হাফেয মাওলানা শুআইব মাহদী: মহান রাব্বুল আলামীন দ্বীন শিক্ষাকে প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরজ করে দিয়েছেন। মানুষ সৃষ্টির সেরা, শরীয়তের ভাষায় আশরাফুল মাখলুকাত যার উপাধি অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুকের খেতাবে ভূষিত এ মানব সম্প্রদায়। যাদের উপর মহান আল্লাহ তা'আলা তাঁর বন্দেগী আবশ্যক করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ.
অর্থঃ আর আমি জিন ও মানবজাতিকে কেবল আমার ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। (সূরা যারিয়াত ৫৬)
এই বন্দেগী পালনে মহান রবের পক্ষ থেকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই আদিষ্ট। আর আমরা জানি, ইবাদাত পূর্ণভাবে আদায়ের জন্য ইলমে দ্বীনের শিক্ষা অপরিহার্য। (যেটুকু না শিখলে ফরজ ইবাদাত পালন করা সম্ভব নয়।) যেহেতু ইবাদাতের ব্যাপারে নারী-পুরুষ উভয়ে আদিষ্ট, সেহেতু বিদ্যার্জনের জন্য এ দুয়ের রয়েছে সমান অশগ্রহণের শরীয়ত সম্মত সুযোগ।
প্রিয় পাঠক। আজ আমরা ইসলামে নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও নারীর দ্বীনি জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনীয়তা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কিঞ্চিৎ আলোকপাতের চেষ্টা করবো। ইনশাআল্লাহ।
ইসলামে নারী শিক্ষার গুরুত্ব:
ইসলাম নারী শিক্ষার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে,এ বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহের বহু স্থানে উল্লেখ হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা
ইরশাদ করছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ...
অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং আপন পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও (সূরা-তাহরীম-৬)
উক্ত আয়াতে কারীমায় মহান রাব্বুল আলামীন পরিবারবর্গকে (মা-বোন ও সন্তান) কেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর কথা বলেছেন। আর বন্দেগীর জন্য ইলমে দ্বীনের শিক্ষা অপরিহার্য। স্পষ্টতই নারীর দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম । কুরআনও যার ব্যাপারে অভিভাবকদের আদেশ করেছে। অনুরূপভাবে হাদিসের বহু স্থানে নারী শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে-
عن الشفاء بنت عبد الله قالت: دخل على رسول الله صلى الله عليه وسلم وانا عند حفصة فقال لي: ألا تعلمين هذه رقية النملة كما علمتيها الكتابة-
অর্থ: শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার নবীজী সা. আমার কাছে আসলেন, আর আমি তখন হাফসা রা. এর নিকটে ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, তুমি তাকে যেভাবে লিপিবিদ্যা শিখিয়েছো সেভাবে খুঁজলি-পাচড়ার চিকিৎসার পদ্ধতিও কেন শিখিয়ে দিচ্ছো না? (আবু দাউদ-৩৮৮৭) উক্ত হাদিসে হযরত শিফাকে লক্ষ্য করে নবীজীর উক্তি “ কেন শিখাচ্ছো না ” থেকেই তাঁর গুরুত্ব প্রদানের বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। যিনি আল্লাহর রাসূল, তার সাধারণ কথাটা ভিন্নভাবে ব্যক্ত করা নারী শিক্ষার সর্বোচ্চ গুরুত্বের প্রমাণ বহন করে। এ থেকে মহিলাদের লিপিবিদ্যায় দক্ষতা অর্জনের গুরুত্ব বুঝা যায়।
