আবদুল কাইয়ুম শেখ।।।
যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলামের সুরম্য প্রাসাদ নির্মিত তার অন্যতম হলো যাকাত। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভসমূহের সমান্তরালে এর অবস্থান। মহাগ্রন্থ আলকুরআনের ৩২ জায়গায় যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন শরিফের বহু আয়াতে নামাযের সঙ্গে সঙ্গে যাকাতের আলোচনা করা হয়েছে। তাই প্রতিটি মুসলিমকে যাকাত ফরয হবার বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করতে হবে; সঙ্গে সঙ্গে সামর্থ্যবান প্রতিটি ব্যক্তির যাকাত আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে।
যাকাতের পরিচয়
যাকাত একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, শুদ্ধতা, বর্ধনশীলতা ও প্রাচুর্যময়তা। আর ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী প্রতি বছর সঞ্চিত সম্পদের মোট মূল্যের আড়াই শতাংশ হারে নির্ধারিত দরিদ্র ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা কর্তৃক আরোপিত অবশ্য প্রদেয় অর্থকে শরিয়তের পরিভাষায় যাকাত বলা হয়। বাংলা উইকিপিডিয়ার ভাষ্যমতে ‘প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক, মুসলমান নরনারীকে প্রতিবছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্ধারিত অংশ, যদি তা ইসলামি শরিয়ত নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে তবে গরিব-দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে যাকাত বলা হয়।’ যাকাত দানের মাধ্যমে যেহেতু চারিত্রিক শুদ্ধতা ও নিষ্কলুষতা অর্জিত হয় এবং সম্পদের সুষম বণ্টন ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায় তাই একে যাকাত বলে অভিহিত করা হয়।
যাকাত আবশ্যক হবার প্রমাণ
মহাগ্রন্থ আলকুরআনের বহু ভাষ্যের আলোকে নেসাবধারী প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর যাকাত প্রদান করা ফরয হবার বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত। যাকাত প্রদান করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমরা নামায আদায় কর ও যাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু কর।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৪৩) অন্য এক আয়াতে যাকাত প্রদানকে সঠিক ধর্ম বলে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে, ‘তাদেরকে এ ছাড়া আর কোনো নির্দেশ প্রদান করা হয় নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত প্রদান করবে। এটাই সঠিক ধর্ম। (সুরা বায়্যিনাহ, আয়াত : ৫)
অনুরূপভাবে বহু হাদিসের আলোকেও সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর যাকাত প্রদান করা ফরয হবার বিষয়টি প্রমাণিত। সহিহ বুখারি শরিফে এসেছে : হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, মহানবি সা. হযরত মুআয রা. কে ইয়ামান দেশে শাসক হিসাবে প্রেরণ করেন। প্রেরণকালে তিনি বলেন, সেখানকার অধিবাসীদের (প্রথমে) এ সাক্ষ্য দানের প্রতি আহ্বান করবে যে, আল্লাহ তাআলা ব্যতীত প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসুল। যদি তারা তা মেনে নেয়, তা হলে তাদেরকে অবহিত করবে যে, আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন।
যদি সেটাও তারা মেনে নেয়, তা হলে তাদেরকে জানাবে, আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর তাদের সম্পদের মধ্য থেকে যাকাত ফরয করেছেন। এটা ধনীদের থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩৯৫) অন্য একটি হাদিসে মহানবি সা. যাকাত আদায়কে ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম বলে অভিহিত করে বলেন, ‘ইসলামের ভিত্তি রাখা হয়েছে পাঁচটি জিনিসের ওপর। এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহ তাআলার রাসুল। নামায কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, হজ্জ করা ও রমযান মাসের রোযা রাখা।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮)
যাকাত আদায় করার ফযিলত
যাকাত আদায় করা ও সাধারণ দান-অনুদান প্রদান করার রয়েছে বহুবিধ ফযিলত ও মর্যাদা। যে ব্যক্তি ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত যাকাত সঠিক পন্থায় ও যথাযথ নিয়মে আদায় করবে সে তা আল্লাহ তাআলার কাছে আরো বর্ধিতরূপে পাবে। এ মর্মে মহাগ্রন্থ আলকুরআনে এসেছে, ‘তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্যে যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে ও পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে।’ (সুরা মুয্যাম্মিল, আয়াত : ২০) আলকুরআনের স্পষ্ট ভাষ্যমতে আল্লাহ তাআলা দান-অনুদানকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেন।
ইহকালেও এর সুফল ভোগ করা যায় এবং পরকালেও পুণ্য অর্জিত হয়। পরকালে যাকাতের প্রতিদান প্রদান করা হবে মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্যে পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১১০) অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎকাজ করেছে, নামায প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং যাকাত দান করেছে, তাদের জন্যে তাদের পুরস্কার তাদের পালনকর্তার কছে রয়েছে।
তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৭) অনুরূপভাবে হাদিস শরিফেও যাকাত আদায় করার বহু ফযিলত বর্ণিত হযেছে। যদি কোনো ব্যক্তি নিজের ওপর অবধারিত যাকাত আদায় করে এবং সাধারণ দান-অনুদান প্রদান করে, তা হলে আল্লাহ তাআলা তার ধনৈশ্বর্য আরো বাড়িয়ে দেন! তাকে অকাতরে দান করতে থাকেন। একটি হাদিসে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সা. বলেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে বলেছেন, খরচ কর, তোমার ওপরও খরচ করা হবে। রাসুলুল্লাহ সা. আরো বলেছেন, আল্লাহ তাআলার হাত প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। রাত দিন ব্যয় করা সত্ত্বেও তা মোটেই কমছে না।
একটু ভেবে দেখ! আসমান যমিন সৃষ্টি থেকে যে বিপুল পরিমাণ ব্যয় করেছেন এতে তার হাত একটুও খালি হয় নি। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৯৯) মহানবি সা. আরো বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, হে আদম সন্তানেরা! তোমরা অকাতরে দান করতে থাক। আমিও তোমাদের ওপর ব্যয় করব। মহানবি সা. আরো বলেন, আল্লাহর ডান হাত প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। রাতদিন অনবরত দান করলেও তা মোটেই কমছে না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৯৮)
যাকাত ব্যয়ের খাত
ইসলাম কর্তৃক যাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারিত রয়েছে। তাই নির্ধারিত খাতেই যাকাত আদায় করতে হবে। নির্দিষ্ট খাতের বাইরে যাকাত ব্যয় করলে তা আদায় হবে না। মহাগ্রন্থ আলকুরআনে যাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে বলা হয়েছে : ‘যাকাত হল কেবল ফকির, মিসকিন, যাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। (সুরা তওবা, আয়াত : ৬০) অতএব, কুরআন শরিফে বর্ণিত উক্ত নির্ধারিত খাতেই যাকাত আদায় করতে হবে। রাস্তা, ঘাট, পুল নির্মাণ, ইসলামি টিভি বা দল পরিচালনার জন্য কিংবা নির্দিষ্ট খাতের বাইরে অন্য কোনো কল্যাণমূলক কাজে যাকাত ব্যয় করা হলে তা শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে না।
যাদের ওপর যাকাত দেওয়া ফরয
সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ (৭.৫০) বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা (৫২.৫০) হলো যাকাতের নেসাব। যদি কোনো ব্যক্তি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা কিংবা এর সমমূল্যের মালিক হয়, এই সম্পত্তি তার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়, তার ওপর পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হয়, সে ঋণমুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে সুস্থমস্তিষ্ক, মুসলমান, প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন হয়, তা হলে তার ওপর যাকাত প্রদান করা ফরয। (আদ্দুররুল মুখতার, ২/২৫৯) এর দ্বারা বুঝা গেল, অমুসলিম, পাগল, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক/বালিকা ও পরাধীন দাস-দাসীদের ওপর যাকাত দেওয়া ফরয নয়।
যাকাত না দেওয়ার পরিণাম
যারা আল্লাহর পথে খরচ না করে সম্পদ ও স্বর্ণরূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আর যারা স্বর্ণ ও রোপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন! সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে! (সেদিন বলা হবে) এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর সঞ্চয় করে রাখার।’ (সূরা তওবা, আয়াত : ৩৪, ৩৫) হাদিস শরিফেও যাকাত না দেবার দরুন ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
সহিহ বুখারি শরিফে এসেছে : হযরত আবু হুরায়ররা রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সা. বলেছেন, যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ দান করেছেন কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করে নি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পার্শ্ব কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চিত মাল।
অতঃপর আল্লাহর রাসুল সা. তেলাওয়াত করেছেন, আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং তাদের জন্য তা অকল্যাণকর হবে। অচিরেই কিয়ামত দিবসে, যা নিয়ে কার্পণ্য করেছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে! (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪০৩)
উপসংহার
যাকাত আদায়ের মাধ্যমে পরকালীন জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত থাকা যায়। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়। তা ছাড়া যাকাত আদায়ের মাধ্যমে হৃদয়ের সংকোচন ও কৃপণতা থেকে মুক্ত থাকা যায়। সঙ্গে সঙ্গে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে হৃদ্যতা ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলা সম্ভব হয়। সম্পদের একচেটিয়া সুবিধাভোগ ধনৈশ্বর্যকে বিশেষ বলয় ও সবিশেষ শ্রেণির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে! বিত্তশালীকে আরো বিত্তশালী করে এবং দরিদ্রকে করে আরো হত দরিদ্র! এই দুঃখজনক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার অনন্য উপায় হলো যাকাত। তাই নেসাবের অধিকারী সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিমকে যাকাত আদায়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও যত্নশীল হতে হবে।
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, পোস্তা, চকবাজার, ঢাকা-১২১২
-এটি