আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মরিশাসের দাপ্তরিক নাম ‘দ্য রিপাবলিক অব মরিশাস’, যা আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে এবং মাদাগাস্কারের পূর্ব দিকে অবস্থিত। মরিশাসের আয়তন দুই হাজার ৪০ বর্গকিলোমিটার এবং জলসীমার আয়তন এক হাজার ১০০ নেটিক্যাল মাইল।
২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে দেশটির মোট জনসংখ্যা ১২ লাখ ৬৫ হাজার ৪৭৫ জন। এর মধ্যে ১৭.৩০ শতাংশ মুসলিম এবং তারা উর্দু ভাষায় কথা বলে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী এবং মরিশাসের ৮৬.৫ শতাংশ মানুষ মরিশিয়ান ভাষায় কথা বলে। ১২ মার্চ ১৯৬৮ সালে দেশটি যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
মুসলমানদের আবিষ্কার মরিশাস : মুসলিম ব্যবসায়ীরাই সর্বপ্রথম মরিশাস আবিষ্কার করেন। আনুমানিক ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা মরিশাসের মাটিতে পা রাখেন। তবে তাঁরা সেখানে উপনিবেশ গড়ে তোলেননি। আরব বণিক ও পর্যটকরা মরিশাসকে ‘দিনা আরবি’ নামে চিহ্নিত করেছেন। পরে পর্তুগিজ বণিকরা মরিশাসের সন্ধান পান এবং ১৫০৭ সালে সেখানে তাঁদের যাতায়াত শুরু হয়। ইতিহাস গবেষক ব্রিজান বরুণ বলেন, ‘আরবরা যে মরিশাস আবিষ্কার করেছেন তার প্রমাণ হিসেবে আল-ইদরিসির (১১৫১ খ্রি.) মানচিত্রই যথেষ্ট। যিনি মরিশাসের তিনটি দ্বীপ : মরিশাস, রিইউনিয়ন ও রড্রিগেস নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করেছেন যথাক্রমে দিনা আরবি, দিনা মাগরিবিন ও দিনা নোরাজি নামে। যদিও তাঁরা এসব দ্বীপে বসতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি। ’
মরিশাসে মুসলিম বসতি : ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে মরিশাসে ফরাসি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই সেখানে মুসলমানের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ফরাসি সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত একটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন চুক্তির অধীনে তারা মরিশাসে আগমন করেছিল। তারা বন্দর নগরী পোর্ট লুইসে কাঠমিস্ত্রি, কামার, রাজমিস্ত্রি, দর্জি ও নাবিক হিসেবে কাজ করত। পুরাতন নথি অনুসারে মরিশাসের সর্বপ্রাচীন মুসলিম পরিবার ‘গ্যাসি সবেদার’ (সম্ভবত গিয়াস সরদার উদ্দেশ্য)। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে মরিশাসে তাদের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়।
মরিশাসের প্রথম মসজিদ : মরিশাসে মুসলিমরা প্রথমে গোপনে নামাজ ও অন্যান্য ইবাদত করত। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমরা প্রথম মসজিদ নির্মাণের আবেদন করে। কয়েকবার আবেদন করার পর অবশেষে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর ডেকান মুসলমানের আবেদন গ্রহণ করেন। মুসলমানদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ‘মসজিদুল আকসা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মসজিদের ইমাম ছিলেন ‘গ্যাসি সবেদার’।
ব্রিটিশ আমলে মুসলমান : ২৮ নভেম্বর ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা মরিশাসে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম ব্রিটিশ গভর্নর রবার্ট টাউনসেন্ড ফারকুহার শত শত ভারতীয় বন্দি সৈনিক ও রাজনীতিককে (স্বাধীনতা সংগ্রামী) মরিশাসে দ্বীপান্তরিত করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছিল মুসলিম। ক্লেয়ার অ্যান্ডারসনের মতে, তাদের সংখ্যা ছিল ৩১৬।
মুসলিম ব্যবসায়ী : ব্রিটিশ আমলে মরিশাসে কিছু মুসলিম ব্যবসায়ীও আগমন করেন। মুসলিম ব্যবসায়ীরা মরিশাসে খাদ্যসামগ্রী ও পোশাক শিল্পের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এ ছাড়া তাঁরা নিজস্ব আখক্ষেত ও কারখানা গড়ে তোলেন। জাহাজ ও পণ্য রপ্তানিতে বিনিয়োগ করেন। একসময় আখ রপ্তানি, পাটের ব্যাগ ও পোশাক উৎপাদনে মুসলিমরা আধিপত্য বিস্তার করে।
কোচির মুসলিম ব্যবসায়ীরা পোর্ট লুইস, রেমি ওলিয়ার স্টেট ও কুইন স্টেটে ব্যাবসায়িক কেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেসব কেন্দ্র ‘মেইমেন বাজার’ (মুমিন বাজার) নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৫১ সালে মেইমেন বাজারের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হলেন, মুহাম্মদ হাজি ইসমাইল, হামির কাসিম, হাজি ইউসুফ নুর মুহাম্মদ, উসমান হাজি আল্লাহরাখিয়া। অন্যদিকে সুরাতের মুসলিম ব্যবসায়ীরা রয়েল স্টেট, বার্বন স্টেট, ফারকুহার স্টেট ও কোরডেরি স্টেটে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করেন। তাঁদের স্থাপিত বাণিজ্যকেন্দ্রকে সুরাটি বাজার বলা হতো। সুরাতি বাজারে শীর্ষ ব্যবসায়ী ছিলেন মোল্লিদিনা আবদুল্লাহ, হাসান আগা মুহাম্মদ, ইলিয়াস হাজি হামিদ, মির্জা মাহমুদ, শেখ আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ।
মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার : অর্থনৈতিকভাবে মুসলিমরা প্রভাবশালী হলেও তারা রাজনীতি থেকে বিমুখ ছিল। অহিংস রাজনীতির প্রবক্তা মহাত্মা গান্ধি মরিশাস সফর করার পর তাদের ভেতর রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয়। তারা স্থানীয় কাউন্সিল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ১৯০০ সালে মরিশাসের প্রথম মুসলিম কাউন্সিলর নির্বাচিত হন হাসান শাকির। প্রথম নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন মিসেস শরিফা দামো। তিনি মরিশাস লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত হন। পোর্ট লুইস থেকে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন গোলাম মুহাম্মদ দাউজি। তাঁর উদ্যোগেই প্রথম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচিত কাউন্সিলররা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হন। সূত্র: ইকনা
-এসআর