শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


বিশ্বকাপ উন্মাদনার ফলাফল: কী লাভ কী ক্ষতি?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবু তালহা তোফায়েল বিশ্বকাপ উন্মাদনা শুরু হয়েছিলো বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে। কি ক্রিকেট, কি ফুটবল! বিশ্বকাপের প্রতিটি আসরেই দেখা যায় বাংলাদেশীদের আবেগ-উচ্ছাস একটু বেশি।

আর এবার তো এটা সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের গণমাধ্যম কোথায় এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে, উল্টো তা আরো উসকে দেয়। দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়, কে কত আকর্ষণীয়ভাবে একে কভার করতে পারে।

এর ফলে দুঃখ দুর্দশাগুলো আমাদের পিছু ছুটছে না। গত দেড় মাসের ফুটবল বিশ্বকাপ উন্মাদনায় ১২ জনের মৃত্যু ও ২৭ জনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। খেলা নিয়ে এই উন্মাদনায় ক্ষতিকর কী কী ঘটে চলেছে। নিম্নে উল্লেখ করবো।

দুর্ঘটনা: বিশ্বকাপ ফুটবল উন্মাদনার খেসারতে জীবন দিয়ে দিলেন ১২ জন। ফুটবল নিয়ে তর্ক-বিতর্কের জের ধরে সংঘর্ষে, পতাকা টানাতে গিয়ে, ছাদ থেকে পড়ে কিংবা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ও খেলা দেখার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১২ জন মারা গেছেন। এঁদের বেশির ভাগই কিশোর ও তরুণ।

এদিকে ফুটবল নিয়ে তর্ক-বিতর্কের জেরে বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে এ পর্যন্ত আহত হয়েছেন অন্তত ২৭ জন। হতাহতদের সবাই বিশ্ব ফুটবলের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থক।

বিশ্বকাপ শুরুর আগের সপ্তাহ থেকে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত গত এক মাসের সংবাদ ও তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে দেশের তিন জেলায় খুন হয়েছেন তিনজন, সমর্থন করা দলের পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ও ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছেন ৭ জন এবং খেলা দেখার সময় উত্তেজিত হয়ে অসুস্থ হওয়ার পর দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া খেলাকে কেন্দ্র করে লালমনিরহাট, ভোলাসহ ছয়টি জেলায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও মারামারি হয়েছে। (প্রথম আলোর সংবাদ।)

সময়ের অপচয়: সময়ের গুরুত্ব কারো অজানা নয়। সবাই বুঝে যে মুহূর্ত চলে যায় তা আর কখনো ফিরে আসে না। তাই সময়ের অপচয় মানে জীবনেরই অপচয়। কোনো বুদ্ধিমান মানুষ কি নিজের জীবনের অপচয় করতে পারে? অন্তত একজন মুমিন তো পারে না। কারণ সে বিশ্বাস করে যে, হাশরের ময়দানে তাকে আল্লাহর সকল নিয়ামতের হিসাব দিতে হবে।

তাহলে যে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলিম সে দেশে কি শুধু খেলার পিছনে জীবনের মূল্যবান সময়ের এত অপচয় হতে পারে? কিন্তু তিক্ত বাস্তবতা এই যে, আমরা নির্দয়ভাবে আমাদের মূল্যবান সময় ধ্বংস করে চলেছি।

অর্থের অপচয়: পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী পুরাতন টিভি বদল করে নতুন মডেলের টিভি ঘরে আনা শখে পরিণত হয়েছে। এলসিডি টিভির চাহিদা খুব বেশি। (দৈনিক যুগান্তর)

দেশের বহু বাড়ি-ঘর অলিগলিতে দেখা গেছে বিভিন্ন দেশের পতাকা। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরগুলোর হকারদের হাতে অহরহই দেখা গেছে বিভিন্ন দেশের পতাকা ও বিক্রিও হচ্ছে ব্যাপক। হাজার হাজার ফুট লম্বা লম্বা পতাকা, বিলবোর্ড, ডিজিটাল ব্যানার, ফেস্টুন তো প্রতিটি অলিগলিতে আছেই।

আমার অফিসের সহায়ক সে ব্রাজিলের সাপোর্টার। অল্প টাকা বেতন পায়, তার উপর ৬০০ টাকা করে ব্রাজিলের জার্সি কিনে প্রতিদিন গায়ে দিতো। বিশ্বকাপ উন্মাদনায় তার এই অর্থ অপচয় যেনো একবারও ভাবায় না। বিশ্বকাপ শেষ হলেও এখনও সে উন্মাদ।

এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় বড় পর্দায় খেলা দেখার আয়োজনের পিছনেও অর্থের অপচয় কম নয়। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থক গ্রুপ করে সভাপতি-সম্পাদক নির্বাচিত করে চাঁদাও তুলা হয়েছে এমনও খবর পাওয়া গেছে।

চিন্তা করেন! বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশের পক্ষে এ ধরনের অপচয় কত বড় অন্যায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এরপর আছে ব্যক্তিগত পর্যায়ের অপচয়। আশ্চর্যের বিষয় হল, হজ্ব ও কুরবানীর মওসুমে যেসব বুদ্ধিজীবী হজ্ব-কুরবানী না করে গরীব-মিসকীনকে দান-খয়রাত করার সুফল ও যথার্থতা নিয়ে উপদেশ দিয়ে থাকেন বিশ্বকাপের সর্বব্যাপী অপচয়ের বেলায় তারাই আবার সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যান।

শিক্ষাঙ্গনের দূরবস্থা: শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড কথাটি কম-বেশি সকলেই জানেন। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে প্রতিনিয়ত আমরা আহত করছি এই মেরুদন্ডকে। এমনিতেই দেশের শিক্ষাঙ্গণগুলোর অবস্থা অতি শোচনীয়। এর উপর যুক্ত হয়েছে বিশ্বকাপের উন্মাদনা!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আড্ডার মূল বিষয় বিশ্বকাপ। শিক্ষার্থীরা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশের টি-শার্ট পরে ক্যাম্পাসে ঘুরছে সব সময়। প্রতিটি হলে টিভি। কেনা হচ্ছে নতুন নতুন টেলিভিশন। প্রায় হলের মাঠে বড় বড় স্ক্রীন বসানো হয়েছে।

বড় প্রজেক্টর টিএসসিতে স্থাপন করা হয়েছে। শুরু থেকে ফাইনাল পর্যন্ত প্রায় ম্যাচগুলো টিএসসির বড় পর্দায় দেখানো হয়েছে, জড়ো হয়েছে অর্ধ লক্ষের বেশী দর্শক। ঢাকা ভার্সিটিতে ফাইনাল ম্যাচের একজন দর্শক জানান, টিএসসি চত্ত্বরের অবস্থা একেবারে শোচনীয়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা যদি এরকম হয়, তাহলে এদেশের শিক্ষাঙ্গন যে হুমকির মুখে, এটা বুঝে নিতে কষ্ট হবে না। বিশ্বকাপ উন্মাদনায় মেতে উঠে তরুণ তরুণীরা অবাধে নেশা করছে। খোলা মাঠে জনসমক্ষে অশ্লীল ভঙ্গিতে চলছে দুই দুইজন করে। উভয়ের গায়ে আর্জেন্টিনার টি-শার্ট, বিশ্বকাপ ও নেশায় উন্মাদ, হৈ-হুল্লোড়ে মনে হয় কোনো সিনেমা হলের ভেতর এটা।

তাছাড়া অপ্রিয় সত্য হচ্ছে শিক্ষক ক্লাবে বিরাজ করছে অন্যরকম পরিবেশ। শুধু ঢাবি নয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষ্টি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ প্রায় নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একই অবস্থা।

এই সর্বগ্রাসী উন্মাদনায় কারো চিন্তা করার ফুরসৎ থাকে না যে, এই সব বিশ্বকাপ আমাদের জন্য উপকারী না ক্ষতিকর। দেশের চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরাও এ সময় একেবারে নীরব হয়ে থাকেন। কখনো কখনো তো উৎসাহদাতার ভূমিকাও তারা পালন করেন। তাঁদের বিদ্যা-বুদ্ধি-দেশপ্রেম কোনো কিছুতেই এর চরম ক্ষতিকর দিকগুলো ধরা পড়ে না।

আমরা মনে করি, দেশের সচেতন মানুষের ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা উচিত, বিশ্বকাপ উন্মাদনায় ওয়ান পার্সেন্টও ফায়দা বা লাভ নেই, শুধুই ক্ষতি। তাই কুরআন-সুন্নাহ যেসব বিষয়কে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে এবং যেসবের প্রতি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে মুসলমান যদি ঐসব বিষয় থেকে বেঁচে থাকে তাহলে ইনশাআল্লাহ কেউ তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। আর আল্লাহ না করুন, এর বিপরীত হলে এবং হতেই থাকলে পতনও কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

লেখক: তরুণ আলেম ও সাংবাদিক।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