আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: মানুষের চিন্তা ও যুক্তি বিস্তারের অনন্য ধারা হলো গণিত। একে সব বিজ্ঞানের প্রবেশদ্বার ও চাবিকাঠিও বলা হয়। কেউ কেউ আবার একে ‘বিজ্ঞানের মা’ আখ্যা দিয়ে থাকেন।
মানুষের প্রয়োজনে এই শাস্ত্রের চর্চা আদি যুগ থেকেই শুরু হয়েছিল। নিয়মতান্ত্রিকভাবেই এই শাস্ত্রচর্চার আদিভূমি হিসেবে মেসোপটেমিয়া, মিসর, চীন ও ভারতবর্ষকে চিহ্নিত করা হয়।
ইসলামে গণিতশাস্ত্রের গুরুত্ব: মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই শাস্ত্র তাদের ধর্মীয় আচার পালনেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন—ইসলামের বিভিন্ন বিধান নির্দিষ্ট সময়/তারিখের সঙ্গে জড়িত।
সে ইবাদত পালন করতে মুসলিমদের সে সময়/তারিখের হিসাব রাখতে হয়। এ ছাড়া মুসলিম নারীদের তালাক, ইদ্দত, মাসিক, কাফিরদের শাস্তি, বেচা-কেনা, উত্তরাাধিকার আইন, রমজান, জাকাত-ফিতরা, বিচার-আচারসহ বহু বিধানে গণনা ও হিসাবের ওপর নির্ভরশীল। পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ, সায়ী, শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ ইত্যাদি ইবাদত পালনেও গণনার প্রয়োজন হয়।
তাই মুসলিম বিজ্ঞানীরাও এই শাস্ত্রের সংরক্ষণ ও বিকাশে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা এই শাস্ত্রের পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের পাশাপাশি এ শাস্ত্রের বিকাশে নতুন নতুন গবেষণা পৃথিবীর সামনে আনতে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। নিম্নে এমন কয়েকজন মুসলিম বিজ্ঞানীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো—
আবু ইসহাক আল ফাজারি: একজন বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ। তিনিই সর্বপ্রথম ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে মুসলিম বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
তিনিই সর্বপ্রথম মুসলমানদের মধ্যে সমুদ্রে সূর্য ও নক্ষত্রসমূহের উচ্চতা নির্ণায়ক যন্ত্র অ্যাস্ট্রোল্যাব তৈরি করে এবং অঙ্ক শাস্ত্রের অন্যান্য যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে পুস্তক প্রণয়ন করেন। তিনিই নাকি সর্বপ্রথম আরব গণনা পদ্ধতি সুনিয়ন্ত্রিত করে আরব বর্ষগণনা ও দিনপঞ্জি প্রণয়ন করেন। ভারতের তৎকালীন বিজ্ঞানী কঙ্কায়ন বা মঙ্ককে ‘সিন্দহিন্দ’ নামক গ্রন্থসহ তিনি মনসুরের দরবারে আনয়ন করেন। ফাজারি ৭৭৭ খৃ. মৃত্যুবরণ করেন।
আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম: তিনি আল ফাজারির ছেলে। তিনি ‘সিন্দহিন্দ’ নামক গ্রন্থটি খলিফার আদেশে ৭৭২/৭৩ খ্রিস্টাবের দিকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। তাঁর অনুবাদের ওপর ভিত্তি করেই আল খারেজমি তাঁর বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞান তালিকা অ্যাস্ট্রনমিকাল টেবিল ‘ফি-জিজ’ প্রণয়ন করেন।
আবু ইয়াহিয়া আল বাতরিক: গ্রিক বিজ্ঞানী টলেমির ‘টেরাবিব্লস’ গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন।
হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ: খলিফা হারুনুর রশীদের রাজত্বকালে ইউক্লিড জ্যামিতির প্রথম ৬ খণ্ড আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। মামুনের রাজত্বকাল (৮১৩-৮৩৩) এ কাজ সমাপ্ত হয়। প্রসঙ্গত গণিত শাস্ত্রের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হাত ধরেই বিশুদ্ধ গণিতচর্চায় মুসলিমরা এগিয়ে আসেন। মুসলিম গণিতজ্ঞদের মধ্যে প্রায় সবাই জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন এবং এ বিষয়ে তাদের অনেকগুলো রচনাও রয়েছে। আল মামুনের আমলে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় অনেক উন্নতি অর্জিত হয়।
