পবিত্র ওমরা পালন করতে গিয়ে সৌদি আরবে ইন্তেকাল করেছেন বিশিষ্ট তরুণ আলেম লেখক গবেষক রায়হান খাইরুল্লাহ (৩৫)। রবিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সৌদির সময় বেলা ১টায় মক্কার কিং ফয়সাল হাসপাতালের আইসিউতে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় ডাক্তারগণ তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান রায়হান খাইরুল্লাহ’র বন্ধু লেখক মাওলানা আবদুল্লাহ আল ফারুক।
এদিকে রায়হান খাইরুল্লাহ’র ইন্তেকালে শোক নেমে এসেছে লেখকপাড়ায়। লেখকের প্রতি শোক, তার পরিবারের প্রতি সমবেদনাসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা স্মৃতিচারণ করছেন তারা।
দেশের প্রবীণ লেখক গবেষক শরীফ মুহাম্মদ লিখেন, আমাদের অত্যন্ত প্রিয় আলেম-লেখক স্নেহভাজন মাওলানা রায়হান খাইরুল্লাহ ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
তিনি উল্লেখ করেন, ওমরার সফরে ওমরাহ সম্পন্ন করার পর মক্কা মুকাররমায় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মুমূর্ষু অবস্থায় কয়েকদিন হাসপাতালে ছিলেন। অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনা। ছিলেন যুবক মিষ্টভাষী বিনয়ী আলেমেদ্বীন। এইতো সেদিন বাড্ডায় এক দ্বীনি মজলিসে তার ভাই মাওলানা সালমান এবং তার আব্বা হযরত মুফতি খাইরুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলো। রায়হান খাইরুল্লাহ সঙ্গে দেখা হচ্ছিল না বলে একাধিকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম তার কথা। মাওলানা সালমান জানিয়েছিলেন, রায়হান ওমরাহর সফরে আছে। গত দুদিন তার মুমূর্ষু অসুস্থতার খবর দেখে দোয়া করছিলাম। বহু ওলামায়ে কেরাম তার জন্য দোয়া করেছেন এবং করছেন। আমার চোখে তার বিনয়ী স্মিত হাসিমাখা মুখের ছবিটা লেগে আছে।
আল্লাহ তাআলা তার ঘরের পাশে এই বান্দার জন্য শান্তিময় আবাসের ব্যবস্থা করে দিন, জান্নাত দান করুন, তার পরিবার ও সন্তানের জন্য কাফিল হয়ে যান।
লেখক ও সাংবাদিক ঢাকা মেইল বার্তা সম্পাদক জহির উদ্দিন বাবর লিখেন, ‘রায়হান খাইরুল্লাহ’র সঙ্গে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা সেভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। তবে মধ্যবাড্ডায় যাতায়াতের সুবাদে প্রায়ই দেখা হতো। মাকতাবাতুল আযহারের স্বত্বাধিকারী ওবায়দুল্লাহ আযহারী ভাইয়ের প্রিয় ভাগিনা। ইসলামের ইতিহাস বিশ্বকোষের কাজের সূত্রে একসঙ্গে কয়েক বার বসাবসির সুযোগও হয়েছে। বেশ ভদ্র ও কিছুটা লাজুক প্রকৃতির বলে মনে হয়েছে। লেখালেখি ও অনুবাদে ছিলেন সক্রিয়। তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় মুখ।
ওমরার সফরে মক্কাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেখানেই একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আল্লাহর প্রিয় হয়ে গেলেন। হে আল্লাহ! লেখক অনুবাদক রাইহান খাইরুল্লাহকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন। তার পরিবার-পরিজনকে সবর করার তাওফিক দিন। আমিন।
সাংবাদিক ও খতিব আলী হাসান তৈয়ব লিখেন, ‘দুদিন ধরে নেট দুনিয়ায় আমাদের বেচাইন অবস্থার পর চলেই গেলেন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক, অনুবাদক ও একজন খাঁটি আশেকে রাসূল (সা.) প্রিয়ভাই মাওলানা রায়হান খাইরুল্লাহ। মনকে কোনোভাবেই বুঝ দিতে পারছি না। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। লিল্লাহি মা আখাযা...।