ইমাম শামছুল হক আযীমাবাদী রহ. নারীর লিপিবিদ্যার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে - عقود الجمان في جواز الكتابة للنسوان নামক বিরাট একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যা মাসআলাটির প্রয়োজনীয়তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে। শুধু নববী তারগীব নয় বরং মহিলা সাহাবিয়াদের ইলম অর্জনের যে অফুরন্ত জযবা ছিল তাও পরিষ্কার হয় নিচের বর্ণনাটির মাধ্যমে; আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, সাহাবিয়াগণ দরবারে নববীতে পয়গাম পাঠালেন যে, আপনি পুরুষদেরকে দ্বীন শিখাচ্ছেন, আমরা নারীরাও ইলম অর্জনে আগ্রহী। তাঁদের শিখার আগ্রহ দেখে নবীজী (সা:) বাঁধা দেয়া তো দূরে থাক, সানন্দে রাজী হয়ে ওদের বাহবা দিয়ে বললেন, “তোমাদের পাঠদান হবে অমুক মহিলার ঘরে”। আর তিনি সেখানে মহিলা সাহবীদেরকে দ্বীনি ও জরুরী মহিলা বিষয়ক হুকুম-আহকাম শিখিয়েছেন।
অপর এক হাদিসে প্রিয়নবী সা. ইরশাদ করেন -
ثلاثة لهم اجران.... ورجل كانت عنده أمة فادبها فاحسن تاديبها وعلمها فاحسن تعليمها ثم اعتقهافتزوجها فله اجران
অর্থ : তিনি ব্যক্তির জন্য দিগুন সওয়াব রয়েছে। তন্মধ্যে একজন এমন ব্যক্তি যার নিকট একজন দাসী আছে। (যার সাথে সে মিলিত হয়।) সে তাকে সুন্দরভাবে আদব-কায়দা শিখিয়েছে, ভালোভাবে দ্বীনি তা'লীম দিয়েছে। এবার তাকে মুক্ত করে বিয়ে করে নিয়েছে। তার জন্য দু'টি প্রতিদান রয়েছে।
জ্ঞাতব্য বিষয় হলো, ইমাম বুখারী রহ, তার প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনাম চয়নে যথেষ্ট বুৎপত্তি ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। অনেক মুহাদ্দিসের মতে ইমাম বুখারীর ফিকহ্ তাঁর অধ্যায়ের শিরোনামে লুকায়িত রয়েছে। এ হাদিস তিনি যে অধ্যায়ে এনেছেন তার শিরোনাম দিয়েছেন এভাবে - باب تعلم الرجل امته واهله অর্থ: এ অধ্যায়ে ঐ ব্যক্তির বর্ণনা হবে যে তার স্ত্রী-পরিজন ও বাঁদীকে ইলম শিখায়। আমরা হাদিসের অনুবাদে শুধু বাদীর উল্লেখ দেখেছি, তাহলে পরিবারের উল্লেখ করে বুখারী রহু কিভাবে তাঁর ফিকহ প্রকাশ করলেন? এর উত্তরে আমি বুখারী শরীফের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীর উদ্ধৃতি পেশ করছি। ان مطابقة الحديث للترجمة في الأمة بالنص وفي الأهل بالقياس ان الاعتناء بالأهل الحرائر في تعليم فرائض الله وسنن رسوله اكد من الاعتناء بالاماء অর্থ : ইবনে হাজার রহ. বলেন, বুখারীর শিরোনামের সাথে হাদিসের মিল এদিক থেকে যে, বাদীর উল্লেখ হাদিসে এসেছে এবং এর উপর ভিত্তি করে স্বাধীনা নারীর আল্লাহর বিধান ও রাসূলের সুন্নাতের শিক্ষা অর্জন বাঁদী অপেক্ষা অতি জরুরী। অর্থাৎ নবীজীর বাঁদীর ক্ষেত্রে গুরুত্ব প্রদান নিঃসন্দেহে তার উপরস্থ বাকী সব নারী উম্মতকে এতে শামিল করে নেয় এবং এজন্য ইমাম বুখারী রহ. অধ্যায়ের শিরোনামে সমস্ত নারী জাতির উল্লেখ করে দেন।
প্রিয় পাঠক! এই হাদিসের যে ব্যাখ্যা ফাতহুল বারী গ্রন্থে লিখিত তা থেকে আমাদের দু'টো শিরোনামের জন্য খোরাক রয়েছে।
প্রথমত: হাদিস থেকে নারী শিক্ষার গুরুত্ব এভাবে বুঝে আসে যে, নবীজী সা. বাদীকে শিক্ষা দিয়ে তাকে আযাদ করে স্ত্রী বানিয়ে নেয়াতে দু'টো প্রতিদানের ঘোষণা দেন। ১. তাকে শিক্ষা দেয়াতে ২. তাকে আযাদ করে স্ব-স্ত্রীত্বে বরণ করাতে। বাঁদীকে আযাদ ও তাকে স্ত্রী বানানো অনেক বড় ধৈর্য্য ও সামাজিক পরিক্ষার ব্যাপার ছিল তৎকালীন সময়ে। অথচ এ শক্ত কাজের বিনিময়ে একটি প্রতিদান এবং শুধু নারীর শিক্ষার বিনিময়ে সম্পূর্ণ এক বিনিময় প্রদানের ঘোষণা করা নারীর শিক্ষার গুরুত্বারোপ বৈ কিছুই না।
