মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


থার্টিফাস্ট নাইট ও আমাদের সতর্কতা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| মুহাম্মাদ মিযানুর রহমান ||

আমাদের জীবন থেকে কালের গহ্ববরে বিলীন হতে যাচ্ছে একটি বছর। ৩১শে ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে শুরু হবে ১ জানুয়ারি; নতুন বছর। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার সর্বপ্রথম ইংরেজি নববর্ষ-উৎসব প্রচলন ঘটায়। পহেলা জানুয়ারি পাকাপোক্তভাবে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট হয় ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর। ধীরে ধীরে শুধু ইউরোপে নয় পুরো পৃথিবীতে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালন করা হয়। প্রাচীন পারস্য-সম্রাট জমশীদ খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালে নওরোজের প্রবর্তন করেছিলেন। এ ধারাবাহিকতা এখনোও ইরানে নওরোজ ঐতিহ্যগত নববর্ষের জাতীয় উৎসব পালিত হয়। ইরান থেকেই এটি সংস্কৃতির ধারায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশ এবং ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে।

ইসলামে নওরোজ বা থার্টিফাস্ট নাইট পালন

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন–“রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করলেন। তখন মদিনাবাসী দুটি খেলা-ধুলা করতেন। তিনি বললেন: এ দুটি দিন কি? তারা বলল: আমরা এতে জাহিলি যুগে খেলা-ধুলা করতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তার পরিবর্তে উত্তম দুটি দিন দিয়েছেন: ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর” (আবু দাউদ শরীফ: ১১৩৪)

ওই দিন দুটি ছিলো ‘নওরোজ’ বা নববর্ষ। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন– যে অনারব দেশ ভ্রমন করে এরপর তাদের নওরোজ ও মেহেরজান উৎযান করে, তাদের সাথেই তাকে উঠানো হবে” (সুনানে বায়হাকী ২/৩২৫)

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া এই হাদীস সহীহ বলেছে। তিনি বলেন – “এ হাদীস প্রমাণ করে যে, মুসলমানদের জন্য কাফেরদের উৎসব পালন করা হারাম। কারণ, রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের জাহিলী যুগের দুটি উৎসব পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তাদের রীতি অনুযায়ী সে দিন দুটি তাদের আনন্দ-উৎসবের অনুমতি দেননি। বরং বলেছেন—“নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দুটি পরিবর্তণ করে দিয়েছেন।” (ফয়জুল কালাম, ৫১১)

আল্লামা ইবনে হাজার বলেন–‘মুশরিকদের উৎসব-সমূহে আনন্দ-খুশী প্ৰকাশ করা বা তাদের মতো আনন্দ-উৎসব পালন করা হাদীসসের মাধ্যমে না জায়েজ প্রমাণিত হলো।

নওরোজ বা থার্টিফাস্ট নাইট সর্ম্পকে আলেমদের অভিমত
১. আল্লামা ফখরুদ্দীন যাইলায়ী বলেন–“নওরোজ ও মেলার নামে কিছু দেয়া নাজায়েয। এ দুই দিনের নামে প্রদত্ত হাদিয়া হারাম; বরং কুফর”। ( তাবইনুল হাকায়েক : ৬/২২৮)

২.আল্লামা হাসকাফী রহমতুল্লাহি বলেন– ক.নওরোজ বা বছরের প্রথম দিন উপলক্ষে যদি কেউ একটি ডিমও দান করে, তবে তার ৫০ বছরের আমল বরবাদ হয়ে যাবে।

খ. যে ব্যক্তি নওরোজের দিন এমন কিছু খরিদ করল যা সে পূর্বে খরিদ করত না, এর মাধ্যমে সে যদি ঐ দিনকে সম্মান করতে চায় তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে।

৩. হাম্বলি মাযহাবের ফিকহি গ্রন্থ ‘আল- ইকনাতে বলা হয়েছে– “কাফেরদের উৎসবে যোগদান করা এবং সেইদিন উপলক্ষে বেচা- বিক্রি করা ও উপহার বিনিময় করা হারাম”।

বিধর্মীদের রীতিনীতি অনুসরন করা সর্ম্পকে শরীয়তের ফয়সালা

হযরত আবু উমামা বাহেলী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন–“যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের কৃষ্টি-কালচার অনুসরণ-অনুকরণ করবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে আর যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়কে মহব্বত করবে, তাদের সাথে তার হাশর হবে।” ( আবু দাউদ, হাদীস: ৩৫১৪)

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূলে আরবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম বলেছেন যে ব্যাক্তি যে সম্প্রদায়ের সাদৃশ্যতা গ্রহণ করবে সে তাদের দলভুক্ত হবে। (আবু দাউদ : ২৭৫)

এ ব্যাপারে আল্লামা ইবনে কাসির রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “কাফেরদের ধর্মীয়-মৌসুমী কোনো উৎসবে মুসলমানদের অংশ গ্রহণ করা জায়েজ নেই। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ উম্মতকে মর্যাদাপূর্ণ এবং সম্মানিত করেছেন রাসূলে আরবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। যাকে তিনি পরিপূর্ণ ও সর্বব্যাপী দ্বীন দিয়েছেন যদি মূসা ইবনে ইমরান জীবিত থাকত কিংবা ঈসা ইবনে মারইয়াম তারাও ইসলামের অনুসারী হতো। সুতরাং রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ছেড়ে আমাদের জন্যে কীভাবে সম্ভব ইয়াহূদী-নাসারাদের অনুসরণ করা। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ২/১৪২)

