ট ধারা চোখে পড়ে যেটা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন: কেন ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের কণ্ঠ তখন হঠাৎ করে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে? কেন তাদের বারবার প্রকাশ্যে নিন্দা জানাতে হয়, শুধু এই কারণে যে, অপরাধীদের ধর্ম বা নাম ইসলাম-সম্পর্কিত? কেন তাদের এই নিন্দা শুধু মুখের নয়, দৃশ্যমানও হতে হবে—যাতে তা জনমত ও ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছায়?

প্রথমেই আমাদের প্রশ্ন করা উচিত: কেন প্রতিটি সন্ত্রাসী ঘটনার পর ভারতীয় মুসলিম সমাজকে সমষ্টিগতভাবে দায়বদ্ধ মনে করে প্রকাশ্যে নিন্দা জানাতে হবে? আমাদের আইন অনুযায়ী, কোনো পরিবারের একজন সদস্যের অপরাধের দায় পুরো পরিবার বহন করে না। তেমনি, কেবল ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে পুরো একটি সম্প্রদায়কে সন্দেহের চোখে দেখা বা অপরাধবোধে ভোগানো অনুচিত। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের সমাজে একটি মৌন কিন্তু গভীরভাবে গেঁথে বসা ধারণা রয়েছে—সন্ত্রাসবাদ যেন মুসলিমদের সঙ্গেই সমার্থক।

এর মানে এই নয় যে, বাস্তবতা অস্বীকার করা হচ্ছে। সত্যি, কিছু ঘটনায় মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু সদস্যের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং সাজা হয়েছে। কিন্তু এটাও সত্য যে, বহু নিরপরাধ মুসলিমকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে, পরে আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। এই জটিল বাস্তবতার মাঝেও বড় প্রশ্নটা থেকেই যায়: কেন প্রতিবার প্রতিটি মুসলিমকে এগিয়ে এসে এমন কিছুর বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে হবে, যার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই?

সহানুভূতি ও শোক—এই দুটি একটি সভ্য সমাজের স্বাভাবিক মানবিক অনুভূতি। আমরা সকলেই নিরীহ প্রাণহানিতে শোকাহত হই, বিশেষ করে তা যদি হয় উদ্দেশ্যহীন সহিংসতায়। পরিবার বা কাছের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে শোক আরও গভীর হয়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের মতো উদ্দেশ্যহীন হত্যাকাণ্ডগুলো বোধহয় সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক।

ভারতীয় নাগরিক সমাজের একজন সদস্য হিসেবে মুসলিমরাও অন্যদের মতোই এই সহিংসতায় ব্যথিত হন। তাহলে কেন শুধু তাদেরই ওপর এমন এক অতিরিক্ত চাপ তৈরি করা হয়, যেন তাদের প্রতিবার প্রমাণ করতে হবে তারা দেশপ্রেমিক? যেন তারা জোরে না বললে বা প্রকাশ্যে না জানালে তা অপরাধের সমর্থন বলে ধরে নেওয়া হবে?

এবার ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক: ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে পাঞ্জাবে যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে ছিল, তখন অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু তখন কি প্রত্যেক শিখ নাগরিককে রাস্তায় নেমে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছিল? কেউ কি তাদের প্রত্যেককে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেশপ্রেমের শপথ নিতে বলেছিল? না। তাহলে মুসলিমদের জন্য এই মাপকাঠি আলাদা কেন?

সন্ত্রাসবাদ নিজের স্বভাবেই জঘন্য। কোনো সাধারণ, সহানুভূতিশীল মানুষ কখনো তা সমর্থন করতে পারে না—সে যেকোনো ধর্মের হোক। আমি জানি না পেহেলগামের হামলা কারা করেছে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যারা নিরীহ প্রাণ কেড়ে নেয়, তারা মানুষ নামের যোগ্য নয়। আইন নিজের পথে চলবে—তাই হওয়াই উচিত। কিন্তু, একইসঙ্গে আমাদের এই প্রবণতা নিয়েও ভাবতে হবে—যেখানে তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই মিডিয়া বিচার করে ফেলে, আর পুরো একটা সম্প্রদায়কে এক কুয়োয় ফেলে দেওয়া হয়।

ভারতে গণতন্ত্র এখন এক সংকটে পড়েছে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, কালো ব্যাজ পরা বা ফিলিস্তিনের মতো আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সংহতি জানানো—এসব কিছু এখন প্ররোচনামূলক বলে গণ্য হয়, যদি মুসলিমরা করেন। যদি মুসলিমরা পুলিশের বাড়াবাড়ি বা রাষ্ট্রীয় অবিচারের প্রতিবাদ করতে না পারেন, তাহলে কীভাবে তারা অন্যের কৃতকর্মের দায় নেবেন?

