নাজমুল হাসান সাকিব: আরবি তাবলিগ শব্দের অর্থ- পৌঁছে দেওয়া। আর তাবলিগ জামাত মানে, প্রচারক দল, প্রচার সংঘ। এককথায় তাবলিগ জামাত হলো, ইসলাম ধর্মভিত্তিক সংগঠন ও ধর্মপ্রচার আন্দোলন। যার একমাত্র মূল লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা।
যা মুসলিমদেরকে সোনালি যুগের দ্বীন চর্চায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করে। বস্তুত মহান আল্লাহ বিশ্ব মানবতার কল্যাণে বিশ্ব নবি মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে যে দ্বীন প্রবর্তন করেছেন তার যথাযথ প্রচার-প্রসার করার নাম হচ্ছে তাবলিগ। আল কুরআনে এসেছে, “হে রাসূল! আপনার নিকট যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা আপনি তাবলিগ করুন। আর যদি তাবলিগ না করেন তাহলে তো আপনি রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলেন না। (সূরা আল-মায়েদা: ৬৭)।
দারুল উলূম দেওবন্দের শাখা হিসেবে ১৯২৬ সালে মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভি রহ. কর্তৃক ভারতের মেওয়াতে তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়কে অবজ্ঞা ও নৈতিক মুল্যবোধের সমসাময়িক অবক্ষয়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই জামাতের যাত্রা শুরু হয়। আন্দোলনটি তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার মাধ্যমে ইসলামের আধ্যাত্নিক পুনর্গঠনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে।
তাবলিগ জামাত-এর মূল ভিত্তি হিসেবে ৬টি উসুল বা মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো: কালিমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, একরামুল মুসলিমিন (মুসলমানদের সহায়তা করা), সহিহ নিয়ত বা এখলাসে নিয়ত (বিশুদ্ধ মনোবাঞ্ছা), এবং দাওয়াত ও তাবলিগ (ধর্মপ্রচারের আহবান)।
মূলত এই নীতির স্বপ্ন দেখতেন মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহি রহ.। সেই স্বপ্ন লালন করে এই সংঘবদ্ধ তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠাতা করেন মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভি রহ.। যার মাধ্যমে কুরআনে নির্দেশিত সঠিক কাজ ও নিষেধকে বাস্তবায়ন করার একটি দল তৈরী হবে। সর্বপ্রথম হজের একটি সফরে এর মূল অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার সময় তিনি তার পান্ডিত্য, বক্তব্য দক্ষতা ইত্যাদি বিষয়সমূহ নিয়ে নিজের মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করতেন। তবে তিনি তা বাস্তবায়নে দৃঢপ্রতিজ্ঞ ছিলেন। শুরুর দিকে তিনি একগুচ্ছ মসজিদ-ভিত্তিক ইসলামি পাঠশালা-বয়স্কদের শিক্ষা দানের চেষ্টা করেন। যাতে ভারতের মেওয়াত অঞ্চলের অশিক্ষিত দরিদ্র মুসলিমদেরকে সঠিক আকিদা ও ধর্মচর্চার শিক্ষা দিতে পারেনতবে কিছুকাল পর তিনি অনুধাবণ করেন যে, এ পদ্ধতিতে বেশকিছু নতুন ইসলামি পণ্ডিত তৈরী হলেও কোনো ধর্মপ্রচারক তৈরী হচ্ছে না।
ফলে তিনি এতে পুরোপুরি শ্রম দেওয়ার লক্ষে মাদরাসা মাজহারুল উলুম থেকে শিক্ষকতার চাকরী ছেড়ে দেন। অতঃপর তিনি দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকাতে চলে আসেন এবং ১৯২৬ বা ১৯২৭ সালে পুরোপুরি কাজ শুরু করেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুহাম্মাদ সা. যে কর্মপদ্ধতী অনুসরণ করেছিলেন; আন্দোলনের কর্মপন্থা, নীতিনির্ধারণ করার সময় তিনি তা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
আর যে স্লোগানটি সামনে রেখে তিনি আন্দোলন শুরু করেছিলেন; তার অর্থ হলো, “হে মুসলমান, [সত্যিকারের] মুসলমান হও!” যা প্রকৃতপক্ষে তাবলিগ জামাতের মূল লক্ষ্যকে প্রকাশ করে। এভাবে পরবর্তীতে এই জামাত দ্রুতই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন এবং জানা গেছে যে, ১৯৪১ সালে তাদের বার্ষিক আলোচনা সভায় ২৫,০০০ জন অনুসারী অংশগ্রহণ করেন।
