একজন শিক্ষকের প্রথম কাজ আত্মগঠন ও ব্যক্তিত্বের বিনির্মাণ। এ কাজটি ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের সামনে জীবনের এমন এক উদ্দেশ্য না থাকবে, যার জন্য সে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিবেদিত। এমনই একজন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষক মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন। লিখেছেন আওয়ার ইসলাম সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব
শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য কোনো বিষয়ে শুধু কিছু অবগত করানো কিংবা তথ্য সরবরাহ করা নয়। বরং আমাদের ধ্যান-ধারণা, ঐতিহ্য ও সভ্যতা-সংস্কৃতির হেফাজত এবং পরবর্তী বংশধরদের কাছে তা পৌঁছে দেওয়াই শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কোনো জাতি যদি এ লক্ষ্যে সফলকাম হয় অর্থাৎ নিজস্ব আকিদা-বিশ্বাস এবং সভ্যতা-সংস্কৃতির হেফাজত করতে পারে আর তা ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়, তাহলে এ ধরাধাম থেকে ওই জাতির অস্তিত্ব কেউই মুছে ফেলতে পারে না। বরং সে সর্বদাই উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যেতে থাকে। শিক্ষক হিসেবে সে দায়িত্ব পালনে তৎপর থাকা প্রয়োজন। এমনই একজন তৎপর ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষক হলেন মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন।
তিনি একাধারে খ্যাতিমান লেখক ও গবেষক। কোরআনে কারিমের অনুবাদক ও সরল বিশ্লেষক। হাদিসে রাসুল ও কোরআনের তাফসির শাস্ত্রের শিক্ষক। তুখোড় মেধাবী। স্বল্পভাষী। চলনে বলনে সাদাসিধে। সুন্নাহভিত্তিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। চিন্তা-চেতনা ও আদর্শে দেওবন্দি। উলামায়ে দেওবন্দের ধারাভাষ্যকারও বলা চলে। বহুমাত্রিক প্রতিভাধর এই আলেম রচনা করেছেন ২৫টি মৌলিক গ্রন্থ। পাঠকপ্রিয় এই লেখকের পৈতৃকনিবাস খুলনায়। খুলনা জেলায় ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে রূপসা উপজেলার মৈশাঘুনি গ্রামে জন্ম। বাবার নাম মৌলভি বেলায়েত হোসাইন। তার বাবা মৌলভি বেলায়েত হোসাইনের দীক্ষাগুরু ছিলেন মুজাহেদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।
মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীনের পড়াশোনার হাতেখড়ি বাবার কাছে। বাবার কাছেই নিয়েছেন অ আ ক খ-এর প্রথম পাঠ। মায়ের দোলনাই জীবনের প্রথম পাঠশালা। মায়ের কাছেই নিয়েছেন সভ্যতা ভদ্রতা নীরবতা আর শালীনতার সবক।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হন খুলনা জেলার নূরুল উলুম হাফেজিয়া মাদ্রাসায়। মুখস্ত করেন ৩০ পাড়া কোরআন। মাথায় তার সম্মানের মুকুট। হাফেজে কোরআনের গৌরব লাভ করেন বালক মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন। তখন ১৯৭৬। তুখোড় মেধাবী এই বালক পড়াশোনা করেছেন খুলনার দারুল উলুম মাদ্রাসা, গওহরডাঙ্গা খাদেমুল ইসলাম মাদ্রাসা এবং রাজধানীর মালিবাগ জামেয়ায়। ১৯৮৬ সালে মালিবাগ জামেয়া থেকে দাওরায়ে হাদিসে উত্তীর্ণ হন। ১৯৮৭ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে হাদিসে রাসুলের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। দেশে এবং প্রবাসের শিক্ষা জীবনে মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীনের প্রখর মেধার জনশ্রুতি আছে। তিনি মুতাওয়াসসিতাহ (নাহবেমির) ও সানাবিয়্যাহ আল-আম্মাহ (কাফিয়া) জামাতে গওহরডাঙ্গা বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় ১ম স্থান অর্জন করেন।
রাজধানী ঢাকায় এসেও তার মেধা ও মননের পথ ভুলে যাননি তিনি। ফজিলত (মেশকাত) ও তাকমিল (দাওরায়ে হাদিস) জামাতে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক)-এর কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় ২য় স্থান অধিকার করেন। মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীনের উস্তাদ ও সহপাঠীদের মুখে মুখে সুবাসিত হয় তার মেধা ও উত্তম চরিত্রের তারিফ।
বহুমাত্রিক প্রতিভা মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন নিজেকে নির্মাণ করেছেন কালের শ্রেষ্ঠ আলেমদের কাছে। উস্তাদদের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন মোমের মতো। জ্বলেপুড়ে অঙ্গার করে নিজেকে খাঁটি করেছেন। সোনের চেয়ে দামি করেছেন। তার প্রিয় উস্তাদদের মধ্যে গওহরডাঙ্গার মাওলানা আশরাফ আলী (কলাখালী হুজুর), মালিবাগ জামিয়ার আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ (রহ.), আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.), মাওলানা আবুল ফাতাহ মু. ইয়াহইয়া (রহ.), মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক প্রমুখ। দেওবন্দে তার প্রিয় উস্তাদ মাওলানা আরশাদ মাদানী, আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.), বাহরুল উলুম আল্লামা নেয়ামতুল্লাহ আজমী (রহ.) প্রমুখ। বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ডক্টর কাজী দ্বীন মুহাম্মাদের কাছে নিয়েছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করে শুরু করেন কর্মজীবন। শিক্ষকতার পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। রাজধানী ঢাকার মালিবাগ জামেয়া, জামেয়া মাদানিয়া বারিধারা, জামেয়া মাদানিয়া রাজফুলবাড়িয়া সাভার, জামেয়া সুবহানিয়া উত্তরা ধউর এবং ইসলামিয়া মাদ্রাসা ইসলামপুর ঢাকায় সিনিয়র মুহাদ্দিস ও শায়খুল হাদিস হিসেবে বহু বছর খেদমত করেছেন। ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়ায় (যাত্রাবাড়ী বড় মাদ্রাসায়) সিনিয়র মুহাদ্দিস ও তাফসির বিভাগের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি একাধারে ২৩ বছর (১৯৮৭-২০০৯) পশ্চিম নাখালপাড়া ঢাকার বায়তুল আতীক জামে মসজিদে (ছাপড়া মসজিদে) ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। সারা দেশেই তার অসংখ্য ছাত্র-ভক্ত ছড়িয়ে আছে।
বহুমাত্রিক প্রতিভা মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন একজন আদর্শ শিক্ষক ও সুবক্তা। ইসলামি মনোবিজ্ঞান, ইসলামি ভূগোল ও মানচিত্র এবং তরজমা ও তাফসির শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। স্বপ্নের ব্যাখ্যাদানেও তার বিশেষ দক্ষতা আছে। তার পরও তিনি খ্যাতির প্রতি নিরাসক্ত। আর এটাই তার শক্তি। তার মতে, ‘যদি সত্যিকার অর্থে আপনি নিজেকে ইসলামের খেদমতের উপযোগী করে গড়তে চান, তাহলে আপনার নিজের মধ্যে এই নিরাসক্তি সৃষ্টি করতে হবে।’
বাংলা ভাষায় লেখালেখি ও গবেষণা তাকে অমরত্ব দান করেছে। পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত বেশ কিছু গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। বললে বাড়িয়ে বলা হবে না, তিনি একজন নিভৃতচারী জ্ঞানসাধক। একান্তভাবেই শিক্ষকতা, অধ্যয়ন, গবেষণা ও লেখালেখিতে মগ্ন থাকেন। বাংলা আরবি ও উর্দু এই তিন ভাষায় তার রচনা আছে। তার শতাধিক প্রবন্ধ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ইসলামি বিশ্বকোষে মর্যাদার সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে।
মৌলিক গ্রন্থাবলি রচনায়ও তার সুখ্যাতি আছে। তিনি ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সবকটি বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইমান-আকিদা বিষয়ে লিখেছেন- ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্ত্র মতবাদ, মাসায়েল বিষয়ে-আহকামে যিন্দেগী ও মহিলাদের জন্য- আহকামুন নিছা, ফিকহুন নিছা, ফাজায়েল বিষয়ে-ফাজায়েলে যিন্দেগী, মাওয়ায়েজ বিষয়ে- বয়ান ও খুতবা, ইতিহাস বিষয়ে কুরআন ও সহিহ হাদিসের বর্ণিত-ইসলামি ইতিহাস, ভূগোল ও মানচিত্র বিষয়ে -ইসলামি ভূগোল, কুরআন ও ইসলামি ইতিহাসের মানচিত্র, হজ ও উমরার মানচিত্র, বিজ্ঞান বিষয়ে ইসলামি মনোবিজ্ঞান, ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে ভাষা ও সাহিত্য প্রশিক্ষণ, জীবন গঠন বিষয়ে যদি জীবন গঠন করতে চান ইত্যাদি। তার রচিত ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ, ইসলামি মনোবিজ্ঞান, ইসলামি ভূগোল ও ফিকহুন নিছা বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিলেবাসভুক্ত। ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্ত্র মতবাদ গ্রন্থটি বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড-বেফাক অনুমোদিত ও ফজিলত (মেশকাত) জামাতের ফেরাকে বাতেলা বিষয়ক সহযোগী সিলেবাস হিসেবে মনোনীত। তার রচিত আহকামে যিন্দেগী ও ফাযায়েলে যিন্দেগী বহু মসজিদে এবং আহকামুন নিসা মহিলাদের বহু মজলিসে তালিম হয়। তার রচিত গ্রন্থাবলি উলামা ও জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজসহ সর্বস্তরের শিক্ষানুরাগীদের কাছে সমাদৃত। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৫টি। আসলে শিক্ষার ময়দানে ইসলামের জন্য একজন শিক্ষককে যে সংগ্রাম চালাতে হবে, তার গুরুত্বপূর্ণ চারটি দিক আছে। এ চারটি দিকের একটি তার ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে, দ্বিতীয়টি তার জ্ঞানের সঙ্গে যার উৎকর্ষ সাধনের জন্য সে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়, তৃতীয়টি তার শিক্ষাদান পেশার সঙ্গে এবং চতুর্থটি তার ছাত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ চারটি বিষয়ের মধ্যে যেটি শিক্ষকের নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেটাই হলো- সাধনা। যে সাধনার জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন মাওলানা হেমায়ে উদ্দীন। এখনো তিনি লিখছেন দুহাতে। আগামী দিনেও তার কর্মমুখর সময়ে উম্মাহ মূল্যবান কিছু গ্রন্থ উপহার পাবে। সুন্দর হোক তার আগামী। সমৃদ্ধ হোক পথচলা। মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ুক তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে। -লেখাটি দেশ রূপান্তর থেকে নেয়া
কেএল/