আজ যদি কোনো মুসলিম সংগঠন ন্যায়সঙ্গত দাবি তোলে বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমালোচনা করে, তাহলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। অথচ যারা প্রকাশ্যে অশ্লীল ভাষায় প্রধানমন্ত্রীর বা মুখ্যমন্ত্রীদের গালি দেয়, তাদের কিছুই হয় না। এই দ্বিমুখিতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

আমার প্রিয় মুসলিম বন্ধুদের বলি, তোমরা যদি বারবার তোমাদের দেশপ্রেম প্রমাণ করতে যাও, তাহলে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়বে। যাদের প্রমাণ দেখাতে চাইছো, তারা তোমার এই প্রয়াস স্বীকারই করতে চায় না। তারা ‘তাজাহুল-এ-আরিফানা’—অর্থাৎ, জানার পরও অজানার ভান করে। এরা সেই মানুষ, যারা গান্ধীজির উত্তরাধিকার অস্বীকার করে, নেহরুর প্রজ্ঞাকে উপেক্ষা করে, মাওলানা আজাদের বুদ্ধিমত্তাকে অস্বীকার করে, এমনকি দিলীপ কুমার, শাহরুখ খান বা আমির খানের দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তোলে—শুধু এ.পি.জে. আব্দুল কালামের ব্যতিক্রম ছাড়া।

১৯৯৩ সালের এক ব্যক্তিগত ঘটনার কথা মনে পড়ছে। উত্তর প্রদেশের প্রখ্যাত আমলা ও পুদুচেরির প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর শ্রী ত্রিভুবন প্রসাদ তিওয়ারির (টিপিটি) বাসায় একবার আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। সরকারি কথাবার্তা শেষে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম—ভারতের মুসলিমদের জন্য তার কী পরামর্শ। তিনি বললেন: ‘হুব্বুল ওয়াতানি সে কাম লো’—অর্থাৎ দেশপ্রেমকে কাজে লাগাও। আমি বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বললেন, হিমালয়, গঙ্গা, যমুনা নিয়ে কথা বলো—যেমন রাহিম, রসখান বা সেই সময়ের জনপ্রিয় কবি বেকাল উৎসাহী বলতেন।

এর কয়েক মাস পরে আমি 'টাইমস অব ইন্ডিয়া' পত্রিকায় পড়ি, টিপিটিকে আরএসএস-এর উত্তর প্রদেশ শাখার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মজার বিষয় হলো, এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন: ‘আমি টুপি পরি না, কারণ আমি আমার ধর্ম মানি এবং অন্য ধর্মকেও সম্মান করি।’ এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। ভারতীয় মুসলিমদেরও এ পথ অনুসরণ করা উচিত: নিজের ধর্মের ভিত ধরে রাখো, কিন্তু অন্য সকল ধর্মকে সম্মান করো।

অন্য এক সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেন, একজন সনাতন হিন্দু হিসেবে তিনি মসজিদে যাবেন না, তবে দায়িত্ববোধ থেকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে গেলে আপত্তি নেই। এটাই সেই ধর্মনিরপেক্ষ পেশাদারিত্ব, যা ভারতের আজকের বাস্তবতায় আরও প্রয়োজন।

শেষ কথায় বলি—ভারতের মুসলিমদের বারবার দেশপ্রেম প্রমাণ করতে বাধ্য হওয়া উচিত নয় বা অন্যদের অপরাধের দায় নিতে বাধ্য করা ঠিক নয়। সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করা স্বাভাবিক, কিন্তু তা জোর করে বারবার করানো হলে, তা অন্যায় সামাজিক প্রত্যাশার ইঙ্গিত দেয়। দেশপ্রেম সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশ পায় নীরব, ধারাবাহিক কাজে—না যেকোনো চাপে দেওয়া ঘোষণায়।

[ইংরেজি মুসলিম মিরর পত্রিকা থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন: সাইমুম রিদা]

এনএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