জহির উদ্দিন বাবর: আজ থেকে ১৩ বছর আগের কথা। ২০১০ সালের জানুয়ারির শুরু। আমি তখন মিরপুরের মাদরাসা দারুর রাশাদে। আমাদের অগ্রজ মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ তখন থাকেন মাদরাসার পাশেই সাংবাদিক আবাসিক এলাকায়।
প্রায় প্রতিদিনই সাক্ষাৎ হতো। গল্প হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কখনও আমার রুমে বসে, কখনও চায়ের স্টলে, আবার কখনও ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। সেদিন সন্ধ্যার পর দারুর রাশাদের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। এক ফাঁকে এলো ইজতেমার কথা। তখন ইজতেমা হতো এক পর্বে। আমেজ ছিল অনেক বেশি।
তিনি বললেন- ইজতেমায় আমরা একটি দৈনিক বের করতে পারি। সেখানে প্রতিদিনের বয়ান ও ইজতেমাসংক্রান্ত বিভিন্ন লেখা থাকবে। আমি বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। চরম আইডিয়াবাজ আমাদের প্রিয় শরীফ ভাই একের পর এক আইডিয়া দিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু কাজটি বলা যত সহজ করাটা তত সহজ নয়। তাছাড়া ইজতেমারও বাকি মাত্র কয়েক দিন। সেদিনের মতো আমাদের গল্প এখানেই শেষ। হুমায়ুন আইয়ুব তখন রাহমানী পয়গামে। বিষয়টি তার সঙ্গে শেয়ার করলাম। হুমায়ুন শুনেই লুফে নিলেন। বললেন, চলেন আমরা শুরু করে দিই। শরীফ ভাইয়ের সঙ্গেও কথা বললেন হুমায়ুন। সঙ্গে যুক্ত হলেন গাজী মুহাম্মদ সানাউল্লাহ।
হামদর্দ থেকে একটি ভালো সহযোগিতার আশ্বাসও পাওয়া গেল। ইসলামী ব্যাংকের একটি বিজ্ঞাপনও চূড়ান্ত করলেন হুমায়ুন আইয়ুব। আমরা সবাই মিলেই চেষ্টা চালালাম বিজ্ঞাপন সংগ্রহের।
কাজটি করতে হবে টঙ্গীতে। তাই ‘টঙ্গীর কুতুব’ খ্যাত মুফতি এনায়েতুল্লাহকে চাই। প্রস্তাব দিতেই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। স্থানীয় যত সাপোর্ট সব তিনি দেবেন বলে রাজি হলেন। আমরা বসলাম পল্টনের বাসমতি হোটেলের দোতলায়; যেখানে তখন ছনের ছাউনির সুন্দর-নিরিবিলি পরিবেশ ছিল। পুরো পরিকল্পনা সাজালাম। ইজতেমা দৈনিকের নাম হবে ‘ইজতেমা প্রতিদিন’। টিম লিডার মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। মুফতি এনায়েত, গাজী, হুমায়ুন আর আমি মূল টিমে। সঙ্গে যুক্ত হবেন আমাদের আরও অনেক বন্ধুবান্ধব।
তখন ফেসবুকে আমাদের লোকদের বিচরণ ততটা ছিল না। তবু ব্যাপক সাড়া পড়ল। আমাদের প্রিয়দের অনেকেই স্বতস্ফূর্তভাবে যুক্ত হয়ে গেলেন এই কাজের সঙ্গে। টঙ্গী বাজারের হাজীবাড়িতে একটি টিনশেড মাদরাসা আমাদের অফিসের জন্য ঠিক করলেন মুফতি এনায়েত। ড. শামসুল হক সিদ্দিক দিলেন একটি কম্পিউটার। আরেকটি মাসিক আল আশরাফের।
আমাদের টিমে এসে যুক্ত হলেন লাবীব আবদুল্লাহ, সৈয়দ শামছুল হুদা, আলী হাসান তৈয়ব, মাসউদুল কাদির, আবদুল্লাহ মোকাররম, রোকন রাইয়ান, আতাউর রহমান খসরু, আবুল কালাম আনসারী, কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ, আবদুল গাফফার, আবদুল্লাহ তামিমসহ তরুণদের অনেকেই।
দুই.