প্রশ্ন আসে যে, পবিত্র কোরআনে ولهن مثل اللذي عليهن بالمعروف অর্থ : আর স্ত্রীদেরও ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে যেমন তাদের প্রতি পুরুষের রয়েছে।
এবং প্রসিদ্ধ হাদিস - النساء شقاءق الرجال অর্থ : নারীরা পুরুষের অনুরূপ । (তিরমিযী, হাদিস: ১১৩, ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৬১২) ইত্যাদির থেকে নারী-পুরুষের শিক্ষার ক্ষেত্রে সমান অধিকারের কথা স্পষ্ট বুঝে আসা সত্ত্বেও হাদিসে বিশেষভাবে নারী শিক্ষার উল্লেখের প্রয়োজনীয়তা কেন পড়লো? যদি এই হাদিস সমূহ না বলা হতো তবুও তো নারীর ক্ষেত্রে পুরুষের ন্যায় শিক্ষিতা হওয়ায় ধর্মীয় বাধা ছিল না। হ্যাঁ সহশিক্ষা, শরীয়ত বিরোধী পরিবেশ, নারীর সুরক্ষার শতভাগ সুবিধা না থাকায় এবং বিশেষত জাগতিক বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রী বৈষম্যতার দরুণ বর্তমান ফিৎনার যুগে ইসলামী শরীয়ত সম্মত পন্থায় নারী শিক্ষায় বৈধতা দেয় এটা ভিন্ন কথা। এসব সমস্যা না থাকলে নারীর শিক্ষার উপর ধর্মীয় কোন বাধা-নিষেধ নেই। তবুও নবীজী সা. বিশেষভাবে তাকীদ করা এজন্য যে, তিনি হাদিস পাকে ইরশাদ করেন- اوتيت علم الاولين والاخرين অর্থ: “ আমাকে পূর্বাপর সকলের জ্ঞান দেয়া হয়েছে।"
এর আলোকে স্বীয় ঐশী দূরদর্শিতার বলে তিনি বুঝেছিলেন, সুদূর ভবিষ্যতে নারী শিক্ষার গুরুত্ব লোপ পাবে আর এ মহান অধিকার থেকে হয়তোবা তারা বঞ্চিত হবে, তাই তিনি তাদের কথা স্পষ্টত: উল্লেখ করে দিয়েছেন। নারী হলো শিশুর প্রথম বিদ্যালয় । বাচ্চা শৈশবের পুরো সময়টাই মায়ের সাথে কাঁটায়। এসময় মায়ের থেকে দেখে সে যা শিখে তা তার কচিমনে পাথরের উপর খোদাই করা লিপির ন্যায় বদ্ধমূল হয়ে যায়। প্রত্যেক শিশুর শিক্ষার সূচনা তাই হয়, যা সে তার মায়ের কাছে থেকে শিখে। অতএব মা যদি নিজে শিক্ষিতা না হয়, ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করার জন্য ভালো-মন্দের পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকে, তখন উপযোগী ও কাঙ্খিত তারবিয়াত না পাওয়ায় যে শূণ্যতা বাচ্চার জীবনে সৃষ্টি হয় তা অদূরণীয়। স্কুলে যেসব মিশ্র নৈতিকতার শিক্ষা সে মনে ধারণ করে তা তার অন্তরে বদ্ধমূল হতে যথেষ্ট সময় নেয়। অনেক বিষয়ের মধ্যে একটি ইসলাম শিক্ষা যা নৈতিকাতার পরিচায়ক, এটা তখন সে দীক্ষা হিসেবে নয়, পরিক্ষায় পাশের জন্য পড়া-শুনা করে। যে শিক্ষা ছোটকালে তার নিকট মুখ্য থাকার কথা, তা পরিক্ষার বিষয় হিসেবে আয়ত্ব করে সে, কাজেই মায়ের শিক্ষিত হওয়াটা অত্যন্ত জরুরী, যেন সন্তানের সুষ্ঠভাবে বেড়ে উঠতে তার অবদান প্রকাশিত হয় এবং সন্তান সুনাগরিক হয়ে দেশ-সমাজের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে।
এখন প্রশ্ন হলো, শিশুর নৈতিকতার পূর্ণ বিকাশে মায়ের জাগতিক বিদ্যার প্রয়োজন হবে নাকি দ্বীন শরীয়তের শিক্ষা যা মানুষের জীবন সুগঠনের কথা বলে, শিখায় ও প্রচার করে। এখান থেকে আমাদের দ্বিতীয় আলোচনা:
নারীর ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা:
এ ব্যাপারে কুরআন-হাদিস আমাদের কি বলে?