বিশ্বাস ও উদ্দেশ্য: তাবলিগ জামাতের সদস্যদের তাদের নিজস্ব ফিকহ অনুসরণে কোন বাধা দেওয়া হয় না, যতক্ষণ না তা সুন্নি ইসলাম হতে বিচ্যুত হয়। তাবলিগ জামাত দাওয়াতের উদ্ধৃতির মাধ্যমে এর উদ্দেশ্যকে সংজ্ঞায়িত করে, যা হলো ইসলামের প্রচার বা ধর্মান্তরিতকরণের আহবান। তাবলিগ জামাত দাওয়াতকে শুধুমাত্র সৎকাজের আদেশ আর অসৎকাজের নিষেধ হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
তাদের মতে, মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাই সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য আল্লাহ পৃথিবীতে অসংখ্য নবি ও রাসূল প্রেরণ করেছিলেন; কিন্তু যেহেতু মুহাম্মদ সা. আল্লাহর শেষ বাণীবাহক, তার পরে আর কোনোনবি বা রাসূল আসবেন না, তাই নবি মুহাম্মদ সা. বিদায় হজের ভাষণে মুসলমানদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্ব অর্পন করেন পরবর্তী আলেমদের হাতে। তাবলিগ জামাত দাওয়াতের এই উদ্দেশ্যকে দুটি নির্দিষ্ট আয়াতের আওতায় উল্লেখ করা যায়।
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদেরকে বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।” (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১১০)। অন্যত্রে আছে- “তার চেয়ে ভালো কথা আর কী হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি সাধারণ মুসলমানদের মধ্য হতে একজন।” (সূরা হা মীম সিজদা আয়াত-৩৩)।
মহানবি হজরত মুহাম্মদ সা. যেভাবে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত এর যে গতি ছিল ঐতিহাসিকগণ লিখেন, নবিজির মৃত্যুর পর সাহাবি, তাবেয়ি ও তাবে-তাবেয়িগণের মাধ্যমে ইসলামী জীবন বিধান প্রচার ও প্রসারের কার্যক্রম আরো বিস্তৃতি লাভ করে। কিন্তু মুসলিম শাসকদের ক্ষমতা বিলুপ্তির পর ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে ভাটা পড়তে থাকে, যা থেকে পরিত্রাণের জন্য মুসলিম মনীষীদের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। আর সর্বশেষ অনুরূপ চিন্তাধারা থেকেই মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভি রহ. ভারতের দিল্লিতে তাবলিগ জামাতের সূচনা করেন। যার প্রচেষ্টার ফলে তাবলিগ জামাত একটি বহুল প্রচারিত আন্দোলনে রূপ নেয়। তাবলিগ জামাত সারা বিশ্বে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়াকে তাদের প্রধানতম উদ্দেশ্য হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকে।
মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভি রহ. যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তা হলো, কমপক্ষে দশ জন ব্যক্তির একটি দল সংগঠিত করা এবং তাদেরকে ধর্মপ্রচারের জন্য বিভিন্ন গ্রামে বা আশেপাশে প্রেরণ করা। এই 'বহির্গমন', বা দাওয়াতের সফরগুলো বর্তমানে তাবলিগ জামাতের মুরব্বিদের দ্বারা পরিচালিত হয়। এই সফরগুলোতে, "কর্মের ফজিলত সম্পর্কিত" (নবিজির অনুকরণ বিষয়ক) একটি হাদিসে’র উপর জোর দেওয়া হয়। উক্ত ফাজায়েল এর হাদিসে এগুলোকে ঈমান এবং ইহতিসাব বলে অভিহিত করা হয়েছে। তাছাড়া তাবলিগ জামাত বিশ্বাস করে যে, এটি আখিরাতের পুরস্কারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আহরিত শক্তি। তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি রহ. বলেন, সৎ গুণের জ্ঞান ও আমালু-সালিহা (সৎকাজ) হলো, মাসআলা-মাসায়েল (আইনশাস্ত্র) -এর জ্ঞানের চেয়ে অধিক অগ্রগণ্য। ফিকহের বিস্তারিত জ্ঞান (নামাজের ফরজ ও সুন্নত) তখনই উপকারী হবে যখন একজন লোক নামাজ আদায়ে সক্ষম হবে। মুরব্বিরা জোর দেয় যে, শিক্ষার সর্বোত্তম উপায় হলো অন্যদেরকে শিক্ষা দেওয়া ও উৎসাহিত করা।