থার্টিফাস্ট নাইট ও আমাদের সতর্কতা
বছরের অন্যান্য দিনের ন্যায় নববর্ষের দিনকে গণ্য করব। এদিন কোনো ধরণের আনন্দ-উৎসবে অংশ নিবো না। আমাদের সন্তানদের প্রতি দৃষ্টি রাখব, যেন তারা বিজাতীয় কোনো উৎসবে অংশ গ্রহণ না নেয়। ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে আরবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম বলেছেন– “তোমরা সবাই জিম্মাদার এবং তোমাদের সবাইকে তার জিম্মাদারি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আমির জিম্মাদার, অনুরূপ ব্যক্তি তার পরিবারের জিম্মাদার। নারী তার স্বামীর ঘর ও সন্তানের জিম্মাদার। অতএব তোমরা সবাই জিম্মাদার এবং সবাইকে তার জিম্মাদারি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে”। (বুখারি: ৪৮২৬, মুসলিম: ৩৪১৪)

সুতরাং যার অধীনে যারা আছে তাদের দেখা-শুনা করা, দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণের পথ বাতলানো এবং তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করা তার দায়িত্ব। যে নিজ দায়িত্ব আঞ্জাম দিবে, তার জন্য রয়েছে বড় প্রতিদান, আর যে নিজ দায়িত্বে অবহেলা করবে, কিয়ামতের দিন তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।

নববর্ষ কিংবা এ জাতীয় উৎসবে আমরা মুসলিম অমুসলিম কারো সাথে উপহার আদান-প্রদান করব না, বিশেষ করে ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মদিন ও ইংরেজি নববর্ষে। আমরা এতে ছুটি কাটাব না, না স্কুল-কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করব। এ দিনের সংস্কৃতি হিসেবে কারো যোগাযোগ করব না।

প্রিয় পাঠক, সন্তান কিংবা পরিবারের কোন সদস্যের আবদার রক্ষার্থে আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করে তাদের উৎসব উদযাপন করা যাবে না।
এই সম্পর্কে আল্লামা যাহাবি রাহি. বলেন: “যদি কেউ বলে: আমরা এগুলো ছোট বাচ্চা ও নারীদের জন্য করি, তাকে বলা হবে: সবচেয়ে হতভাগা সে ব্যক্তি যে আল্লাহর গোস্বার বস্তু দ্বারা পরিবার ও সন্তানকে সন্তুষ্ট করে। অতঃপর তিনি বলেন: আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “যে অনারব দেশ বিচরণ করে, অতঃপর তাদের নওরোজ ও মেহেরজান উৎযান করে, তাদের সাথে তাকে উঠানো হবে”। ( ইব্‌ন ওমর রাদিয়াল্লাহুর বাণী নকল করেছেন বায়হাকি রহ., ইব্‌ন তাইমিয়াহ রহ. তার সনদকে সহি বলেছেন।)

তার এ কথার দাবি এসব কাজ কবিরা গুনাহ এবং এ জাতীয় অল্প অপরাধ অধিক অপরাধের দিকে ধাবিত করে। তাই মুসলিমের কর্তব্য এ জাতীয় কর্মের পথ একেবারে বন্ধ করা এবং পরিবার ও সন্তানের হৃদয়ে তার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা। বিদআত থেকে বিরত থাকা ইবাদত। কেউ বলবেন না: এর দ্বারা বাচ্চাদের আনন্দ দেই! আপনি কি বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য আল্লাহর গোস্বা ও শয়তানের সন্তুষ্টির বস্তু ব্যতীত কিছু পেলেন না! এগুলো কুফরির আলামত ও সীমালঙ্ঘন বৈ কিছু নয়?! আপনি খারাপ অভিভাবক, বস্তুত আপনি গড়ে উঠেছেন এভাবে”। ( জাহাবি রহ. কর্তৃক রচিত তাশাব্বাহাল খাসিস বি আহলিল খামিস)

প্রিয় মুসলিম ভাই! পৃথিবীতে দুই প্রকার দ্বীন রয়েছে:
ক. মানব রচিত দ্বীন যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ ও অগ্নিপূজক ইত্যাদি।
খ. আসমানী দ্বীন যেমন ইহুদি, খৃস্টান ও ইসলাম। মানব জাতির হিদায়াত-কল্যাণের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল নবী ও রাসূলকে এ দ্বীন-সহ প্রেরণ করেছেন। ইহুদি-খৃস্টানদের দীন আজ বিকৃত, রহিত ও মানব রচিত দ্বীননের ন্যায় প্রত্যাখ্যাত। আল্লাহর নিকট তার কোন মূল্য নেই।

আল্লাহ আমাদেরকে সর্বোত্তম দীন, সর্বোত্তম কিতাব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল দান করেছেন। আসুন আমরা দ্বীন ইসলাম ও রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শকে আঁকড়ে ধরি, পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করি এবং কাফের মুশরিকদের সঙ্গ ত্যাগ করি, তাদের কৃষ্টি-কালচার পরিহার করি। আল্লাহ আমাদেরকে তার নিকট আত্মসমর্পণকারী ও একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