উত্তরে পূর্বোল্লিখিত হাদীস - ثلاثة لهم) اجران.....) যাতে নারীর শিক্ষার তাকীদ করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা তালাশ করা যাক । ফতহুলবারী গ্রন্থে যার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বুখারী শরীফের যে ঋণ উম্মতের উপর ছিল তা তার এই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা গ্রন্থ দ্বারা পুরো হয়ে গিয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে- আল্লাহর ফরজ বিধান ও রাসূলের সুন্নাত বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন। আর হাদিসে উল্লেখিত নারীশিক্ষা দ্বারা আমাদের সালফে সালেহীন (সাহাবা, তাবেয়ীন ও তৎপরবর্তী দ্বীনি মুরব্বিগণ) দ্বীনী শিক্ষাই বুঝেছেন। আমি একথা বলছি না যে, নারী সমস্তেরই মহিলা মাদরাসায় পড়া উচিৎ বরং দ্বীনি শিক্ষার দু'টি স্তর রয়েছে। মৌলিক বিষয়ে জ্ঞানার্জন এবং পরিপূর্ণভাবে দ্বীনি ইলমের বুৎপত্তি অর্জন। প্রথমস্তর যেমন প্রত্যেক নারীর উপর ফরজ তেমনি দ্বিতীয় স্তরও ফরজে কেফায়া । অথ্যাৎ, উম্মতের বিশেষ এক নারী সম্প্রদায় যদি দ্বীনি ইলমে বুৎপত্তি অর্জন না করেন, নারীদের দৈনন্দিন হাজারো মাসআলা নিরসনে সময় ও পরিশ্রম ব্যয় না করেন, তাহলে প্রতিটি নারী উম্মত গুনাহগার হবে।
একটি ছোট দৃষ্টান্ত দেখা যাক যে, শিক্ষার্থী ক্লাসের সব বিষয়ের মৌলিক তথ্য গুলো Explain ছাড়া শুধু আয়ত্ব করে আসে সে পরিক্ষার হলে বিস্তারিত উত্তর লিখতে পারে না, ফলে তার নম্বরও মৌলিক তথ্যের উপর আসে। ব্যাখ্যা না করায় দেখা যায় সে ১০০ তে ৪০/৫০ নম্বর পায়। পক্ষান্তরে যে ছাত্রীটি প্রতিটি বিষেয়ে ব্যাখ্যা সহকারে আয়ত্ব করে পরিক্ষা দেয় সে পুরো ১০০ নম্বরের উত্তর দেয় এবং সে অনুযায়ী নম্বর পায়। কোন বিষয়ের মৌলিক তথ্য দুজনেই জানে তবে দ্বিতীয়জন পূর্ণরূপে জানে যদ্দরুন বোর্ড থেকে পরিদর্শক মহোদয় এলে সে সবার প্রতিনিধিত্ব করে এবং প্রতিষ্ঠানের মান বাঁচায়। এখন যদি অন্যরা বলে যে, এতো বিস্তারিত জেনে লাভ কি? মৌলিক শিক্ষা অর্জন হলেই তো যথেষ্ট। তাহলে অন্যরা অবশ্যই ভুল পথেই কেবল নয় বরং সারা জীবন ঐ বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞানের প্রয়োজনে উক্ত ভাল ছাত্রীর দারস্থ ও তার কাছে ঋণী হয়ে থাকবে। আর দ্বীনি শিক্ষার দু'টি স্তরও অনুরূপ। দ্বিতীয়টি ছাড়া প্রথমটির (যা সীমীত) অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হওয়া অবধারিত। তাই দ্বিতীয়টির সুষ্ঠু পরিচর্যা একান্ত কাম্য। আর কওমী মাদরাসামূহ-ই সেই খেদমত সফলভাবে পরিচালনা করে আসছে।। যারা দ্বীনি ইলমে গভীরতা অর্জনের জন্য দ্বীনকে আল্লাহর যমীনে টিকিয়ে রাখার জন্য এ মহান ফরয কোন পার্থিব পদমর্যাদার সম্মান ও আর্থিক সম্মানের লোভ ছাড়াই মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য শিখে যাচ্ছে এবং সমাজ সংস্কারে নারীর নৈতিক আদর্শকে সমুন্নত রাখার প্রয়াসে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে , হাজারো সালাম সেসব নক্ষত্রসম মানবদের তরে।
প্রবন্ধের পরিশিষ্টে ইলমে ওহীর হক নিয়ে কিছু বলাটা দ্বীনি দায়িত্ব মনে করছি। আমাদের যারা ইলমে দ্বীন শিখছেন এই ইলমের কি হক এদের উপর বর্তায় এবং এই হক আদায় না করলে কি পরিণতি আমাদের বরণ করতে হবে?