এছাড়াও মুসলিমদেরকে তাদের দৈনিক রুটিনের বাইরেও কিছু সময় তাবলিগি কাজকর্মে ব্যয় করতে উৎসাহিত করে এবং অনুসারীদেরকে আখেরাতমুখী হওয়ার লক্ষে তাদের বিশ্বাস আরও গভীর করতে আপন সন্তানদের দেওবন্দি মাদারিস বা মাদরাসাসমূহে ভর্তি করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়।
বিশ^ ইজতেমা:বিশ্ব ইজতেমা তাবলিগ জামাতের বার্ষিক বৈশ্বিক সমাবেশ, যা বাংলাদেশের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাবলিগ জামাতের এই সমাবেশটি হজের পর পুরো বিশ্বের সর্ববৃহৎ জমায়েত। এতে অংশগ্রহণ করেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। 'বিশ্ব ইজতেমা' শব্দটি বাংলা ও আরবি শব্দের সম্মিলনে সৃষ্ট; আরবি 'ইজতেমা' অর্থ সম্মিলন, সভা বা সমাবেশ, একত্রিত হওয়া। সাধারণত প্রতিবছর শীতকালে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়ে থাকে, এজন্য ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসকে বেছে নেওয়া হয়।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতি বছর এই সমাবেশ নিয়মিত আয়োজিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বিশ্বের প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি দেশের তাবলিগি দ্বীনদার মুসলমান জামাতসহ ২৫ থেকে ৩০ লক্ষাধিক মুসল্লি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ইসলামি মহাসম্মিলন বা বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন।
তাবলিগি কার্যক্রম সূচনার পর হতে নেতৃত্ব প্রদান করেন- এর প্রতিষ্ঠাতা ওলীয়ে কামেল হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.। ১৯৪৪ সালে তিনি ওফাত লাভ করলে তাবলিগের হাল ধরেন তারই পুত্র বিশিষ্ট হাদিস বিশারদ, মাওলানা ইউসুফ সাহেব রহ.। শায়খুল হাদীস মাওলানা জাকারিয়া রহ.তাবলিগ কর্মীদের পাঠ্য হিসেবে ‘তাবলিগে নেসাব’ গ্রন্থসহ বহুগ্রন্থ রচনা করেন। মাওলানা ইউসুফ সাহেব রহ. ও শায়খুল হাদীস জাকারিয়া রহ.-এর ইন্তেকালের পর তখন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের নেতৃত্ব দান করেন মাওলানা এনামুল হাসান রহ.।
বার্ষিক ইজতেমা থেকে বিশ্ব ইজতেমা ১৯৪৮ সালে হজরত মাওলানা ইউসুফ সাহেব রহ.-এর উপস্থিতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকার কাকরাইলে ১ম বার্ষিক ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে তাবলিগের বড় ইজতেমা হয়। ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬০, ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে বার্ষিক ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার রমনা ময়দানে। ১৯৬৬ সালে সর্বপ্রথম টঙ্গীর তুরাগ তীরে ইজতেমার আয়োজন করা হয়।
স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিস্তীর্ণ ও বিশাল ময়দানটি তাবলিগের ইজতেমার জন্য ব্যবস্থা করে দেন। ফলশ্রুতিতে এখানে নিয়মিতভাবে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। যা আশির দশক হতে বিশ্ব ইজতেমার রূপ পরিগ্রহ করে। পাকিস্তানের রাইভেন্ড ও ভারতের ভুপালেও বৃহৎ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তবে সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের ইজতেমা সুবৃহৎ ও সুবিশাল। বাস্তবতার নিরিখেও এটি ইজতেমা বটে, কারণ বিশ্বের অর্ধশতকেরও বেশি দেশের লোক ঢাকার ইজতেমায় সমবেত হয়।
পরিশেষে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি, তিনি যেন বিশ্ব ব্যাপী দ্বীনের এই খেদমতকে কবুল করেন এবং এই জামাতকে সকল প্রকার ফেতনা থেকে হেফাজত করেন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামি আইন ও গবেষণা বিভাগ, আল মারকাজুল ইসলামী (এএমআই) বাংলাদেশ।
-এসআর