আল খারজেমি: তিনি খলিফা মামুনের লাইব্রেরির প্রধান লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। গণিতের প্রায় প্রত্যেকটি শাখায় খারজেমির অবদান রয়েছে। বীজগণিত ছিল তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি।
জ্যোতির্বিজ্ঞানসংক্রান্ত তাঁর একাধিক গ্রন্থ রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উচ্চতা পরিমাপক যন্ত্র, খগোল তালিকা, ডায়াল প্রভৃতি প্রস্তুতকরণে তাঁর অদ্ভুত ক্ষমতার পরিচয় মেলে। তাঁর গণিতবিষয়ক গ্রন্থ কিতাবুল হিন্দ, আর জাম ওয়াত তাফরিক এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে ইউরোপীয় ভাষায় এগুলো বহুবার অনূদিত হয়েছিল।
দশম শতাব্দীতে ইউসুফ প্রণীত মাফাতিহুল উলুম বা বিজ্ঞানী কুঞ্জি গ্রন্থের তথ্যমতে গণিত বিদ্যায় শূন্যের ব্যবহার আল খারেজমির সময় থেকেই চলে আসছে, যা ছিল আরব বিজ্ঞানীদের অন্যতম আবিষ্কার।
আল খারেজমির লেখা ‘এলমুল জাবের ওয়াল মুকাবেলা’কে বীজ গণিতের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ বিবেচনা করা হয়। এই গ্রন্থের নাম ‘আল জাবের’-এর ইউরোপীয় অনুবাদ থেকে ‘এলজেবরা’ নামের উৎপত্তি হয়।
আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইসা আল মাহানি: আল খারিজমির পর তাঁকে বিখ্যাত গণিতবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর্কিমিডিসের প্রবর্তিত গোলক (Sphere) সম্পর্কিত গবেষণা তাঁর অমরত্বের জন্য যথেষ্ট ছিল। গোলককে খণ্ড খণ্ড বিভক্ত করা নিয়ে যে পদ্ধতি ও প্রথার প্রচলন তিনি করেন, তা অভিনবত্বের দাবিদার।
তিনি একজন দক্ষ জ্যোতির্বিজ্ঞানীও ছিলেন। গোলক বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে যে বীজগাণিতিক ত্রৈমাত্রিক সমীকরণের উদ্ভব হয়, তিনি তার সমাধানে ত্রিকোণমিতির চিহ্ন, ত্রিমাত্রিক কোণের সাইন ব্যবহার করেন। তিনি কনিকের সাহায্যে ত্রৈমাত্রিক সমীকরণ সমাধানের চেষ্টা করেন।
আবুল হাসান সাবেত ইবনে কোরা: মেসোপটেমিয়ার হাররানে জন্মগ্রহণ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসেবে প্রথিতযশা হলেও দর্শন ও গণিতে তাঁর অবদান রয়েছে। বিশেষ করে জ্যামিতিতে তাঁর অপূর্ব প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে আরবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্যামিতিক অভিহিত করা হয়।
আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল মারওয়াজি: তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত ও ত্রিকোণমিতি নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। গণিতে তাঁর বিশেষ পাণ্ডিত্যের জন্য আরব স্কলাররা তাঁকে ‘হাবাশ আল হাসিব’ নামে অভিহিত করতেন।
আবুল আল বাত্তানি আস সাবি: তিনি ছিলেন তৎকালীন গণিত ও ত্রিকোণমিতির সম্রাট। তাঁকে কেউ কেউ মুসলিম টলেমি উপাধি দিয়েছিল। টলেমির চেয়ে তাঁর প্রতিভা কোনো অংশেই কম ছিল না; বরং সঠিক গণনা, নির্ভুল পরিমাপ ইত্যাদির দিক দিয়ে দেখতে গেলে অনেক সময় উচ্চস্তরের বলে মনে হতো অনেক ইউরোপীয় দার্শনিকের কাছেও। টলেমির অনেকগুলো মতবাদকে তিনি ভ্রান্ত প্রমাণ করেন।
আবু কামিল আল মিসরি: মুসলিম গণিতবিদদের অন্যতম প্রতিভা। জ্যামিতি, গণিত, বীজগণিত প্রত্যেক বিষয়ে তাঁর মৌলিক চিন্তাধারার স্বাক্ষর রয়েছে। জ্যামিতিক প্রতিপাদ্য ও উপপাদ্যের সমাধানে সমীকরণের প্রয়োগ তাঁর নিজস্ব।
শুদ্ধ অঙ্ক ও বীজগণিতের ওপর তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বর্তমান ভগ্নাংশ লিখন প্রণালীর যে ব্যবহার, তা তিনিই আভিষ্কার করেন। বীজগণিতের দ্বিমাত্রা সমীকরণের উভয় প্রকার সমাধানের ব্যবহার তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। সূত্র: বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান
-এটি