ইলমে ওহীর হক সম্পর্কে সূরা মায়েদায় আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন - يا ايها الرسول بلغ ما انزل اليك من ربك و إن لم تفعل فما بلغت رسالته অর্থ-আপনার নিকটে আপনার রব যা অবতীর্ণ করেছেন তার প্রচার করুন। যদি তা না করেন তবে যেন আপনি রিসালাতের দায়িত্বই পৌঁছান নি। সূরা আর-রহমানে ইরশাদ হচ্ছে- علم القرآن অর্থ: তিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। প্রথমোক্ত আয়াতে " যা অবতীর্ণ করা হয়েছে " তা ছিল কুরআন, ওহী এমন ইলম যা সরাসরি শিক্ষক মহান রাব্বুল আলামীন থেকে নবীজি (স:) পেয়েছেন। মহান রব এই ওহী অবতীর্ণের সাথে সাথে তার যিম্মাদারী বা হক সম্পর্কেও রাসুলকে জানিয়ে দিয়েছেন এবং সম্বোধন করেছেন এভাবে- “ যা অবতীর্ণ করা হয়েছে আপনি তার প্রচার করুন।" অর্থাৎ ইলমের প্রচার-প্রসার ও শিক্ষা দেয়া, এটা এর অন্যতম হক। এ সম্পর্কে নবীজি সা: ও বিভিন্ন হাদীসে ইরশাদ করেছেন- যেমন তিনি বলেন-بلغوا عني و لو اية " আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও পৌঁছিয়ে দাও।
অন্য এক হাদীসে এসেছে-تعلموا العلم والفراءض و علموه الناس فاني مقبوض “তোমরা ইলম ও ফারায়েযের জ্ঞান শিক্ষা কর এবং লোকদেরকে তা শিক্ষা দাও, কেননা আমাকে তুলে নেয়া হবে।"
আর আমরা তাঁর উম্মতের নির্বাচিত অংশ যারা নায়েবে রাসূল ও নবীর ওয়ারিশ " সম্মানজনক খেতাবে ভূষিত। আমাদের উপরেও ইলমে ওহী শিক্ষার এই হক্ব তথা প্রচার প্রসার এর দায়িত্ব বর্তাবে। উম্মত গোমরাহ হচ্ছে আর আমাদের হক্ব আমাদেরকে আহ্বান করছে। আমরা ইলমের প্রচার-প্রসারে অংশ নিয়ে দ্বীনি ইলমের এই হক্বকে আদায় করতে সচেষ্ট হই। দ্বিতীয় অবশ্যপালনীয় হক্ব হলো, নিজ ইলম অনুযায়ী আমল করা। এ হক্বের ব্যাপারে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে।যেমন, রাসূল সা. ইরশাদ করেন- من علم بما علم ورثه الله تعالى علم ما لم يعلم - دلاءل النبوة للامام بيهقي “যে ব্যক্তি ইলম অনুযায়ী আমল করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে অজানা বিষয়ের ইলম দান করবেন।
অন্য হাদীসে এসেছে - ان مما يلحق المؤمن من عمله و حسناته بعد موته علما علمه و نشره "যেসব আমলের সওয়াব মুমিনের মৃত্যুর পরও সে পেতে থাকে, তার মধ্যে একটি হলো ঐ ইলম- যা সে শিখেছে এবং প্রচার করেছে।