দুনিয়া কত ক্ষণস্থায়ী! প্রতিদিন চলে যাচ্ছে কাছের মানুষগুলো। উচ্ছল যুবক-কিশোররা চলে যাচ্ছে। ভাবতে গেলে চিন্তা বিবশ হয়ে আসে। লম্বা কোনো পরিকল্পনা সামনে আনতে পারি না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
স্মৃতি মেলে ধরে আলী হাসান আরও লিখেন, ‘ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় তার মামার প্রতিষ্ঠান মাকতাবাতুল আযহারে। পরে অনেকবার অনেক জায়গায় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। সব সময় চেহারাই হাসি আর কোমল ভাষা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
লেখক হিসেবে তাঁর জন্য ভালোবাসা সবসময় ছিল। তাঁর বিনম্র আখলাকেও মুগ্ধতাছিল সবসময়। কিন্তু তাঁর প্রতি বিশেষ ভালোবাসা জন্মে মক্কা-মদিনার প্রতি তাঁর বিশেষ ভালোবাসা দেখে। সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন। এক এক বছরে একাধিকবার ছুটে গিয়েছেন। তাঁর চিন্তা, পরিকল্পনা ও স্বপ্ন জুড়েই ছিল হারামাইন শরিফাইন।
তাঁর টাইম লাইনে গিয়ে একটু পড়ে দেখুন— কী নিখাদ ভালোবাসা, কী অদম্য টান আর অতৃপ্ত ভালোবাসা তিনি পুষেছেন কালো গিলাফ আর সবুজ গম্বুজের প্রতি। ভাইজানের নিকট অতীতের তিনটি পোস্টের স্ক্রিনশট দিলাম দেখুন।
আজ হোক কাল হোক মৃত্যুর পেয়ালা তো পান করতেই হবে। তাই মৃত্যুর চেয়েও বড় ঘটনা কিভাবে মৃত্যু হলো। সুবহানাল্লাহ সৌভাগ্যের মৃত্যু। নিষ্পাপ হবার আমল উমরা করেছেন। এখনো ফেরেননি ঘরে। আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশেই হলো তার শেষ বিদায়। যাওয়ার আগে বিছানায় শুয়ে আল্লাহকে কাতরভাবে ডাকার প্রাণভরে ইস্তেগফারের কী সুযোগ না পেলেন তিনি!
এ কাবার মালিক, তোমার ঘরের মেহমানকে তুমি তোমার জান্নাতের মেহমান হিসেবে বরণ করে নাও। তাঁর পরিবারকে সবরে জামিল ও নিমাল বাদিল দান করো।’
বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক আবদুল্লাহ আল ফারুক লিখেন, ‘ঘুনাক্ষরেও ভাবিনি, এতো দ্রুত মাওলানা রাইহান খাইরুল্লাহর নামের পর ‘রহিমাহুল্লাহ’ লিখতে হবে।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি ওমরায় যান। যাওয়ার আগে মাকতাবাতুল আযহারের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তাঁর সাথে কথা বলেছি। কখন সপরিবারে ওমরায় গেলে ভালো হবে, সে ব্যাপারে পরামর্শ করেছি।
সফরের অনেক খুঁটিনাটি নিয়ে তার সাথে বিস্তর কথা বলেছি।
আর সেই তিনি এখন দুনিয়ার সফর সমাপ্ত করে অনন্ত আখিরাতের মুসাফির।
স্মৃতিচারন করে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আশুলিয়াতে যখন আমার বালিকা মাদরাসার ভবনের কাজ ধরি, তখন বারবার অর্থসংকটের কারণে নির্মাণকাজ ব্যাহত হতো। একা মানুষ। কত দিক সামলাবো! জায়গা কেনার পর ভবন করা আমার জন্যে দীর্ঘ শ্রমসাধ্য কাজ ছিল।
যখুনি মাদরাসার কাজে বড় অংকের ঋণের দরকার হতো, তাকে বলতাম। একাউন্টে থাকলে তিনি এক মুহূর্তও গড়িমসি করতেন না।’
আবদুল্লাহ আল ফারুক আরও লিখেন, ‘সেই ২০১২ সাল থেকে তার সাথে আমার লেখালেখির সহযাত্রা। মাকতাবাতুল আযহারের অনেকগুলো বড় সংকলন আমরা একসাথে অনুবাদ করেছি। ‘সোনালি যুগ সিরিজ’ ‘খুতুবাতে যুলফিকার’ ‘মাআরিফুল কুরআন’ ‘সীরাত বিশ্বকোষ’ ‘ইতিহাস বিশ্বকোষ’ ‘তাসাওউফ’ অনেকগুলো বইয়ের কাজ আমরা একসাথে করেছি।
এমনকি এখনও আমরা ইতিহাস বিষয়ক একটি কাজ যৌথভাবে অনুবাদ করছি। তার দায়িত্বে সেই বিশাল সংকলন থেকে ১৫০ পৃষ্ঠার অনুবাদ ছিল। তিনি সফরের আগেই সিংহভাগ কাজ সম্পন্ন করেছেন। বলেছেন, ‘ওমরা থেকে ফিরে বাকি কাজ সম্পন্ন করে এ মাসের মধ্যেই জমা দেবেন, ইনশাআল্লাহ।’
কে ভেবেছিল, এ সফরই হবে জীবনের শেষ সফর!
