বুধবার, ০৮ মে ২০২৪ ।। ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫


দাওয়াতি কাজে বিশ^স্ততা ও সত্যনিষ্ঠা জরুরি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| মাওলানা শামসুদ্দীন সাদী ||

দাওয়াতি কাজ মূলত নবীওয়ালা কাজ। এই কাজে বিশ^স্ততা ও সত্যনিষ্ঠা অর্জন জরুরি। ভয়ভীতি ও লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে বিশ^স্ত ও সত্যনিষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নবীওয়ালা এই কাজে মহানবী সা.-এর তরিকাই আমাদের আদর্শ। দাওয়াতি কাজে নানা ভয়ভীতি জুলুম অত্যাচার লোভ লালসায় নবীজি ছিলেন পাহাড়ের মতো দৃঢ় অবিচল। ভয়-ভীতিতে বিন্দুমাত্র ভীত হননি। জুলুম অত্যাচারে ভেঙে পড়েননি। লোভ লালসায় আটকে যাননি। সবকিছু উপেক্ষা করে ধৈর্যের পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। বিশ^স্ত ও সত্যনিষ্ঠ থেকেছেন।

বিশ^স্ততা সততা একদিনে অর্জনের বিষয় না। এক অবিচ্ছিন্ন সাধনায় এই গুণ অর্জিত হয়। চল্লিশ বছর বয়সে নবীজি নবুয়ত লাভ করেন। নবুয়তপ্রাপ্তির আগেই মক্কার গণ্যমান্য লোকদের থেকে আল আমিন বা বিশ^স্ততা ও সত্যনিষ্ঠার সনদ পেয়েছিলেন। ফলে সাফা মারওয়া পাহাড়ে আরোহণ করে নবীজি যখন প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াতি মিশনে পদাপর্ণ করেন তখন প্রথমে নিজের বিশ^স্ততা ও সত্যনিষ্ঠার সনদের পুনঃস্বীকৃতি আদায় করেন। উপস্থিত সবাই সমস্বরে স্বীকৃতি দেন যে, তুমি আল আমিন, তুমি বিশ^স্ত ও সত্যনিষ্ঠ। তুমি কখনও মিথ্যা বল না। সততা ও বিশ^স্ততার এই যে স্বীকৃতি দায়ীর জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি।

দাওয়াতি কাজে দুনিয়াবি স্বার্থচিন্তা রাখা যাবে না। পৃথিবীতে যত নবী আগমন করেছেন, দাওয়াতি কাজ করেছেন, দাওয়াতি কাজকে তারা প্রত্যেকেই দুনিয়াবি স্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখেছেন। কুরআন মাজিদেও বারবার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। যেমন: কুরআনে হজরত হুদ আ.-এর উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে: হে আমার সম্প্রদায়! আমি এর জন্য তোমাদের কাছে বিনিময় চাই না। আমার বিনিময় তো তাঁর দায়িত্বে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। [সুরা হুদ: ৫১] হজরত শাব্বির আহমাদ উসমানী রহ. এই আয়াতের তাফসিরে বলেন, এই কথা প্রত্যেক নবী নিজ নিজ উম্মতকে বলেছেন। যাতে তাদের নসিহত নিঃস্বার্থ ও কার্যকর হয় এবং মানুষ তাঁদের পরিশ্রমকে পার্থিব লালসাপ্রণোদিত মনে না করে।

রাসুলুল্লাহ সা. যখন প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন মক্কার মুশরিকরা ভেবেছিল, নেতৃত্বলোভ কিংবা অর্থলিপ্সার বশবর্তী হয়ে মুহাম্মাদ নতুন ধর্মের প্রচারণা শুরু করেছে। ফলে একটি প্রতিনিধি দল গিয়ে নবীজিকে বলল, আপনি যদি নেতৃত্ব চান তাহলে আমরা আপনাকে মক্কার নেতৃত্বের আসনে বসাব, আপনি যদি অর্থ চান আপনাকে আমরা অঢেল অর্থসম্পদ দেব, আপনি যদি সুন্দরী নারী বিয়ে করতে চান আমরা মক্কার সবচেয়ে সুন্দরী নারীকে আপনার সঙ্গে বিবাহ দেব, তারপরও আপনি নতুন ধর্মের দাওয়াত বন্ধ করুন। এছাড়া আপনার যদি মানসিক সমস্যা থাকে আমরা চিকিৎসারও ব্যবস্থা করব। নবীজির চাচা আবু তালিবকেও তারা নানা হুমকি দিতে থাকে। কাফেরদের এসব প্রলোভনে নবীজি সা. দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দেন: তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে আকাশের চাঁদ এনে দেয় এবং কামনা করে যে, আমি মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া বন্ধ করে দিই তাহলে আমি কখনও এমনটা করব না। যতদিন না সত্যধর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে অথবা আমার জীবন উৎসর্গিত হবে, এ দাওয়াতি কাজ আমি বন্ধ করব না।

দাওয়াতি কাজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ধৈর্য ও সবর। মক্কার মুশরিকরা নবীজিকে নানা রকম কষ্ট দিয়েছে। আবু জাহেল নবীজির পিঠের ওপর উটের বর্জ্য এনে ঢেলে দিয়েছিল। তায়েফের লোকেরা নবীজির কোমল দেহ রক্তাক্ত করেছিল। আল্লাহর নবী সকল জুলুম অবিচারে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। তাদের হেদায়েতের দোয়া করেন।

দাওয়াতি কাজে বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল জরুরি। মক্কার মুশরিকরা নবীজিকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। রাতের আঁধারে তাঁর গৃহ অবরোধ করেছিল। মক্কার দুর্ধর্ষ ঘাতকদের কোষমুক্ত তরবারি তাক করা ছিল নবীজির বহির্গমনের পথে। চারশ লাল উটের লোভে মদিনার পথে গুপ্তঘাকতরা আনাগোনা করেছিল। সেই কঠিন মুহূর্তে নবীজি সা. অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় হিজরতের পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলে কাফেরদের সকল চক্রান্ত পরাভূত করে নিরাপদে মদিনায় পৌঁছে যান।
দাওয়াতি কাজের পথ ও পন্থা এক রৈখিক নয়। এর জন্য প্রয়োজন বিশ^স্ততা সততা নিষ্ঠা ধৈর্য ও কৌশল। দুনিয়াবি স্বার্থচিন্তার ঊর্ধ্বে ওঠা এবং যাবতীয় প্রলোভনের হাতছানি উপেক্ষা করে সামনে অগ্রসর হওয়া দাওয়াতি কাজের অন্যতম আদর্শ।

লেখক: মাদরাসা শিক্ষক, লেখক ও অনুবাদক 

কেএল/


সম্পর্কিত খবর