আমরা নিজেদের দিকে একটু দেখি, আমরা পূর্ণরূপে দ্বীনের উপর চলতে পারছিতো? মাদরাসা থেকে বোরকা পড়ে বাসায় যাচ্ছি, সেখানে আমার চালচলন ঠিক আছে তো? যেহেতু ইলমে ওহী আমার সীনায়, উম্মত যেন আমাকে দেখে নিরাশ না হয়। ইলমে দ্বীন থেকে ওদের ভরসা যেন না ওঠে যায়। উপরন্তু বেপর্দা নারীরা পর্দানশীন হতে পারে এবং বেহায়াপনা লোপ পায়। এখন আমি যদি মাহরাম ছাড়া প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঘনঘন বাইরে ঘোরাফেরা করি, কন্ঠের পর্দা ভুলে গিয়ে উচ্চম্বরে জিনিসের দরদাম করতে থাকি, তাহলে ইলমে ওহীর যে হক্ব আমার উপর রয়েছে তার অপমান করলাম। মূলত: কথার দাওয়াত থেকে নিশ্চুপ দাওয়াত বেশি কার্যকরী। অতএব এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবার দরকার যে, এই হক্ব আমাদের দ্বারা আদায় না হলে কি হবে? প্রথমত: আল্লাহর আদেশের সুস্পষ্ট নাফরমানী হবে। যেখানে সূরা মায়েদাতে স্বয়ং নবীজিকে সাবধান করা হয়েছে তার হক্ব সম্পর্কে যে, “যদি কুরআনের তাবলীগ না করেন, তবে যেন রিসালাতের দ্বায়িত্বই আপনি পৌঁছান নি।" সেখানে আমরা কোন ছাড় পাব? উপরন্ত নবীজি সা. তাঁর দায়িত্ব পূর্ণ করে গেছেন । যার প্রমাণ হলো তিনি বিদায় হজ্জের ভাষণে সোয়া লক্ষ সাহাবায়ে কেরামের সম্মুখে বলেছিলেন- اللهم اشهد এটাই জ্বলন্ত প্রমাণ।
বাকী রইল নবীর নায়েবগণ, তাঁদের জন্য এই সতর্কবাণী প্রত্যেকের উপর তার দায়িত্ব পূর্ণ না করা পর্যন্ত বহাল
থাকবে।
এবার দ্বিতীয় হক্ব সম্পর্কেও সচেতন থাকা চাই। তথা ইলম অনুযায়ী আমল করা যার ব্যাপারে উদাসীনদের সম্পর্কে ভয়ংকর সব ধমকি এসেছে। এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে- কতক জান্নাতী নিজেদের ধর্মীয় গুরুদেরকে দোযখে দেখে আশ্চর্য হলে, তারা তাদের সংশয় এ বলে দূর করবে যে, “আমরা অন্যদেরকে আমল করতে বলতাম কিন্তু নিজেরা আমল করতাম না।"
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে - ان من اشر الناس عند الله منزلة يوم القيامة عالم لم ينتفع بعلمه “সেই আলেম কেয়ামতের দিন সবচেয়ে মন্দ বলে বিবেচিত হবে, যে নিজ ইলম দ্বারা উপকৃত হয়নি। অপর এক হাদীসে এসেছে- কেয়ামতের দিন ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের উভয় পা নিজস্থান থেকে সরবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। তন্মধ্যে একটি হলো ইলম সম্পর্কে।
ومن علمه فيما عمل
" নিজের ইলমের উপর কি আমল করেছো?" অতএব, মুমিন মাত্রই এসব ধর্মকির প্রতি যথাযথ সজাগ থাকা চাই। আর আমরা যেহেতু ইলমে ওহীর ধারক-বাহক, উম্মাহর ঐ সকল মহীয়সী রমণীদের উত্তরসূরী, যারা স্বীয় ইলমের হক আমল ও প্রচারের মাধ্যমে আদায় করে ইতিহাসে চির স্মরণীয় ও সম্মানিত হয়ে রয়েছেন। আল্লাহ আমাদের ইলমের হক্ব বুঝে তা যথাযথভাবে আদায়ের তাওফিক দান করুন।
টিএ/