||মুফতি আলী হুসাইন||
মোবাইল আবিস্কারের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই ছিল পরস্পর যোগাযোগ রক্ষা করা। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত, এক প্রদেশ থেকে অপর প্রদেশ, এক শহর থেকে অপর শহরের মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। বর্তমান বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৭% মোবাইল ব্যবহারের আওতায় চলে এসেছে। অবশিষ্ট তেরো শতাংশ-ও হয়তো খুব কাছাকাছি সময়ের ভেতর চলে আসবে। এই যন্ত্রটার অপকারিতা ও কুফলের শেষ নেই। অবশ্য উপকারিতার ফিরিস্তিও কম নয়।
ধরুন আপনার হাতে একটা ধারালো ছুরি আছে। এখন ইচ্ছে করলে তা দিয়ে ফল কেটে খেতে পারেন আবার অন্যের ক্ষতিও করতে পারেন। সঠিক ব্যবহারেই আপনার ব্যক্তিত্ব পরিস্কার হয়ে যাবে। আধুনিক বিশ্বে মোবাইলের আবিস্কার মানুষের জীবনযাত্রাকে একদমই সহজ করে দিয়েছে। পুরো বিশ্ব এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। এটি ব্যবহারের ফলে খুব অল্প সময়েই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদান করা যায়। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ইচ্ছেমতো কথা বলা যায়।
মোবাইল ব্যবহারের যতগুলো কল্যাণকর দিক থাকতে পারে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো এটির মাধ্যমে মা-বাবা, ভাই-বোন, নিকটবর্তী ও দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ-খবর নেয়া যায়। তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ও সম্পর্ক মজবুত করা সহজতর হয়। মোবাইলের বিভিন্ন ফিচার ও এপস্ ব্যবহার করেও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব। যেমন, ইমু, হুয়াটসঅ্যাপ, ইমেইল, জিমেইল, টুইটার, ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদি অ্যাপস ব্যবহারে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা এবং সু-সম্পর্ক বজায় রাখা এখন সহজসাধ্য ব্যাপার।
সারাদিন মোবাইলে যে-পরিমাণ সময় ব্যয় করি, তার সামান্য একটা অংশ যদি আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় ব্যয় করি, তাহলে মুসলিম সমাজে আত্মীয়তা সম্পর্কের সংকট, দ্বন্দ, দূরত্ব, প্রতিহিংসা কোনোকিছুই অবশিষ্ট থাকার কথা নয়।
অত্যন্ত আফসো ও পরিতাপের বিষয়, এ ছোট্ট একটা যন্ত্রের পেছনে আমার দিনকে দিন, মাসকে মাস খুইয়ে দিচ্ছি। অথচ আত্মীয়দের সাথে কথা বলার দু-এক মিনিট সময় বের করতে পারছি না। আমাদের সমাজে, আমাদের চারপাশে এমনও মানুষ আছে, যারা বছরে একবারও কোনো কানো আত্মীয়কে ফোন করার ফুরসত পায় না। এটা নিতান্তই দুঃখজনক। অথচ কুরআনে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে কী পরিমাণ তাগিদ এসেছে।
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা আল্লাহর নির্দেশ। এ-প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং কোনো কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না। পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকটবর্তীপ্রতিবেশী, দূরবর্তী প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই দাম্ভিক, অহংকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না ।[সুরা নিসা: ৩৬]
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচ্ঞা রে এবং তোমরা সতর্ক থাক আত্মীয়তা-বন্ধন সম্পর্কে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর তীক্ষè দৃষ্টি রাখবেন।[সুরা নিসা:১]
অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর ইবাদতের ব্যাপারে একমাত্র তাঁকেই ভয় করো এবং ভয় করো আত্মীয়তা বন্ধন ছিন্ন করার ব্যাপারে। আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করো এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। [তাফসিরুল কুরআনির আযিম:২৯৩]
মহান আল্লাহ আরো বলেন, আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুণ্ন রাখে, ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং ভয় করে মন্দ হিসাবের। [সুরা রাদ: ২১]
আল্লাহ তায়ালা বলেন, স্মরণ করো, যখন আমরা বনি ইসরাইলের অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করবে না, পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন ও দরিদ্রদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে। [সুরা বাকারাহ: ৮৩]
আল্লাহ তায়ালা বলেন, তবে কি তোমরা আধিপত্য লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধনসমূহকে ছিন্ন করবে?। [সুরা মুহাম্মাদ:২২]
আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ-অনুগ্রহ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন। [সুরা নাহল: ৯০]
আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর আত্মীয়-স্বজনকে তার প্রাপ্য অধিকার প্রদান করো এবং মিসকিন ও মুসাফিরদেরকেও এবং অপচয় করো না। [সুরা বনি ইসরাইল: ২৬]
আল্লাহ তায়ালা বলেন, কাজেই আত্মীয়দেরকে তাদের ন্যায্য প্রাপ্য দিয়ে দাও আর অভাবগ্রস্ত এবং মুসাফিরদেরকেও। যারা আল্লাহর দর্শন কামনা করে, এটা তাদের জন্য উত্তম। আর তারাই সফলকাম। [সুরা রূম:৩৮]
আল্লাহ তায়ালা বলেন, তবে আল্লাহর বিধানে রক্তসম্পর্কীয়গণ পরস্পর পরস্পরের নিকট অগ্রগণ্য। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী। [সুরা আনফাল:৭৫]
সুস্থ ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখে। তাদের পরস্পরে সদ্ভাব বজায় থাকে। আল্লাহ তাদেরকে কিয়ামত দিবসে একসাথে চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি জানে যে, তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্য, সে কি ওই ব্যক্তির মত যে অন্ধ? বুদ্ধিমান লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। যারা আল্লাহকে দেয়া নিজেদের ওয়াদা রক্ষা করে আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। তারা সে সব (আত্মীয়তা) সম্পর্ক রক্ষা করে যা রক্ষা করার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। তারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এবং ভয়াবহ হিসাব-নিকাশকে ভয় পায়। তারা তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টি কামনায় ধৈর্য ধারণ করে, সালাত আদায় করে। আর আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা অন্যায়কে ন্যায় দ্বারা প্রতিরোধ করে। পরকালে স্থায়ী নিবাস প্রাপ্তি এদের জন্য নির্ধারিত, তা হলো স্থায়ী জান্নাত, তাতে তারা প্রবেশ করবে। আর তাদের পিতৃ পুরুষ, স্বামী-স্ত্রীও সন্তানাদির মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তারাও। আর ফেরেশতারা সকল দরজা দিয়ে প্রবেশ করে তাদের সংবর্ধনা জানাবে। (এই বলে যে) তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, কারণ তোমরা ধের্য্য ধারণ করেছিলে। কতইনা উত্তম পরকালের এই ঘর। [সুরা রাদ:১৯-২৪]
জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকার উপায় হচ্ছে আত্মীয়তা রক্ষা করা।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর যারা আল্লাহর সাথে বলিষ্ঠ ওয়াদা করার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ যে সম্পর্ক বহাল রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, তা ছিন্ন করে, তাদের প্রতি অভিশাপ, তাদের জন্য আছে অতিশয় মন্দ আবাসস্থল। [সুরা রাদ: ২৫]
অতএব, আমাদের আরো আত্মসচেতন হতে হবে, আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখতে হবে এবং মোবাইলকে সঠিক ও কল্যাণের কাজে ব্যবহার করতে হবে।
লেখক: কলামিষ্ট; ইমাম ও খতিব, বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, কাশিমপুর, গাজীপুর।
কেএল/