দু’ চোখের পাতা এক করলেই কত শত সুখ-দুখের স্মৃতি এসে আছড়ে পড়ছে মনের উপকূলে। আমি জানি, এই মুহূর্তে তার পরিবারের ওপর দিয়ে প্রলয়ংকারী তুফান বইছে। মাত্র চার বছর আগে বিয়ে করেছেন। ঘরে আদরের ফুটফুটে কন্যা। আড়াই বছর বয়স হবে হয়তো। রাইহানের আব্বু মাওলানা খাইরুল্লাহ সাহেব বছর দুয়েক মারাত্মক অসুস্থ ছিলেন। এখন তার আম্মাও মারাত্মক অসুস্থ।
তাদেরকে সান্ত্বনা দেবার মতো একটা অক্ষরও আমার কাছে নেই।
শুধু দুআ করছি, আল্লাহ তাদেরকে সবরে জামিল এখতিয়ারের তাওফিক দিন। এতো বড় শোক সামলে ওঠার হিম্মত দিন। মহান আল্লাহ তার পরিবারের অভিভাবক হয়ে যান। আমিন।
শিশুকিশোর ম্যাগাজিন মাসিক নকীব সম্পাদক লেখক জিয়াউল আশরাফ শোক জানিয়ে লিখেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। রাইহান খাইরুল্লাহ। আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। আল্লাহ তাকে মাফ করুন।
রায়হান খাইরুল্লাহ’র ইন্তেকালে শোক জানিয়েছেন আওয়ার ইসলাম সম্পাাদক লেখক হুমায়ুন আইয়ুব। তিনি লিখেন, আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুক। তার পরিবারকে সবরে জামিল এখতিয়ার করার তাওফিক দিক।
লেখক মুহিউদ্দিন কাসেমী লিখেন, ‘তরুণ আলেম মাওলানা রায়হান খাইরুল্লাহ আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ তাআলা ভাইকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমিন। চুল দাড়ি পাকাও শুরু হয়নি তাঁর। আমরা কীভাবে ভাবি যে, বৃদ্ধ হয়ে মারা যাব? মৃত্যুর কোনো বয়স নেই। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা জরুরি।
এদিকে লেখক রায়হান খাইরুল্লাহ’র ইন্তেকালে শোক জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম।
শোক জানিয়ে ফোরাম জানায়, আমরা লেখক অনুবাদক রায়হান খায়রুল্লাহর মাগফেরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন।
ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আমিন ইকবাল বলেন, গতকাল লেখক ফোরামের আনন্দ ভ্রমণে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছিলাম। হঠাৎ করে সভাপতি মহোদয় বললেন, মাকতাবাতুল আযহারের স্বত্বাধিকারী ওবায়দুল্লাহ ভাই আসার কথা ছিল। তিনি মাত্রই ফোন করে জানালেন তার ভাগিনা অনেক অসুস্থ, তাই আসতে পারবেন না। ভাগিনার জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।
আমি সাথে সাথেই মাইকে বললাম এবং সবার দোয়া চাইলাম। কিন্তু তখনও জানি না বা বুঝতে পারি নাই ওবায়েদ ভাইয়ের সেই ভাগিনা হলেন তরুণ লেখক রায়হান খাইরুল্লাহ।
প্রিয় রায়হান খায়রুল্লাহ আর নেই। ওমরাহ সফরে গিয়েছিলেন কাফেলা নিয়ে। কয়েকদিন আগে সেই কাফেলার যাত্রীদের সঙ্গে মদিনায় দেখা হয়েছে৷ তার বিষয়ে অনেক আলাপ হয়েছে। গতকাল যাত্রীরা দেশে ফিরে এলেও সে আসল না। পবিত্র ভূমিতে আল্লাহ রেখে দিয়েছেন।
কিছু মানুষের বিদায় স্মরণ করিয়ে দেয়, মৃত্যু আমাদের কাছেই থাকে।
হাআমা/