এবার মূল কাজ শুরুর পালা। সবার মধ্যে টানটান উত্তেজনা। দেশে আমরাই প্রথম কাজটি করতে যাচ্ছি। ইজতেমা বিষয়ে দৈনিক পত্রিকা এর আগে কেউ বের করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। একটি পূর্ণাঙ্গ দৈনিকের প্রায় সবকিছুই আমাদের করতে হবে। তেমন কোনো অভিজ্ঞতা কারও নেই। ইজতেমা শুরু হবে শুক্রবার। আমরা বৃহস্পতিবার থেকেই শুরু করলাম কাজ। মেকাপ হলো প্রথম সংখ্যা। টঙ্গী বাজারে একটি প্রেস ঠিক করা হলো। টঙ্গীতে তখনও আউটপুটের কোনো ব্যবস্থা নেই। উত্তরায় একটি ছিল। ভেতরের সাদাকালো পৃষ্ঠাগুলোর আউটপুট সেখান থেকে নেওয়া হলো। সেটা আবার রাত আটটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। তাই রঙিন পৃষ্ঠাগুলোর আউটপুট পল্টন-ফকিরাপুল থেকে নিতে হবে।
রকিব নামে একটি ছেলে ছিল আমাদের ডিজাইনার। সে তেমন দক্ষ ছিল না। কাজ সারতে সারতে তার রাত প্রায় ১২টা হয়ে গেল। শীতের রাত, পল্টন-ফকিরাপুলেও এতো রাতে আউটপুট হাউজ খোলা থাকে না। শরণাপন্ন হলাম বিশ্বকল্যাণের সাইফুল ভাইয়ের। তিনি ফকিরাপুলের একটি পরিচিত আউটপুট হাউজে গিয়ে বসে থাকলেন। বারবার ফোনে যোগাযোগ করছেন আর কতক্ষণ! আমি আর এনায়েত ভাই রাত ১২টার পর আবদুল্লাহপুর থেকে সিএনজিতে করে রওয়ানা দিলাম। কনকনে শীত, শৈত্যপ্রবাহ চলছে। ফকিরাপুলে পৌঁছাতে রাত একটা। বিরক্তির ভাব নিয়েই লোকেরা আমাদের কাজটা করে দিলেন।
রাত প্রায় তিনটার দিকে টঙ্গী বাজারের প্রেসে আউটপুট পৌঁছালাম। তৈরি হলো প্লেট। ফজরের পর হাতে এলো ইজতেমা বিষয়ক একটি আস্ত দৈনিক। সবকিছু আশানুরূপ হলো না। তবু সবার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। সৃষ্টির তৃপ্তিতে উচ্ছ্বসিত সবাই। চাহিদার তুলনায় আমাদের কপির সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। চারদিকে ব্যাপক সাড়া পড়ল। মুহূর্তের মধ্যেই সব কপি শেষ হয়ে গেল।
তিন.
সেইবার আমরা চারটি সংখ্যা করেছিলাম। আখেরি মোজাতের দিন হয়েছিল দুটি সংখ্যা। সান্ধ্যকালীন দৈনিকও সেদিন বের করেছিলাম। পরের বছরও আমরা ইজতেমা দৈনিকটি করেছি। সেই বছর থেকেই ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। আমরা দুই পর্বে করেছিলাম সাতটি সংখ্যা। কিন্তু দ্বিতীয় বছর থেকেই শুরু হয়ে যায় আইডিয়া নকলের মহড়া। আমাদের দেখানো পথে অনেকেই শুরু করে দিলেন ইজতেমা নিয়ে প্রকাশনা। আমরা থেমে গেলাম। পথ দেখিয়ে দিয়েছি এখন পরবর্তীরা সামনে এগোবেÑ সেই প্রত্যাশায় ইতি টানলাম ইজতেমা প্রকাশনার। তবে দুই বছরের সংখ্যাগুলো নিয়ে আমরা ‘ইজতেমা প্রতিদিন সমগ্র’ নামে একটি সংকলন বের করেছি। সেটি এখনও বাজারে আছে। সেই সংকলনটি প্রকাশে আমাদের আর্থিক সহযোগিতা করেন কাতার প্রবাসী আমাদের বন্ধু সাইয়্যেদ মাহফুজুর রহমান। দ্বিতীয়বার ইজতেমা প্রকাশনায়ও আমরা তাঁর সহযোগিতা পেয়েছি।
ইজতেমা প্রতিদিন শুধু একটি ইজতেমা দৈনিক ছিল না, এটি ছিল আমাদের সংঘবদ্ধ হওয়ার একটি সুন্দর প্রক্রিয়া। এই দৈনিকটির আগে এতোগুলো তরুণ ও স্বপ্নবিলাসী একসঙ্গে কোনো কাজ করেছে বলে মনে পড়ে না। এই দৈনিকটি বের করার পর আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়। আমরাও চাইলে পারিÑসেই প্রত্যয় জাগে। ইজতেমা দৈনিকে সাংবাদিকতার যে মহড়া দিয়েছিলেন তা কাজে লাগিয়ে তরুণদের অনেকেই এখন সাংবাদিকতায় ভালো করছেন। স্বপ্ন দেখা এবং তা বাস্তবায়নের পথ খুলে দিয়েছে ইজতেমা প্রতিদিন। এই ইজতেমা প্রতিদিনের সূত্রেই আমাদের মধ্যে সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জাগে। পরবর্তী সময়ে গঠিত বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরামের বীজ মূলত তখনই রোপিত হয়।
প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমা আসে। এ উপলক্ষে অনেকেই প্রকাশনা করেন। এগুলো দেখলে আমাদের স্মৃতিতে জেগে উঠে সেই ২০১০ আর ১১ সালের কথা। কনকনে শীতের রাতগুলো আমরা কাটিয়েছি টঙ্গীতে একটি দৈনিকের মহড়া দিতে গিয়ে। বৈষয়িক স্বার্থে নয়, তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে আমরা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি অনেক। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া, খুনসুঁটি, স্বপ্নের চাষবাস আর প্রিয় মানুষদের উঞ্চ সান্নিধ্যের সেই দিনগুলো এখনও আমাদের স্মৃতিকাতর করে তোলে। প্রিয় সেই দিনগুলো চাইলেই কি আর ফিরে আনা যাবে! তবু সেই দিনগুলো সুখস্মৃতি হয়ে থাকুক অনন্তকাল।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, ঢাকা মেইল; সম্পাদক, লেখকপত্র